মুসলমানদের কেমন চোখে দেখেন ম্যাক্রো

একটি মসজিদ পরিদর্শনে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র - এএফপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪১

একসময় পশ্চিমা বিশ্বের আতঙ্ক ছিল কমিউনিজম। পশ্চিমারা তখন কমিউনিজম ঠেকাতে মুসলিম বিশ্বের দিকে ঝুঁকে থাকতো। কমিউনিজম যে ইসলাম ও মুসলমানের কত বড় শত্রু প্রমাণে প্রাণান্ত চেষ্টা করতো। কমিউনিজম যে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু এটা মিথ্যে ছিল না। কিন্তু এ প্রচারের ডামাঢোলে যেটা চাপা পড়ে যেতো তা হলো, ওই প্রচারকারীরাও সমানভাবে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুই।

কমিউনিজমের পতনের পর পশ্চিমাদের ওই মুখোশ খসে পড়েছে। তারা এখন কোনো রাখঢাক না-রেখেই ইসলামবিরোধিতায় নেমেছে। তাদের এ অপচেষ্টা কতোটা বেপরোয়া, তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র কথা শুনলে ও কান্ড দেখলে বোঝা যায়। আসুন দেখে আসি ম্যাক্রোর এই তৎপরতার নানা দিক।

গোটা দুনিয়ার পাশাপাশি ফ্রান্সও যখন কোভিড-১৯ মহামারীতে দিকভ্রান্ত, ম্যাঁক্র তখন মহামারী মোকাবিলার চাইতে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তাঁর দেশের মুসলিমদের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপকে। বলে চলেছেন, ইসলামের ভেতরেই নাকি ''সমস্যা'' রয়ে গেছে।

এ ''সমস্যা'' দূর করতে একটি নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র। আগামী ডিসেম্বরে বিলটি ফরাশি পার্লামেন্টে পেশ করা হবে। এটি মূলত সেদেশের ১৯০৫ সালের একটি আইনেরই স¤প্রসারণ, যে আইনে ধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়।

নতুন আইনে অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, ফ্রান্সের বিভিন্ন মসজিদে বিদেশী অনুদানের বিষয়টিতে নজরদারি করতে পারবে রাষ্ট্র, ফরাশি ইমামদের জন্য স্পেশ্যাল সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম চালু করা হবে এবং নেয়া হবে হোম স্কুলিং-এর সংখ্যা কমানোর যথাযথ ব্যবস্থা। সাধারণত ফরাশি মুসলিমরাই তাদের শিশুদের জন্য এ ধরনের স্কুল চালিয়ে থাকে। ম্যাঁক্রো-র ধারণা, এসব স্কুল চালায় ''ধর্মীয় চরমপন্থীরা''।

ইসলাম বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র মন্তব্যের তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছেন ফ্রান্সের মুসলিমরা এবং পাশাপাশি আরো অনেকে। কেউ-কেউ প্রেসিডেন্টের সময়জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। টুইটারে এক সাংবাদিক লিখেছেন, এমন দুঃসময়েও প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র তাদের নিয়ে ভাবছেন দেখে ফরাশি মুসলিমরা আহ্লাদে আটখানা হতে পারেন। কেউ কেউ তাঁর ভাষণকে ব্যঙ্গ করে ''খুৎবা'' বলেও আখ্যায়িত করেছেন। কারন, এটি তিনি দিয়েছেন মুসলিমদের পবিত্র জুমআর দিন।

একজন রাজনীতিবিজ্ঞানী তাঁর ক্ষোভ চেপে না-রেখে খোলাখুলিই বলেন, এসব কান্ড দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। আমি ভাবতে পারি না, কোনো পশ্চিমা নেতা ইসলাম সম্বন্ধে এমন কথা বলতে পারেন। কারণ, ইসলাম ও মৌলবাদী আন্দোলনের মাঝে ব্যাপক তফাৎ রয়েছে।

ফ্রান্সের একজন মুসলিম রাজনৈতিক নেতা বলেন, প্রস্তাবিত আইনে মুসলিম স¤প্রদায়, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদকে এক পাল্লায় তুলে আসলে ইসলামের মুখে কালিমা লেপন করা হচ্ছে। এ অবস্থায় এ আইন সারা দেশে আরো বেশি করে ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেবে। এমনিতেই দাড়ি-টুপি পরিহিত কাউকে দেখলেই ফরাশি প্রতিবেশীরা পুলিস ডাকছে। বলছে, এ লোককে আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছি।

প্রস্তাবিত নতুন আইন নিয়ে গত ২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো দীর্ঘ দুই ঘণ্টাব্যাপী ভাষণ দেন। তাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় তাঁর ইসলামবিরোধিতা প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্যের জবাবে ফ্রান্সের ১০০ জন বিশিষ্ট মুসলিম প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, একজন নারী হিজাব পরল কী পরলো না, এটা কোনো রাষ্ট্রীয় বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। এসব ফাঁপা রাজনৈতিক ও মিডিয়া বিতর্ক বন্ধ করুন।

কিন্তু বন্ধ করতে বললেই তো আর বন্ধ হয় না! ইসলামভীতি আর মুসলিমবিদ্বেষ ফ্রান্সের সমাজে কেমন ব্যাপকতা লাভ করেছে তা আরো স্পষ্ট হয় গত মাসের এক ঘটনায়। এদিন ফরাশি পার্লামেন্টের এক সরকারদলীয় সদস্য হঠাৎ অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন। ব্যাপার কী? জানা গেলো, দর্শক গ্যালারিতে হিজাব পরিহিত এক স্কুলছাত্রীকে দেখা যাচ্ছে। তাই এমপি মহোদয় আর অধিবেশনে থাকতে স্বস্তি পাচ্ছেন না। কী এক সভ্যতা!

ওই সময় এক ফরাশি সাংবাদিক রান্না বিষয়ক একটি ভিডিও পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওতে দেখা যায় হিজাব পরিহিতা এক মুসলিম নারী রান্নায় ব্যস্ত। ওই সাংবাদিক ভিডিওর ক্যাপশন দেন ''১১ সেপ্টেম্বর''। অর্থাৎ হিজাব পরে রান্না করা আর টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা এক। কী উর্বর মস্তিস্ক ফরাশি সাংবাদিকের! আবার ম্যাক্রো-র কথায় বগল বাজানোর মতো মুসলিমও দু-এক পিস আছে। এ রকম একজন হলেন হাকিম এল-কারওয়ি। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্র-র বন্ধু এ ব্যক্তি বলেন, প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ইসলামিজমের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।

ফ্রান্সের বর্তমান সরকারের আমলেই বেশ-কিছু ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মর্মে আইন করা হয়। এর মাঝে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা, মুসলিম নারীদের চেহারা ঢেকে রাখা ইত্যাদি। এমন ''অপরাধে'' তাদের জেল-জরিমানার বিধান করা হয়।

কেন্দ্রীয় সরকার যখন এমন ব্যবস্থা নিয়েছে তখন স্থানীয় সরকার তথা স্থানীয় রাজনীতিকদের আর পায় কে, তারা আরো কঠোর ব্যাখ্যা দিয়ে করতে পারে নতুন আইন।

এমন অবস্থায় অনেক মুসলিম ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দিতে পারে সরকার। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের দোকানে 'হারাম' পণ্য বিক্রি করতে না-ও চাইতে পারেন।

মুসলিমদের ওপর এত কড়াকড়ি আরোপের পরও খুশি হতে পারছেন না প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র। প্রস্তুতি নিচ্ছেন নতুন আরেক দফা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের, যার কথা একটু আগেই বলা হয়েছে। এমনকি তিনি দাবি করেছেন ধর্ম হিসাবে ইসলামের মধ্যে নানা সমস্যা আছে।

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সও গত কয়েক দশকের সবচাইতে খারাপ অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে। 'ইয়েলো ভেস্ট' আন্দোলনকারীরা তো আছেই, পাশাপাশি পুলিসের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও। সব মিলিয়ে ফ্রান্স দেশটি আছে টালমাটাল অবস্থায়।

এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র এ রকম ইসলামবিরোধী মন্তব্য নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর পেছনে একদিকে রয়েছে দেশটির চিরাচরিত ইসলামভীতি, অন্যদিকে সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজনীতির প্রভাব।

এক সময় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশ ফ্রান্সের কলোনি ছিল। তখন সেখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যা করেছে, প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র সা¤প্রতিক মন্তব্য তারই ধারাবাহিকতা বৈ আর কিছু নয়। যেমন, আলজেরিয়ায় ফরাশি ঔপনিবেশিক শাসকরা মুসলিম নারীদের বোরকা পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মুসলিমরা ইসলাম ধর্ম এবং আরবী ও আমাযিঘ ভাষা ত্যাগ না-করলে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হতো।

ফরাশি ঔপনিবেশিক শাসকদের এসব দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ আলজেরিয়াবাসী এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। আর শাসকগোষ্ঠী তা দমনে আশ্রয় নেয় চরম নিষ্ঠুরতার। তাদের হাতে কমপক্ষে এক মিলিয়ন মানুষ নিহত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে অবশেষে আলজেরিয়া ছেড়ে আসে ফ্রান্স।

সা¤প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নির্বাচনে জয়লাভ এবং দৈনন্দিন অনেক সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার একটা প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিমবিদ্বেষ প্রচার।
ফ্রাসে ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ অস্ত্রটি ব্যবহারের কাজে বেপরোয়া এখন প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র এবং তাঁর কট্টর ডানপন্থী প্রতিদ্ব›দ্বী মেরিনে লা পেন। লা পেনের প্ল্যাটফরমটি ইসলামবিরোধীদের, এটা সবাই জানে। তাই প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাদের মাঝে নিজের কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে।

একজন সাংবাদিক এ নিয়ে টুইটারে লিখেছেন, ম্যাঁক্র-র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন টলটলায়মান। তাই তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বালানোর পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ এটিই হলো একমাত্র পন্থা, যা ভোটের মাঠে কখনো ব্যর্থ হয় না।

মজার ব্যাপার হলো, ফ্রান্সের এই প্রেসিডেন্টই আবার নিজস্ব ব্র্যান্ডের ''মডারেট ইসলাম'' কায়েমে সাথী হিসেবে বেছে নিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমীরাত, মিশর ও সউদি আরবকে।

প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র র‌্যাডিক্যাল ইসলামের সংজ্ঞা মেনে নিলে ফ্রান্সের মুসলিমরা আরবী ভাষা চর্চা করতে পারবে না, মুসলিম নারীরা হিজাব পরতে পারবে না, কোনো রকম ইসলামী পোশাকও পরতে পারবে না। তবে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র-র এই নববিধান মধ্যপ্রাচ্যের সেসব শাসকদের বেলায় কার্যকর হবে না, যারা গণহত্যা চালায়, সাংবাদিকহত্যা করে কিন্তু টুইটারে ভিন্নমত প্রকাশ করলেও জেলখানায় ঢোকায়।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ইসলামবিদ্বেষের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে তিনি একজন অমুসলিম। ইসলাম সর্ম্পকে তার ধারনার প্রকাশ ঘটছে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর স্বৈরাচারী শাসকরা যে তাঁর পোঁ ধরেন, তার ব্যাখ্যা কী?

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে