ভারতের চারদিকে সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে চীন

চীনের সমরকৌশলের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতকেন্দ্রিক - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:০৪

শুধু চীন ও পাকিস্তানের কথা মাথায় রেখে সামরিক প্রস্তুতি নিতে হয় ভারতকে। তবে চীনের টার্গেট যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সমরকৌশলের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতকেন্দ্রিক। এবার ভারতকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল নিয়েছে বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি চীন।

অন্তত ডজনখানেক দেশে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। এর মধ্যে তিনটি দেশ চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারতের প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের এ তৎপরতার উদ্দেশ্য হলো দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএর চীনা ভূখন্ড থেকে বহুদূরেও সামরিক শক্তি প্রদর্শন করার সক্ষমতা নিশ্চিত করা। সেপ্টেম্বরের শুরুতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

পেন্টাগনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মিয়ানমার ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কেনিয়া, সিসিলি, তানজানিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও তাজিকিস্তানে সামরিক ঘাটি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এসব দেশে সামরিক লজিস্টিকস বেজ স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বেইজিং।

পেন্টাগনের ‘মিলিটারি অ্যান্ড সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টস ইনভলভিং দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি মার্কিন কংগ্রেসে জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলেছে, জিবুতির পাশাপাশি উল্লেখিত দেশগুলোয়ও সামরিক ঘাটি স্থাপনের ছক আঁকছে চীন। জিবুতির ওই সামরিক ঘাঁটি স্থল, নৌ ও বিমানসেনাদের সহায়তার জন্য স্থাপন করেছে শি জিনপিং সরকার।

পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পিএলএ সামরিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। তাতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের আগ্রাসী কার্যক্রমে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

পেন্টাগন ধারণা করছে, চীন হয়তো এরই মধ্যে নামিবিয়া, ভানুয়াতু ও সলোমন দ্বীপে তাদের সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছে। পিএলএ যেসব এলাকাকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছে, সেগুলো মূলত চীন থেকে হরমুজ প্রণালি পর্যন্ত বিস্তৃত সি লাইনস অব কমিউনিকেশনের নিকটবর্তী আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, বেইজিং তাদের সীমান্তের কাছাকাছি ও দূরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে চাইছে। আর এ কাজে তারা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে চীন পাইপলাইন ও বন্দর নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চীনের লক্ষ্য জ্বালানি পরিবহনের ক্ষেত্রে কিছু কৌশলগত চেকপয়েন্টের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে যায়। এ ধরনের একটি চেকপয়েন্ট হলো মালাক্কা প্রণালি।

চীন প্রথম ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের ঘোষণা দেয় ২০১৩ সালে। এটি শি জিনপিং প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
পেন্টাগন বলছে, ওই সব সামরিক ঘাঁটিতে চীনা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আশ্রয়দাতা দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতে পারে। কারণ চীনা কর্মকর্তারা এটি ভালোভাবেই অনুধাবন করছেন যে তাদের এ সামরিক ঘাটি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আশ্রয়দাতা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুব জরুরি।
চীনের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য দেশের ভূখÐে এ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ফলে চীনা সেনাবাহিনীর শক্তিমত্তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গতি পাবে। এছাড়া কূটনৈতিক বিষয়ে নিজ দেশে পূর্বানুমান পাঠানো, অন্য দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করা, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনেও ভূমিকা রাখবে এটি। তারা আরো বলেছেন, সামরিক ঘাটি স্থাপনের ফলে মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর গোয়েন্দা নজরদারির সুযোগ পাবে চীন।

নিজ ভূখন্ডের বাইরে ২০১৭ সালের আগস্টে হর্ন অফ আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত জিবুতিতে প্রথম সামরিক ঘাঁটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে চীন। চীনা নৌবাহিনীর মেরিন সেনারা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছেন। তাদের কাছে সশস্ত্র সামরিক যান ও আর্টিলারি রয়েছে। কিন্তু নিজস্ব জেটি না থাকায় বর্তমানে তাদের নিকটবর্তী বাণিজ্যিক বন্দরের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। জিবুতির ওই ঘাঁটি থেকে চীনা সামরিক কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটের ওপর নজরদারি চালান। এছাড়া ওই ঘাঁটির ওপরের আকাশসীমায় অন্য কারো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থাও করে নিয়েছে তারা।

পেন্টাগন মনে করছে পিএলএ অনেকগুলো দেশেই নিজেদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাদের মধ্যে কয়েকটি দেশ বেইজিংয়ের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে পারে বলে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীনের হাতে এখন বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী রয়েছে। পাশপাশি তারা আগামী এক দশকের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উপস্থাপিত ওই বিশদ প্রতিবেদনে পেন্টাগন চীনের সামরিক শক্তির বৃদ্ধি সম্পর্কে তাদের সর্বশেষ মূল্যায়ন তুলে ধরে। সেখানে চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে একীভূত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মহাকাশ এবং বৈদ্যুতিব অস্ত্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এসবের মাধ্যমে চীনের সামরিক বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে চীনের ক্ষমতাবৃদ্ধি নিয়ে বেশ কিছু সতর্কবাণী শোনা গেছে। সেখানে চীনের নৌবাহিনীর শক্তি নিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আনা হয়। এতে বলা হয়েছে, এই মহূর্তে চীনের কাছে ৩৫০ টি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধ জাহাজ এবং সাবমেরিন রয়েছে। একইসাথে এই খাতে উত্তরোত্তর নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেই চলেছে বেইজিং। বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশ আমেরিকার কাছে এই মুহূর্তে ২৯৩টি যুদ্ধ জাহাজ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন এমনভাবে বিভিন্ন দেশে সামরিক সাজসজ্জা করছে যে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত থেকে তারা কোনও না কোনও রকমের হামলা করতে বা হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন তার পরমাণু অস্ত্র আধুনিকীকরন করছে এবং বাড়াচ্ছে।

সেক্ষেত্রে আগামী এক দশকের মধ্যে চিনের পরমাণু অস্ত্রেও সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের কাছে বর্তমানে ২০০ এর মত পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চিন সরকার আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা অনেক বেশি বাড়াবে। এটা আমেরিকার জন্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে ৩৮০০ ক্ষেপণাস্ত্র। তবে চীন এখন আকাশ, স্থল ও সাগরে পরমাণু হামলা চালাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন এরইমধ্যে জাহাজনির্মাণ, ভূমি-ভিত্তিক প্রচলিত ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ সামরিক সরঞ্জামাদি আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে আমেরিকার সমকক্ষ হয়েছে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে।

পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন বিস্ময়করভাবে ভূমিতে হামলার উপযোগী ক্রজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিপক্ষ হচ্ছে এগুলো। চীনে এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে প্রশান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম ঘাটিসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম হবে।
এ পরিস্থিতি ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে চুক্তি করতে আহŸান জানাচ্ছে।

তবে চীন তাতে সাড়া দেয়নি। চীন দাবি করছে, তাদের হাতে এতো অস্ত্র নেই যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসবে।
চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রও সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তি যেমন সাবমেরিন, দূরপাল্লার বোমা ও স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র আধুনিকায়নে আগামী ৩০ বছরে এক লাখ কোটি ডলার ব্যয় করবে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসন এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।

বস্তুত, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমরকৌশলের বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে । চীনের ক্ষমতাসীন পার্টির কড়া সমালোচক এবং ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা স্টিফেন কে ব্যানন বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে বর্তমানে আমরা তথ্যের উষ্ণ যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছি। চীন সরকার বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাই ব্যাননের মত একই মনোভাব পোষণ করেন। তারা চান, চীনের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান নিতে। তারা বলছেন, জিনপিংয়ের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনে চীনের দ্রæত উন্নয়ন ঘটছে এবং বেইজিং সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে