মোদির সর্বনাশা হিন্দুত্ববাদে সওয়ার কংগ্রেস

গোটা পৃথিবীতে এখন রামের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে দাবি করেন মোদি - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১০ আগস্ট ২০২০, ১৭:৫০

অবশেষে স্বমূর্তিতে আবিভর্‚ত হলেন ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তা কট্টর হিন্দু প্রচারককেও হার মানিয়েছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। শিবসেনার সাবেক কর্মী মোদি তো আসলে এরকমই। তবে কিছুটা অবাক করার বিষয় হচ্ছে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী কংগ্রেসও রামমন্দির ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদের পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছে। মোদির এই সর্বনাশা পদক্ষেপের পরিণতি নিয়েই আজকের আলোচনা।

শিবসেনার প্রচারক নরেন্দ্র মোদি যে কট্টর হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’, সে কথা কারও অজানা নয়। তিনি ২০১৪ সাল থেকে হিন্দুত্বের পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন, তাও নয়। কিন্তু হিন্দুত্বের প্রকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদেও স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ভূমিপূজা সেরে তিনি যে ভাষণ দিলেন, তাতে আবার সেই পুরনো কণ্ঠস্বর ফিরল। আবার যেন উত্তুঙ্গ হিন্দুত্বে সওয়ার হলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

বাবরি মসজিদ স্থানে ৫ জুলাই রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন মোদি। এ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বহু দিনের প্রতীক্ষা শেষ। এত দিন তাঁবুতে মাথা গুঁজে ছিলেন রামলালা বা শিশু রাম। এ বার তাঁর জন্য সুবিশাল মন্দির নির্মিত হবে। বহু শতক ধরে যে ভাঙা-গড়ার খেলা চলে আসছে, আজ রামজন্মভূমি তা থেকে মুক্ত হল। সরযূ নদীর তীরে সূচনা হল স্বর্ণযুগের।’

রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনটিকে স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘সারা দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। মন্দিরের জন্যও অনেকে বলিদান দিয়েছে। এত দিনে অপেক্ষা শেষ হল। ১৫ আগস্ট যেমন স্বাধীনতার প্রতীক আজকের দিনটি তেমনই ত্যাগ, সঙ্কল্প ও সংঘর্ষের প্রতীক।’

গোটা পৃথিবীতে এখন রামের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে দাবি করেন মোদি। তিনি বলেন, ‘আজ গোটা দেশ রামময়, রোমাঞ্চিত। পৃথিবীর সর্বত্র রামের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই রামমন্দির আমাদের সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতীক। সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে আসবেন। এই মন্দিরের মাধ্যমে বর্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগসূত্র স্থাপিত হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর থেকে আবার পুরনো মোদি ফিরতে শুরু করেন যাকে এক সময় গুজরাটের মুসলিম নিধনের হোতা বলা হয়। মোদি কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়ে সেখানে জংলী শাসন কায়েম করেছেন। মুসলিম তালাক আইন বাতিল করেছেন। নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আদালতকে ব্যবহার করে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ করছেন। এভাবে একের পর এক ইস্যুতে মোদি সরকারের অবস্থান কট্টর হিন্দুত্ববাদের ছাপ স্পষ্টতর করে তুলছিল। অযোধ্যায় মোদীর ভাষণে সেই সঙ্ঘবাদ সম্ভবত শিখর ছুঁয়ে ফেলল।

মোদি অযোধ্যায় বহু সময় ধরে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন। কোনো শীর্ষ রাজনীতিকের এভাবে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে ধর্মকর্ম পালননের কল্পনা করাও কঠিন। জীবনে প্রথমবার লোকসভায় নির্বাচিত হওয়ার পরে মোদি যেদিন সংসদ ভবনে পা রেখেছিলেন, সে দিন দরজার সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে প্রণাম করেছিলেন। বছর ছয়েকের ব্যবধানে আরও একবার সাষ্টা প্রণিপাত করলেন তিনি। এবার রামমন্দির স্থাপনকালে। প্রথমবার লোকসভায় ঢোকার সময়ে মোদিও পরণে ছিল কুর্তা-পাজামা। আর অযোধ্যায় পরেছিলেন সোনালি পাঞ্জাবি, ঘি রঙা ধুতি, গেরুয়া উত্তরীয়।

এ দিনের মঞ্চে হিন্দুত্বের ‘পোস্টারবয়’ হিসেবে শুধু নরেন্দ্র মেদি ছিলেন, তা কিন্তু নয়। হিন্দু নেতা মোহন ভাগবৎ ছিলেন, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ছিলেন। মোদীর মতো এঁরা দু’জনেও সুবক্তা হিসেবে খ্যাতিমান। কিন্তু ভারতের জাতীয়তা বোধ আর হিন্দুত্বকে অঙ্গাঙ্গী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা মোদি যেভাবে করলেন এ দিন, তাতে বাকিদের ভাষণ ম্লানই রয়ে গেল। পাঁচ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হিসাবে যখন ব্যাখ্যা করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন তার অন্তর্নিহিত বার্তা সম্পর্কে আর কোনও সংশয়ই রইল না।

ভারতের একজন রাজনীতিক বলেছেন ‘‘এটাও সুচিন্তিত পরিকল্পনারই অঙ্গ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রধান বা ঘোষিত হিন্দু সন্ন্যাসীকে দিয়ে ওসব কথা বলানোর তাৎপর্য কম। তাই স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে কথাগুলো বলানো হল। নতুন যুগের সূচনা হয়ে গেল ভারতীয় রাজনীতিতে। এ বার পরের ধাপের হিন্দুত্ব দেখার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মজার ব্যাপার হলো কংগ্রেস নেতারা বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে নিজেদের খাঁটি হিন্দু প্রমাণে। রামের প্রতি নিজের আস্থার কথা জানিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াংকা গান্ধী। ৫ জুলাই মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের পর রামনাম জপতে দেখা গেছে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকেও।

রামমন্দিরের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রিয়াংকা গান্ধী বলেন, ‘দীনবন্ধু রাম নামের সার কথাই হল সারল্য, সাহস, সংযম, ত্যাগ এবং প্রতিশ্রæতি। সকলের মধ্যেই রাম রয়েছেন, রাম রয়েছেন সকলের সঙ্গে। ভগবান রাম ও সীতা মায়ের আশীর্বাদে রামলালা মন্দিরের ভূমিপুজোর অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ব এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠুক।’ ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই গোটা পৃথিবীর সংস্কৃতির সঙ্গে রামায়ণের গভীর সংযোগ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতা কমলনাথ ভোপালে নিজের বাড়িতে এদিন হনুমান চালিশা পাঠের আয়োজন করেন। মন্দির নির্মাণের জন্য অযোধ্যায় ১১টি রূপার ইট পাঠাবেন বলেও জানান তিনি।

অনেকের মতে, বহুযুগ আগে থেকেই ‘নরম হিন্দুত্ববাদ’ নিয়ে চলছে কংগ্রেস। পার্থক্য শুধু একটাই যে, আগে প্রকাশ্যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলাত না তারা। অস্তিত্ব বিপন্ন দেখে এখন সেই রাস্তাই ধরতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তর থেকে দক্ষিণে একাধিক মন্দিরে ছুটে গিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার পর গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষেক হল প্রিয়াংকা গান্ধীর। সে সময় গঙ্গাযাত্রা সেরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে মির্জাপুরের বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে যান তিনি।

বাবরি মসজিদ নির্মাণের প্রায় ৪০০ বছর পর ১৯৪৯ সালে মসজিদের ভিতর মূর্তি রাখার দাবিতে সোচ্চার হয় উগ্র হিন্দুরা। এ নিয়ে পরিস্থিতি সংঘাতমময় উঠলে আদালতের নির্দেশে মসজিদটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মসজিদের বাইরে বসানো হয় পাহারা। মূর্তি পূজা-অর্চনার জন্য আদালত নিযুক্ত এক পুরোহিতেরই একমাত্র ভিতরে যাওয়ার অনুমতি ছিল সেই সময়।

১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দু’টি আসনে জয়ী হওয়ার পর রামমন্দিরকে হাতিয়ার করে নতুন রাজনৈতিক সফর শুরু করে বিজেপি। ওই একই সময়ে বিতর্কিত ওই জায়গার দখল পেতে আন্দোলনে নামে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ । ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর আন্দোলনে ভাটা পড়লেও ১৯৮৬ সালের শুরু থেকে ফের রামমন্দিরের দাবিতে সরব হয়ে ওঠে তারা। বিষয়টি আদালতেও গিয়ে পৌঁছায়।

সেই সময়ই কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হিন্দু পুণ্যার্থীদের জন্য মসজিদের দরজা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আগে সেখানে এক জন পুরোহিতের প্রবেশের অনুমতি ছিল। তখন থেকে সকল হিন্দুকেই ঢোকার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি মসজিদ চত্বওে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুমতিও দিয়ে দেন রাজীব গান্ধী।

২০১৯ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা রায় ঘোষণা হওয়ার আগে গোটা বিতর্কের জন্য রাজীব গান্ধীকেই দায়ী করেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি বলেন, রাজীব গান্ধীই বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়েছিলেন। তবে শুধু বিরোধীরাই নন, অযোধ্যায় ভূমিপূজার প্রস্তুতিত মধ্যে রামমন্দিরের কৃতিত্ব রাজীব গান্ধীর বলে জানান কংগ্রেস নেতা কমলনাথ। তিনি বলেন, ভুললে চলবে না রাজীব গান্ধীই রামমন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

হায়দরাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেন, এটা ভারতে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের পরাজয় আর হিন্দুত্ববাদের জয়। মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে মোদি শপথ ভঙ্গ করেছেন। মোদির দল ৪৫০ বছরের পুরনো মসজিদ ভেঙে সেখানে মন্দির বানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক বছরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে ভর করে বিজেপি যে জনপ্রিয়তায় পৌঁছে গিয়েছে, তাতে আর মধ্যপন্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় কংগ্রেসের পক্ষে। বরং এত দিন ধরি মাছ না ছুঁই পানি করতে গিয়েই অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তাদের। তাই কংগ্রেসের পথ যে হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা নয়, তা প্রমান করতেই এখন উঠেপড়ে লেগেছেন দলের নেতারা। নিজেকে পৈতেধারী ব্রাক্ষন বলে দাবি করতেও দ্বিধা করছেন না রাহুল গান্ধীও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে এবং হিন্দুত্ববাদকে পুজি করে মোদি ভারতের সর্বনাশ করে চলেছেন। তিনি স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। ভারতের গর্ব ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত ও দেশটির উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিচারিক পেশাদারিত্ব। মোদির শাসনে তা ধ্বংস হয়ে গেছে। হিন্দুত্ববাদী মোদির শাসনে ভারতের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। এবার অর্থনীতি ১০ ভাগ সংকুচিত হতে পারে বলে পূর্ভাবাস রয়েছে। ফলে ভারতে বাড়বে দারিদ্র আরও বেকারত্ব।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার আরতি জেরাথ বলেন, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে মোদি রামমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। মোদি কার্যত ভারতের ওপর সর্বময় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৭০ বছরের ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে মোদি ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করছেন। আরেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুহাস পালশিকার লিখেছেন, গত ১৫ মাসে মোদি পদ্ধতিগতভাবে ও নিষ্ঠুরভাবে সংবিধান বদলে দিয়ে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জঙ্গি সংস্কৃতি চালু করেছেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে