গ্রিসের সামরিক শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা কতটা ফল দেবে

এরদোয়ান বলেন, হয় তারা রাজনীতি ও কূটনীতির ভাষা বুঝবে অথবা তাদেরকে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার শিকার হতে হবে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২০ অক্টোবর ২০২০, ১৪:০০

ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার পূর্বাংশে তুরস্কের সাথে গ্রীসের বিরোধ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিরোধটা এতোদিন ছিল রাজনৈতিক পর্যায়ে, এখন সম্ভবত তা সামরিক বিরোধে রূপ নিতে যাচ্ছে। এটা কোনো কষ্টকল্পনা নয়, রুঢ় বাস্তবতা। এ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গ্রিস ভাবছে, তুরস্ককে তারা বলপ্রয়োগেই ঠেকিয়ে রাখবে। আর এ ভাবনা থেকেই দেশটি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখারই আধুনিকীকরণের এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহের।

ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে গ্রীস-তুরস্ক বিবাদ বহুদিনের। এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে সম্প্রতি ভূমধ্যসাগর থেকে একটি জাহাজ ফিরিয়ে নিয়েছে তুরস্ক। এক মাসেরও বেশি সময় ভূমধ্যসাগরে অবস্থানের পর আনাতোলিয়া বন্দরে ফেরত যায় জাহাজটি।

গত ১০ আগস্ট জাহাজটিকে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের পাশ্ববর্তী ভূমধ্যসাগর এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য জরিপ কাজে মোতায়েন করেছিল তুরস্ক। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপীয়ান মিত্র ও আরব আমিরাতের সহযোগিতায় ভূমধ্যসাগরে নৌ-মহড়ার আয়োজন করে গ্রিস। ফলে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তুরস্কের জাহাজ ফেরত নেয়াকে স্বাগত জানিয়ে গ্রিস সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ' হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে।

একই সাথে সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা আরো ১৫ হাজার বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ যে ঘোষণাটি দিয়েছেন তা হলো, ফ্রান্সের কাছ থেকে গ্রীস ১৮টি রাফায়েল জঙ্গি জেট বিমান এবং চারটি নতুন মাল্টিরোল ফ্রিগেট কিনবে।

এটা ঠিক যে, তুরস্কের মোকাবিলা করতে হলে গ্রীসের সবার আগে যা প্রয়োজন সেটি হলো রাফায়েল জঙ্গি জেট বিমান। এগুলো বানায় ফ্রান্স। পৃথিবীর সবচাইতে দামি জঙ্গি বিমানগুলোর একটি এই রাফায়েল বিমান। এর একটির দাম ২৪০ থেকে ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কিনা লকহীড-মার্টিনের এফ-৩৫ স্টিলথ জঙ্গি বিমানের দ্বিগুণ। এদিকে অর্থনৈতিক মন্দার ক্ষত এখনও শুকায়নি গ্রীসের শরীর থেকে। এমন অবস্থায় তারা কি পারবে এমন চড়া দামের জঙ্গি বিমান কিনতে? আর ফ্রান্সই কি শুধু মুখের কথায় এ বিমান দিয়ে দেবে?

এমন চড়া দামের কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না এ বিমান। যেসব উন্নয়নশীল দেশ এর খরচ বহন করতে পারে, কেবল তারাই এসব বিমান কিনে থাকে। স¤প্রতি মিশর ও ভারতে এ বিমান বিক্রি ব্যাপক কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। এতে করে এ বিমান কেনার সাথে দুর্নীতির বিষয়টি সমানভাবে জড়িয়ে গেছে।

বেশি দাম ও দুর্নীতির নানা ফাঁক ফোকরের কারনে অনেক দেশই এ বিমানের ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেয়। এ রকম দু'টি দেশ হলো সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। তারা এখন এফ-১৫ কেনার দিকে ঝুঁকেছে। মিশর পছন্দ করছে রাশিয়ার এসইউ-৩৫। একই পথ অনুসরণ করে ব্রাজিল, ওমান, মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমীরাত ও কুয়েত। তারা সবাই ফরাশি এই জেট বিমান বাদ দিয়ে এফ-১৬ ও এফ-১৮এর মতো মাঝারি বা হাল্কা ডিজাইনের বিমানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ অবস্থায় গ্রীসকে ১৮টি জেট বিমানের আটটি বিনামূল্যে দেয়ার প্রস্তাব দেয় ফ্রান্স।

তুরস্ক ও গ্রিস দু'দেশের কোনোটিই কিন্তু যুদ্ধ চায় না। তারপরও তুরস্ক অস্ত্র, ড্রোন ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে গ্রীস অবশ্য অনেক পিছিয়ে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী সবে অঙ্গীকার করেছেন সামরিক শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার। পাশাপাশি এও বলেছেন, হু উইল বিয়ার দ্য কস্ট? এই বিশাল ব্যয়ের ভার বহন করবে কে? মানচিত্রের যেখানে আমাদের অবস্থান, তার একটা মূল্য তো আমাদের পরিশোধ করতেই হবে। অর্থাৎ গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চাইছেন যে তার দেশকে ভৌগোলিক অবস্থানের মূল্য দিতে হচ্ছে।

গ্রিসকে ফ্রান্স ৮টি রাফায়েল জঙ্গি জেট বিমান বিনামূল্যে দিলেও বাকি ১০টির দাম তো পরিশোধ করতে হবে! এটাও গ্রীসের নড়বড়ে অর্থনীতির জন্য মোটেই কম বোঝা নয়। কেননা গত এক দশক ধরে দেশটির অর্থনীতিতে মন্দা চলে আসছে। হালে এর ওপর পড়েছে করোনা মহামারীর চাপ। এমন অবস্থায় সামরিক ব্যয়ের বোঝা চাপলে তা দেশটিকে কোন অতলে নিয়ে যাবে সে-কথা না-বললেও চলে।

এমন দুর্দিনেও সরকার ১০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেট করেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে আশঙ্কা করে গ্রীসের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তড়িঘড়ি করে বলেন, '১০ মিলিয়ন ডলার তো হেলাফেলার বিষয় নয়!' এ কথা বললেও অঙ্কটি এর চাইতে বেশি না কম, তা আর তিনি খোলাসা করেননি।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী যা-ই বলুন, গ্রিস কিন্তু জার্মানির কাছ থেকে চারটি ন্যাভাল ফ্রিগেট কিনছে এবং আর চারটি মেরামত করাচ্ছে। নতুন ফ্রিগেটগুলো আগামী ১০ বছরের মধ্যে ডেলিভারি পাবে গ্রীস। তুরস্কের সাথে পাল্লা দিলে এই সরবরাহের সময়সীমা অনেক দূরের পথ। কারন তুরস্কের বারবারোস ফ্রিগেট আগামী বছরই মোতায়েন করার কথা!
নিজেদের এ পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করেও গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী তার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন এই বলে যে, আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা আসছে।

ভয়ের কিছু নেই। তবে দেশবাসীকে অভয় দিলেও গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেননি, এতে কয় বছর বা কত যুগ লাগতে পারে। অথচ প্রয়োজনটা যে এখনই!

এদিকে যে ফ্রান্স থেকে জঙ্গি বিমান কেনার তোড়জোড় করছে গ্রীস, সেই ফ্রান্সের অর্থনীতির অবস্থাও খুব সুবিধার নয়।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে দেশটির এ অবস্থা চলছে। এর প্রভাব পড়েছে সেদেশের নৌ ও বিমান বাহিনীর ওপর। এ অবস্থার মধ্যেও ফ্রান্স নিজের ক্ষমতা দেখাতে বহুজাতিক বাহিনীর ওপর ভর করে বিভিন্ন দেশে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাই অভিযোগ করেছিলেন যে, ফ্রান্স তেলের লোভে লিবিয়ায় এবং হীরা, স্বর্ণ ও কপারের লোভে আফ্রিকায় হস্তক্ষেপ করছে।

আবার ফিরে আসি গ্রিসের কথায়। ধরা যাক, গ্রীসের সাথে তুরস্কের ছোটখাট একটা যুদ্ধ লেগেই গেল। গ্রিস কি তখন পারবে তুরস্কের সাথে টিকে থাকতে? মনে হয় না। কারণ, তুরস্কের একেবারে ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারার মতো দূরপাল্লার মিসাইলই নেই গ্রিসের হাতে। তুর্কী বাহিনীকে ঠেকিয়ে দেয়া তো অনেক পরের ব্যাপার।

একই কথা খাটে সাইপ্রাসের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা নিয়েও। এখানেও এগিয়ে আছে তুরস্ক। কেননা, গ্রিসের মূল ভূখন্ড থেকে সাইপ্রাসের দূরত্ব ৮২০ কিলোমিটার, যেখানে তুরস্ক মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত। সব মিলিয়ে দেখে বলতে হয়, সামরিক শক্তির বিচারে তুরস্কের চাইতে অনেক পিছিয়ে আছে গ্রীস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের আর কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই নেই। এমন অবস্থায় গ্রীস-তুরস্ক সংঘাত লেগে গেলে তার ফল কী হবে, তা খালি চোখেই দেখা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরল সত্যটা গ্রীস কি উপলব্ধি করতে পারছে? তা পারুক অথবা না-ই পারুক, উভয় পক্ষের বাগযুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। গ্রিসকে হুমকি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাসের অধিকার নিয়ে তুর্কি বাহিনী সামরিক মহড়া পরিচালনার প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রীস যে অনৈতিক ম্যাপ ও ডকুমেন্ট দেখাচ্ছে সেটা ছিঁড়ে ফেলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি তুরস্কের রয়েছে। এটা তারা বুঝতে পারবে। তুরস্ক যেকোনো পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত আছে। এরদোয়ান বলেন, হয় তারা রাজনীতি ও কূটনীতির ভাষা বুঝবে অথবা তাদেরকে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার শিকার হতে হবে।

এরদোয়ানের কথায় মনে হচ্ছে, এই বুঝি যুদ্ধ লেগে গেল। আসলেই কি তা হবে? হলে তার পরিণামই বা কেমন হবে, ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে