শ্রীলংকায় চীন-ভারত ও আমেরিকার খেলা

কার্টুনটি করেছেন প্রদীপ - দ্যা মরনিং

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:১৩

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে তিন ক্যাটাগরির রাষ্ট্রনায়ক আছেন। এদের একদল টুইটার-আসক্ত। এরা কথায়-কথায় টুইট করেন, যে-কোনো ইস্যুতে টুইটারে নিজের মতামতটি প্রকাশ করেন। এই শ্রেণিতে পড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফের মতো নেতা। আরেক দল আবার উল্টা, তাঁরা ওদিকে হাতই বাড়ান না। যেমন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শেষের দলটি টুইটারে আসক্তও নন, নিরাসক্তও নন। এঁরা কেবল প্রয়োজনেই এই মাইক্রো-ব্লগিং অ্যাপটি ব্যবহার করেন। এই শেষের দলে পড়েন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে তাঁর রাষ্ট্রীয় কাজের বাইরে গত সম্প্রতি একটি দিন বেশ-একটু অন্যরকম ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন তিনি টুইটারে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দনবার্তা পাঠান। পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৭০তম জন্মদিনে 'উষ্ণ শুভেচ্ছা' জ্ঞাপন এবং তাঁর সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করেন।

এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবে রাজাপক্ষের তৃতীয় টুইটটি ছিল পিলে চমকানো। নরেন্দ্র মোদিকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর কয়েক ঘণ্টার মাথায় শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী টুইট করেন : ''আমি কলম্বো পোর্টসিটি প্রজেক্ট পরিদর্শনে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন চীনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত এবং অপর ক'জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে চলেছে। ছয় বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং এবং আমার মাথায় এ প্রকল্পের ধারণা আসে। ওখানে আমি কিছুক্ষণ গলফ খেললাম।''

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৭০তম জন্মদিনে চীনের টার্ফে গলফ খেললেন রাজাপক্ষে? শ্রীলঙ্কার জিওপলিটিকসে এ ঘটনাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

গত ২৪ আগস্ট চীনের ২৪টি সরকারি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব সংস্থার মধ্যে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কম্পানি বা সিসিসিসি-র কয়েকটি সহযোগী সংস্থাও রয়েছে। সিসিসিসি হচ্ছে বিশ্বব্যাপী চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম ঠিকাদারি সংস্থা।

চৈনিক কম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চীনকে আমেরিকা এ বার্তাই দিল যে, চীনের স¤প্রসারণবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে সিসিসিসি বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার অবশ্যই মেনে নেয়া হবে না। এ বিষয়ে এক ব্রিফিঙয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তা সুস্পষ্টভাবে আঙ্গুল তোলেন শ্রীলঙ্কার দিকে। তিনি বলেন, দেশটির হাম্বানতোতা বন্দর প্রকল্প 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচির একটি পরিচিত নাম। চীনের একটি সংস্থা এটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ বহু পুরনো। তিনি আরো বলেন, আমাদের মতো অপর আর দেশও শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের ব্যবসাবাণিজ্য, একাডেমিক এক্সচেঞ্জ, ভিসাসহ নানা দিকে ওতপ্রোত সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন।

বোঝাই যায়, শ্রীলঙ্কায় চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' কর্মসূচি বানচাল করতে ভারত-মার্কিন এখন একাট্টা। বিশেষ করে কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্পটি। ভারতীয় কর্মকর্তারা আভাসও দিয়েছেন যে, প্রকল্পটি নিয়ে সামনে অনেক ঝামেলা আছে। তাদের কথাই সত্য হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সময় চীনের ২৪ সরকারি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল, যখন শ্রীলঙ্কায় হাম্বানতোতা বন্দর, মাত্তালা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এমন এক ত্রিশঙ্কু অবস্থায় কলম্বোর এক ভাষ্যকার লিখছেন : ''ভূরাজনীতির এক কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়ছে শ্রীলঙ্কা। এ দেশের বহিঃপরিবেশ আমূল বদলে গেছে। কিন্তু আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগের চাহিদা একটুও কমেনি। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে চীনই একমাত্র দেশ, যারা এ বছরও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। ভারত অর্জন করেছে ১৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। তাদের নিজেদের প্রয়োজন নিয়ে এতই বেশি ব্যস্ত যে তারা দেশের বাইরে বিনিয়োগের কথা ভাবতেই পারবে না।''

এমন এক অবস্থায় গত ৩০ আগস্ট মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার ফোন করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে। পরে জানানো হয়, দু' নেতা কথা বলেছেন একটি ফ্রী অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিষ্ঠার অভিন্ন অঙ্গীকার নিয়ে, যেখানে সব দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকবে। তাঁরা অভিন্ন দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারগুলোও পর্যালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে চলে আসে সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা রক্ষায় সহযোগিতার কথাও। তাঁরা দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরো বাড়ানোর এবং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে আরো এগিয়ে নেয়ারও অঙ্গীকার করেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসপার পরে টুইটারে লিখেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সাথে ''আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিবেশ'' নিয়ে আলাপ করেছেন।

কৌতুহলোদ্দীপক হলো, শ্রীলঙ্কায় জাতিগত পুনর্মিলন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন এসপার। এ সময় তিনি রাজাপক্ষকে এক ধরনের হুমকিও দেন। বলা প্রয়োজন যে, এই রাজাপক্ষের নেতৃত্বেই শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিজয় অর্জন করে সরকারি বাহিনী। আর প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে নিজে এখনও একই সাথে মার্কিন নাগরিকও।

প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সঙ্গে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই টেলিফোন সংলাপও একটি বিরল ঘটনা। স্মরণকালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এটাই প্রথম টেলিফোন সংলাপ। গুয়াম যাত্রার আগমুহূর্তে রাজাপক্ষকে টেলিফোনটি করেন এসপার। গুয়াম মিশনটিও চীনকে ঠেকানোর আরেকটি ত্রিদেশীয় উদ্যোগ।

এসপার আসলে ঠিক কী কারণে টেলিফোন করেছিলেন, শ্রীলঙ্কা এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। তবে মনে করা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সাথে সোফা চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় আমেরিকা। আর চায় কলম্বো বন্দরের ইস্টার্ন টার্মিনালটি দেখাশোনার ভার দেয়া হোক ভারতকে। আর আমেরিকার সাথে করুক মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন বা এমসিসি চুক্তি, যার অধীনে শ্রীলঙ্কা পাবে ৪৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান। এমসিসি হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি হাতিয়ার।

আমেরিকার সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়তেও শ্রীলঙ্কাকে চাপ দিয়ে চলেছে দেশটি। এদিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদীরা কলম্বো বন্দরের ইস্টার্ন টার্মিনালটি দেখাশোনার ভার ভারতকে দেয়ার ঘোর বিরোধী। তাদের যুক্তি হলো, এতে দেশের কৌশলগত সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হবে। তাদের মতে, শ্রীলঙ্কা হবে একটি নিরপেক্ষ দেশ। তাকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এ দেশ কারো পাওয়ার গেমের ফাঁদে পা দিতে চায় না।

এদিকে চীনকে ঠেকাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত-মার্কিন গাঁটছড়াই হয়ে উঠেছে শ্রীলঙ্কার জিওপলিটিক্স। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় ভারত-মার্কিন প্রথম সফল প্রকল্প ছিল দেশটির শাসক বদল। তারপর থেকে ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে মালদ্বীপে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির একটা অজুহাত খাড়া করতে।

ভারতের এ চেষ্টা ফল দেয় ১০ সেপ্টেম্বর। মালদ্বীপ ও আমেরিকা এদিন সই করে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক এক চুক্তিতে। বলা হয়, ভারত মহাসাগরে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান এবং একটি ফ্রী অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিষ্ঠাই এ চুক্তির লক্ষ্য।

এদিকে এসপারের ফোন কলের তিন দিন পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট তাঁর দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যাওয়ার মতো কিছু ঘোষণা দেন। তিনি দেশের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা, প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং নির্বাহী প্রেসিডেন্সি পুনর্বহালের কথা বলেন।

শ্রীলঙ্কায় একটি নতুন সংবিধান অবশ্যই সময়ের দাবি। তবে এটা করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এর অর্থ হলো, সোফা চুক্তি, কলম্বো বন্দরের দেখাশোনার কাজ ভারতকে প্রদান, এমসিসি চুক্তি ইত্যাদি সব বড় সিদ্ধান্ত পেছনে চলে যাবে। আর তাই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ধৈর্য ধরতে হবে।

এরমধ্যে সম্প্রতি কলম্বো পোর্ট সিটি পরিদর্শনে যান মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এ সময় তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প হবেই। এ দিয়ে বেশি কথা বলার কিছু নেই। তিনি আরো বলেন, আগামী বছরগুলোতে কলম্বো পোর্ট সিটি হবে দেশের আয়ের প্রধান উৎস। ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করায় তিনি চীন সরকারকে ধন্যবাদ দেন।

এদিকে ভারতের হিন্দু মৌলবাদী সরকারকে খুশি করতে গত মাসে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। যে-দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ মাংসভোজী সে-দেশে এমন পদক্ষেপ অভিনব বৈকি।এখন তাদের মাংসের চাহিদা মেটাতে হবে বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানি করে। এভাবেই চলছে ভারত-লঙ্কা সম্পর্কের রসায়ন।

রাজাপক্ষে এখন জানেন, তাঁর পায়ের নিচে এখন মাটি নয়, শক্ত কনক্রিটের ঢালাই করা চত্বর। আর মোদীও বুঝতে পারছেন, রাজাপক্ষে একজন জাত পলিটিশিয়ান, ভারতকে তাঁর সাথেই চলতে হবে। এই বোঝাবুঝির ফল কী দাঁড়ায়, তার জবাব দেবে আগামী দিন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে