প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক বিষিয়ে তুলছে ভারতীয় গণমাধ্যম

কার্টুনটি করেছেন সুরেন্দ্র - দ্য হিন্দু সেন্টার

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৩৪

ভারত চেয়েছিল বিশ্বশক্তি হতে। কিন্তু এখন দেশটি আঞ্চলিক শক্তির মর্যাদাও হারাচ্ছে। নেপাল ও বাংলাদেশের মত ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশও ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এরপরও ভারতের গণমাধ্যমগুলো দেশটির অলীক শক্তিমত্তা জাহির করে বেড়াচ্ছে। ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো পর্যন্ত চীনকে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে তুলে ধরে নানা ধরণের গল্প প্রচার করছে।

ভারতের গণমাধ্যমে গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুর হতে একটি ভুয়া খবর প্রচার শুরু হয়। এতে বলা হয়, চীনের একটি এসইউ-৩৫ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেছে তাইওয়ান। প্রথমে ভারতের নিউজ লাইন আইএফই নামের একটি অখ্যাত গণমাধ্যমের টুইটারে খবরটি প্রকাশ করা হয়। এরপর ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম যেমন এবিপি নিউজ ও টাইমস নাওয়ের মত গণমাধ্যমেও কোনো সূত্র ছাড়াই খবরটি প্রকাশ করা হয়।

প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দৃঢ়ভাবে ওই খবরের প্রতিবাদ জানায়। এরপর নিউজ লাইন খবরটি ডিলিট করে দেয়। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি গণমাধ্যমটি।

তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের বিরোধ দীর্ঘদিনের। সেখানে এ ধরনের একটি ভুয়া খবরে এমনকি যুদ্ধও লেগে যেতে পারে। অথচ ভারতের গণমাধ্যমে সত্যাসত্য যাচাই ছাড়াই ভুয়া খবরটি প্রকাশ করা হয়। চীনের বিরুদ্ধে ভারতের গণমাধ্যমে হরহামেশাই এ ধরনের ভুয়া খবর প্রকাশ করা হয়। শুধু চীন কেন, চির প্রতিদ¦›দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও লাগাতার অসত্য তথ্য প্রচার করে ভারতীয় গণমাধ্যম।

গত বছরের নভেম্বরে জানা যায়, ভারতের কূটনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ৬৫টি দেশে সক্রিয় রয়েছে ভারতের ২৬৫টি ভুয়া নিউজ ওয়েবসাইট। কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন হরন করার পর বিশ্বজুড়ে এ বিষয়ে ভারতের পক্ষে সমর্থন জোগাতে কাজ করেছে ওয়েবসাইটগুলো।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইডেনসহ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করতে এসব ভুয়া সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো পরিচালনা করছে ভারতীয়রা। স¤প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইইউ ডিজ ইনফোল্যাবের এক অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। শুধু এসব ভুয়া ওয়েবসাইট নয়, ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও এভাবে মিথ্যাচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে পাকিস্তানে ভারতের কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরপরই ভারতের দুটো জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে। তখন ভারতের সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমগুলো দাবি করে ভূপাতিত একটি বিমান পাকিস্তানের। ভারতের বিমানবাহিনী এটি ভূপাতিত করেছে। এ নিয়ে ভারতের বিমানবাহিনীর সাহসিকতার নানা গল্পও প্রকাশ করতে থাকে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। তবে অচিরেই ভারতীয় বাহিনীর সেই ভূয়া বীরত্ব ফাঁস হয়ে যায়।

ভারতের দাবি, সেই হামলার সময় পাকিস্তানের একটি এফ ১৬ যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করা হয়। এ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। পাকিস্তান এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। তারা আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে পাকিস্তানে থাকা এফ ১৬ বিমান গুনে দেখান। তাতে দেখা যায়, বিমানের সংখ্যা আগে যা ছিল এখনও তাই আছে। কয়েক মাস পর ভারত স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে ভারতীয় ভূখন্ডে ভূপাতিত সইে বিমানটি আসলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর।

চীনের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রেও একই ধরনের খবর প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। যেমন ক্যালকাটানিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটের খবরের শিরোনাম হলো : ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের আর্জি চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। মানে হচ্ছে রাজনাথের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বেকুল চীন সরকার। খবরে বলা হয়, কূটনৈতিক মহলের মতে, পূর্ব লাদাখে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার কড়া জবাবে যথেষ্ঠ বেকায়দায় বেইজিং। তাই চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাবে রাজি ভারত। অপরদিকে, পূর্ব লাদাখে এখনও কয়েক জায়গায় সেনা না সরানো এবং চীনের উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে ক্ষুব্ধ নয়া দিল্লি। ফলে নরম না হয়ে কড়া মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই সুর নরম করতে বাধ্য হয়েছে বেইজিং।

ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার বাংলা ভার্সনের একটি শিরোনাম হচ্ছে : বেইজিংকে ভাতে মারতে মরিয়া ভারত। এতে আরও বলা হয়, চীনের বিরুদ্ধে আর কী কী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই নিয়ে কথাবার্তা চলছে। খবরে বলা হয়, মুখে অনেক আশ্বাস দিলেও কার্যক্ষেত্রে লাদাখে অনেক জায়গা থেকে সত্তে¡ও যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না চীনের লাল ফৌজ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে চীনকে শায়েস্তা করা যায়, সেদিকেই জোর দিচ্ছে ভারত।

এখানে ভাষার দিকে লক্ষ্য করার মতো। চীনকে শায়েস্তা করবে ভারত! এমন শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। খবরে আরও বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীও অগ্রবর্তী অবস্থানে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই নিয়েছে ভারত। চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা থেকে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে চীনা সংস্থাগুলোকে দূরে রাখা, মোদী সরকার এভাবেই বেইজিংয়কে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। টাইমস নাওয়ের একটি শিরোনাম হচ্ছে, ভারত চীনকে শুধু একবার না দুইবার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারে।

ভারত নাকি চীনকে শায়েস্তা করতে চায়। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সব ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও সম্মিলিতভাবে এখন চীনের উত্থানে শঙ্কিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অব্যাহতভাবে বলে বেড়াচ্ছেন যে তিনি আগামী নির্বাচনে জয়ী না হলে আমেরিকা চালাবে চীন। অথচ সেই চীনকে নাকি শায়েস্তা করবে ভারত। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিতে ভারতের গণমাধ্যমগুলো বহুলাংশে দায়ী।

শুধুু চীন নয় অন্য প্রতিবেশীদেশগুলোর বিরুদ্ধে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপেশাদারি খবর প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও নেপাল সরকার ভারতের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নেপাল সরকার তো ভারতের সব প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

ভারতীয় সাংবাদিকরা এভাবে যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করায় দেশটি যে কোনো সময় ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ভারতের কথিত ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটাধারী নরেন্দ্র মোদিসহ শাসক দল ও সামরিক নেতারা ঠিকই বুঝতে পারেন তাদের দৌড় কতটুকু। তাই তারা চীনের বিরুদ্ধে খুব বেশি বাগাড়ম্বর করেন না। অনেক সম শান্তির কথাও বলেন । যেমন লাদাখে চীনের কাছে মার খাওয়ার পর চরম উত্তেজনার মধ্যে মোদি সেখানে গিয়ে কিছু দার্শনিকসুলভ কথা বলেন। তবে একবারের জন্যও তিনি চীনের নামটি মুখে নেননি।

ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের এই ব্যর্থতা ঢাকতে এগিয়ে এসেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ভারতের গণমাধ্যমেও এখন হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা মোদি সরকারের পক্ষে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে।

যেমন বাংলাদেশে কয়েকজন লোক নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করলেও তাকে বিশাল সমাবেশ বলে উল্লেখ করে ভারতের গণমাধ্যম। চীনের উইঘুরে মুসলিম নিধনের খবর ভারতের হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমে এখন বড় কাভারেজ পায়। অথচ ভারতের মুসলিমরা উইঘুর মুসলিমদের চেয়ে কোনো অংশে কম নিপীড়নের শিকার নয়। এখন প্রশ্ন উঠছে, আসলে সাংবাদিকতার কাজ কী উগ্র জাতীয়তাবাদ দ্বারা পরিচালিত হওয়া নাকি সঠিক তথ্য তুলে ধরা।

ভারতের গনমাধ্যমে এখন যেভাবে প্রতিবেশি দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয় তাকে এমবেডেড জার্নালিজম ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। মনে হচ্ছে ভারতের মূলধারার অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন বিজেপি সরকারের শয্যায় গেছেন। কিন্তু সাংবাদিকতার জন্য তা ভালো ফল বয়ে আনে না।

ইরাক যুদ্ধের সময় অনেক সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাথে অংশ নিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যেসব খবর দিতো তা প্রচার করতো। ইরাক যুদ্ধে এমবেডেড সাংবাদিকতার উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি “কন্ট্রেল রুম”। সাংবাদিকতার এই রুপ নিয়ে শুধু সমালোচনা হয়েছে তা নয় এর প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে।

ইরাক যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা আমেরিকান সাংবাদিকদের শিখিয়েছে, জাতীয়বাদের চেয়ে সাংবাদিকতা অনেক বড়। সাংবাদিকতা এমন একটা পেশা, একজন মানুষ যখন কাউকে বিশ্বাস করার মতো পায় না, তখন শুধু সাংবাদিককে বিশ্বাস করে। অনেক সাংবাদিকতা বিভাগের দেয়ালে লেখা থাকে, “আমি সাংবাদিক, আমাকে নির্দিধায় বিশ্বাস করতে পারেন”।

ইরাকে গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও প্রায় একলাখ বেসামরিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মার্কিনীরা। অনেক গবেষক বলছেন, সাংবাদিকরা যদি জাতীয়তাবাদ দ্বারা তাড়িত হন, এমন ঘটনা আরো ঘটবে। সাংবাদিকদের কাজ সত্য তুলে ধরা, নিজের দেশের পক্ষে সাফাই গাওয়া নয়।

ইরাব যুদ্ধে অংশ নেয়া এক সাংবাদিক ছিলেন ক্যাপ্টেন জোশ রাশিং। তিনি ছিলেন ইরাক যুদ্ধের মিডিয়া লিয়াজো অফিসার। যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে তিনি আলজাজিরা’র ওপর বিরক্ত ছিলেন। কারণ, আলজাজিরা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি দেখানোর নীতি নিয়েছিলো। তবে যুদ্ধ শেষে তাদের অনেকের মনেই হতাশা, অপরাধবোধ শুরু হয়। ২০০৪ সালে জস রাশিং সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। পরে সাংবাদিকতায় ড্রিগ্রি নেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি এখন আলজাজিরার সাংবাদিক।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে