জাতিসংঘে এরদোয়ান-ইমরানের কুশলী চাল

ভারতে মুসলিম নিপীড়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে বারবার তুলে ধরছেন মুসলিম বিশ্বের দুই জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৯ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৩১

একথা এখন বিশ্বের সবাই জানেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দেশকে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। মোদির মুসলিমবিরোধী মূর্তি চরমভাবে প্রকাশিত হয়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে।

ভারতে মুসলিম নিপীড়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে বারবার তুলে ধরছেন মুসলিম বিশ্বের দুই জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যেপ এরদোয়ান ও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আর এ কাজে তারা কৌশলে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফরম জাতিসংঘকে ব্যবহার করছেন। এতে বিশ্বসভায় নাজেহাল হচ্ছে ভারত।

ভারতের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক উষ্ণই ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যও চলছিল বেশ। তবে সেসবকে বড় করে দেখেননি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ভারতে মুসলিম নিপীড়ন ও কাশ্মীরে ভারতের অবৈধ দখলদারিত্ব নিয়ে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। হৃদয় যার ইসলাম ও মুসলিমের জন্য ভালোবাসায় সিক্ত তিনি তো এ ধরনের ইস্যুতে কথা বলবেনই। এরদোয়ানের কণ্ঠে তাই বারবার উঠে আসছে ভারতে মুসলিম নিপীড়নের কথা।

এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণে এরদোয়ান বলেছেন, কাশ্মীর ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির মূল চাবিকাঠি। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির পর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা এ সঙ্কটকে আরও জটিল করবে।

এরদোয়ান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হলে কাশ্মীর সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। এটি এখনও একটি জ্বলন্ত সমস্যা। জাতিসংঘের প্রস্তাব ও কাশ্মীরের মানুষের প্রত্যাশা মেনে এই সঙ্কটের সমাধান করতে হবে।

গত বছরের আগস্টে আনকারায় কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণে এরদোয়ান বলেছেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধীয় জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের উদ্বেগজনক ঘটনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তুরস্ক।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ওই অঞ্চলটি স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ছিল। গত বছর মুসলমান অধ্যুষিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয় ভারত সরকার। ফলে সেখানে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।

চলতি বছরের শুরুতে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে গিয়েও কাশ্মীরের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন এরদোয়ান। তিনি কাশ্মীর পরিস্থিতিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রশক্তির গ্যালিপোলির যুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন।

চলতি বছরের শুরুতে ভারতের দিল্লিতে মুসলমানদের ওপর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নৃশংস হামলার ঘটনায়ও কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এরদোগান।

গত ফেব্রুয়ারিতে আঙ্কারায় এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ভারত বর্তমানে এমন একটি দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে ব্যাপকহারে গণহত্যা চলছে। কোন গণহত্যা? মুসলিম গণহত্যা। কারা করছে? হিন্দুরা।

এ সময় তুর্কি প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, এসব মানুষ কিভাবে বিশ্ব শান্তির পক্ষে কাজ করবে! কোনোভাবেই সম্ভব না। তাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। তারা বলে তারা অনেক শক্তিশালী, কিন্তু এটা তো শক্তি না। স্কুলে যাওয়া শিশুরাও দাঙ্গাবাজদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। শিশুদের ধাতব লাঠি দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করা হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালের শুরুতে এরদোয়ান রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন। দিল্লিতে আসার ঠিক আগে একটি ভারতীয় চ্যানেলকে সাক্ষাৎকারে তিনি কাশ্মীর প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা ভারতের কাছে একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। সাক্ষাৎকারে এরদোয়ান বলেন, ‘কাশ্মীরে এই রক্তপাত আমরা চলতে দিতে পারি না। চিরতরে এই সঙ্কটের সমাধানের জন্য আমরা বহুপাক্ষিক একটা সংলাপের সূচনা করতে পারি, তাতে তুরস্কও জড়িত হতে পারে। আর এতে ভারত, পাকিস্তান উভয়েরই লাভ হবে। আমার প্রিয় বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বিষয়টা নিয়েও আমার অনেকদিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে। আমি খুব ভাল করে জানি তার সদিচ্ছা আছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও চান এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক।’

কাশ্মীর প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে প্রকাশ্যে এমন মনোভাব দেখাবেন তা ভারত ধারণা করতে পারেনি।

প্রশ্ন উঠছে ভারতে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে কেন বারবার সোচ্চার হচ্ছেন এরদোয়ান?
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র পলিসি ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আসলে তুরস্ক একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের উন্নীত করতে চায়। একটি মাঝারি মাপের উদীয়মান শক্তি থেকে একুশ শতকের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশগুলোর কাতারে তুরস্ককে যাতে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার লিগ্যাসি-কে সেভাবেই রেখে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

এরদোয়ানের মতই বিশ্বমঞ্চে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে চলছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা চিরকালের। ১৯৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ ও ২০১৯ সালে চারটি যুদ্ধে তাদেও মধ্যে। এর মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয় কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীরের অধিকাংশ জনসংখ্যা মুসলমান হওয়ায় বেশিরভাগ জনগণ চাইছেন হয় স্বাধীন কাশ্মীর অথবা পাকিস্তান অংশে যোগ দিতে। তবে পাকিস্তান কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিকেও সমর্থন করে।

গত বছর জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এক ঐতিহাসিক ভাষণের অধিকাংশজুড়ে ছিল কাশ্মীর ইস্যু। এ অধিবেশনে সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানরা ১৭ মিনিট করে সময় পান। সেখানে ৪৫ মিনিট কথা বলেন ইমরান খান। কাশ্মীর ইস্যুকে বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরতেই জাতিসংঘের এ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন বলে তার আগেই জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।

ভাষণে ইমরান খান বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সমর্থিত সরকার মুসলিমদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে জুলুম, নির্যাতনের শিকার কাশ্মীরীরা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে এবং পুলওয়ামা হামলার মতো আরো ঘটনা ঘটতে পারে।’

ইমরান খান আরো বলেন, ‘১৮ কোটি ভারতীয় মুসলমান দেখছে, ৮০ লাখ কাশ্মীরি মুসলমানের সঙ্গে কী আচরণ করছে ভারতীয় বাহিনী। বিশ্ববাসীরও এদিকে নজর দেওয়া উচিত, দেখা উচিত। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববাসীর এ নিয়ে সরব হওয়া দরকার।’

কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া সংবিধানের ৩৭০ নং আর্টিকেল তারা বাতিল করল। কাশ্মীওে প্রচুর সেনা সমাবেশ করল। এখন কাশ্মীরে মোট ভারতীয় সেনার সংখ্যা ৯ লাখের বেশি। এর মাধ্যমে ৮০ লাখ লোকের উপর কারফিউ জারি করা হল।

মোদির সমালোচনা করে তিনি বলেন, একজন লোক কিভাবে এটা করতে পাারে, এটা বুঝার জন্য আপনাকে জানতে হবে আরএসএস সম্পর্কে। আমি আরএসএস সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে চাই। নরেন্দ্র মোদি আরএসএস এর আজীবন সদস্য। আরএসএস এমন একটি সংগঠন যেটি এডলফ হিটলার এবং মুসোলিনীর হিংস্র আদর্শে অনুপ্রাণিত। নাৎসীরা যে পদ্ধতিতে অন্য সকল জাতি হতে নিজেদের সেরা ভাবতো একই ভাবে আরএসএসও নিজেদের সবার চেয়ে সেরা মনে করে।

ইমরান খান বলেন, আরএসএস ভারত থেকে মুসলমানদের জাতিগত নিধনে বিশ্বাসী। এটা সবাই জানে, আরএসএস হিন্দুত্ববাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। তারা মুসলিম ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। তারা বিশ্বাস করে মুসলিম শাসনের ফলে হিন্দুত্ববাদের সোনালী যুগের অবসান ঘটেছে। তারা সরাসরি মুসলিম ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। এটা সবাই জানে। গুগল করে আপনি জানতে পারবেন আরএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা গোলকওয়ার। এই ঘৃণার আদর্শ ১৯৪৮ সালে হত্যা করেছে ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীকে।

ইমরান খান বলেন, মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এই ঘৃণার আদর্শ আরএসএস গুন্ডাদেরকে ২০০০ মুসলিমকে জবাই করতে প্রেরণা দিয়েছিল। মোদির নির্দেশে গেরুয়া পাঞ্জাবী পরে ৩ দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল আরএসএস সন্ত্রাসীরা। তাদের তান্ডবে অন্তত ২০০০ মুসলিম নিহত হয় এবং গৃহহীন হয় দেড়লাখ মুসলিম। মোদি তখন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে আমেরিকা ভ্রমণ করতে পারেননি।

ইমরান খান বলেন, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের উগ্র চিন্তাধারা নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপিকে অন্ধ করে দিয়েছে। গত ৩০ বছরে কাশ্মীরে ১ লাখ নাগরিক নিহত হয়েছে, ১১ হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছে। এটা জাতিসংঘের রিপোর্ট। কিন্তু বিশ্ববাসী কিছু করছে না। কারণ তারা দেখছে ভারত তাদের জন্য ১২০ কোটি জনসংখ্যার বিশাল বাজার। বৈষয়িক স্বার্থের কাছে বলি হচ্ছে মানবতা।

মোদি বলছে এটা কাশ্মীরের উন্নয়নের জন্য। কিন্তু যখন ৮০ লাখ কাশ্মীরি বন্দীত্ব ভেঙ্গে ৯ লাখ সেনার মোকাবেলা করবে তখন কী ঘটবে? আমি আশঙ্কা করছি রক্তগঙ্গা বইবে।

ইমরান খান বলেন, কাশ্মীরিদেরকে খাঁচাবন্দী পশুর মতো বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদেরকে এমনকি প্রো-ইন্ডিয়ানদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৩ হাজার যুবককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যুবকদের ছড়রা গুলি দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

চলতি বছরের শুরুতে ইমরান খান এক টুইটে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।

টুইটারে দেয়া এক পোস্ট পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়েকশ কোটি লোকের ভারত আজ আমরা নাৎসি অনুপ্রাণিত আরএসএস মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণে। যখনই কোনো বর্ণবাদী মতাদর্শের উত্থান ঘটে, তখন তা ব্যাপক রক্তপাতের দিকে নিয়ে যায়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে