ভারত ও চীনে মুসলমানরা কেমন আছে

মুসলিম দলনে চীন পিছিয়ে নেই। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরকে ভারতভুক্তির তীব্র নিন্দা জানায় অথচ নিজেরা জিনজিয়াং-এর এক মিলিয়ন মুসলিমকে ধর্ম ভুলিয়ে নাস্তিক্যবাদে দীক্ষিত করতে বন্দী করে রেখেছে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৯ আগস্ট ২০২০, ১৬:৩৮

ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে এবার বেশ বিপাকে পড়েছে বিজেপি সরকার। একদিকে করোনা মহামারী সামাল দিতে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে, অন্যদিকে লাদাখ সীমান্তে চীনা বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে ২৪ জন সেনা ও সেনা-কর্মকর্তাকে হারিয়েছে। ফলে আভ্যন্তরিন পরিস্থিতি সামাল দিতে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রচারনা দেশটিতে জোরদার হয়েছে। অপরদিকে চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে চীন সরকার। আর তা নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বিশ্ব। ভারতও এখন এই ইস্যু সামনে আনার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ দুদেশে মুসলমানদের ব্যবহার করছে ফুটবলের মতো। এই দুদেশের মুসলমানদের চিত্র নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা এবং চীনের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জনআকাঙ্খা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এখন চীনের বিরুদ্ধে বাগযুদ্ধ বা কথার লড়াই শুরু করেছে। আর এর সাথে সুর মিলিয়েছে দেশটির মূলধারার ডানপন্থী মিডিয়া।

এই বাগযুদ্ধে অংশ নিয়ে কট্টর ডানপন্থী প্যারামিলিটারি গ্রুপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর শাখা স্বদেশ জাগরণ মঞ্চের এক নেতা বলেন, আমরা চীনকে আঘাত হানতে চাই অর্থনৈতিকভাবে। তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই যে পণ্য বেচে টাকা কামাতে চাইলে আমদের সেনাদের হত্যা করা চলবে না।

পাশাপাশি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে ''বয়কট চায়না'' ক্যাম্পেইনেরও ধুম চলছে। ভারত সরকার তাদের দেশে চীনের মালিকানাধীন ৫০টিরও বেশি অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। এর মাঝে আছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম টিকটক-ও।

দু'দেশের মধ্যে এই বাগযুদ্ধে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বেশ খুশিই মনে হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর লাগাম টেনে ধরায় তাদের ব্যর্থতার বিষয়টি এতে আড়ালে চলে যাচ্ছে বলেই ভাবছেন তারা। আসলে হচ্ছেও তা-ই।

অবাক ব্যাপার হলো, এই কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মাঠে ''পলিটিক্যাল ফুটবল'' হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মুসলিমরা, যারা কিনা এমনিতে উভয় দেশেই খুন-জখম-নির্যাতন-নিপীড়ন-বৈষম্যের শিকার। উভয় দেশই চেষ্টা করছে অপরের মুসলিম-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে প্রতিপক্ষের আন্তর্জাতিক খ্যাতি নষ্ট করতে।

গত ৭ জুলাই ভারতীয় টিভি অ্যাংকর অজয় কুমার প্রশ্ন তোলেন, চিকিৎসাক্ষেত্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চাহিদা মেটাতে চীন উইঘুর মুসলিম বন্দীদের বিভিন্ন অঙ্গ জোর করে কেটে নিচ্ছে কি না। বোঝাই যায়, প্রশ্নের ছদ্মাবরণে এটি আসলে গুরুতর একটি অভিযোগই। একই অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ''চীনের মুসলিমদের কোনো ধর্মীয় স্বাধীনতা নেই।

অজয় কুমারের এ তথ্যে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রæপ মুসলিম নির্যাতনের জন্য অনেক বার ভারতের নিন্দা করলেও অজয় কুমার ভারত ও কাশ্মীরে ভারত যে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, সে-কথা একবারও উল্লেখ করেননি। শুধু অজয় কুমার নয় ভারতের গনমাধ্যম কাশ্মীরে মুসলমানরা কিভাবে বন্দি জীবন যাপন করছে তা নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ।

ইনডিয়া টুডে ভারতের একটি জনপ্রিয় গনমাধ্যম। গত ৯ জুলাই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের বন্দীশালার ওপর একটি সেগমেন্ট চালায় 'ইন্ডিয়া টুডে'। তুর্কী বংশোদ্ভূত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ ভূখন্ডটিকে দখল করে চীন একে 'জিনজিয়াং' বানিয়েছে আর সেখানকার মুসলিমদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার হীন অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেগমেন্টটিতে এমন-কিছু দেখানো হয়নি, যা নতুন। গত দু' বছর ধরে মিডিয়াতে এসব বিষয় বার বার এসেছে। বলা চলে, সেগমেন্টটিতে 'নতুন বোতলে পুরনো মদ'ই পরিবেশন করা হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, ইন্ডিয়া টুডে কিন্তু নিজ দেশের একই অপকর্মের কথা অর্থাৎ ভারত সরকারও যে আসাম রাজ্যের মুসলিমদের জন্য বন্দী শিবির বানিয়ে চলেছে, সে-কথা একবারও বলেনি। বলেনি যে সরকার নতুন দু'টি আইন করে লাখ-লাখ মুসলিমকে 'বিদেশী' ও 'অনুপ্রবেশকারী' আখ্যা দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে এবং তাদের জন্য 'ডিটেনশন ক্যাম্প' বা বন্দী শিবির বানাচ্ছে। এসব বন্দী শিবিরের কোনো-কোনোটিতে একসঙ্গে তিন হাজার পর্যন্ত বন্দী রাখা যাবে।

মুসলিম-নির্যাতনের জন্য চীনকে দোষারোপ করলেও ভারতও যে তার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে চাইছে, তা আজ আর গোপন কিছু নয়। এক্ষেত্রে কেবল চীনকে দোষ দিয়ে ভারত ও তার মিডিয়া নিজেদের হিপোক্রোসিকেই স্পষ্টতর করে তুলছে মাত্র।

ভারতের ভেতরে মুসলমানরা অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিনত করা হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা দিন দিন কমে আসছে। শুধু বিফ বা গরুর মাংস খাওয়া বা পরিবহন করার অভিযোগ তুলে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এবারের ঈদ উল আজহাতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ধর্মীয় বা ব্যক্তি স্বাধীনতা হরনের এসব খবর ভারতের গনমাধ্যমে সচেতনভাবে আড়াল করা হচ্ছে। অথচ চীনের এমন ঘটনা তুলে ধরতে ভারতের মিডিয়ার আগ্রহেনর কোনো কমতি নেই।

ভারতের মিডিয়ার এই ভুমিকা নিয়ে ভারতের একজন পর্যবেক্ষক বলেন, আমাদের মিডিয়া চীনের এ দগদগে ঘা-টিকে উস্কে দিতে চাচ্ছে, যা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। এর আসল লক্ষ্য হলো কোভিড-১৯ মহামারী দমন এবং চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সরকারের ব্যর্থতা চাপা দেয়ার চেষ্টামাত্র। আজ যদি চীনে করোনায় হাজার মানুষের মৃত্যু না-ঘটতো তাহলে তারাও কাশ্মীরে ভারত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইন অমান্যের অভিযোগে সোচ্চার হতো। আসলে কতটা সোচ্চার হতো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ভারতীয় মিডিয়া চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগে মুখর, কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট সম্বন্ধে একেবারে চুপ। ওই রিপোর্টে বলা হয়, গত ফেব্রæয়ারি মাসে নয়া দিল্লিতে মুসলিম-বিরোধী যে সহিংসতায় ৫০ জনেরও বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়, তাতে বিজেপি নেতাদের উস্কানি ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতের গনমাধ্যমে তেমন কোনো আলোচনা নেই।

শুধু ভারত নয়, মুসলিম দলনে চীনও পিছিয়ে নেই। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরকে ভারতভুক্তির তীব্র নিন্দা জানায় অথচ নিজেরা জিনজিয়াং-এর এক মিলিয়ন মুসলিমকে ধর্ম ভুলিয়ে নাস্তিক্যবাদে দীক্ষিত করতে বন্দী করে রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হান জাতির লোকজনকে এনে জিনজিয়াং-এ পুনর্বাসিত করছে, যাতে কালক্রমে উইঘুর মুসলিমরা নিজ বাসভূমেই সংখ্যালঘু হয়ে যায়।

কাশ্মীরসহ সারা ভারতে হিন্দু মৌলবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত যদি চীনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, চীনের কিছু বলার কি মুখ থাকবে? না থাকবে না। ভারত ইতোমধ্যে এই কান্ড শুরু করেছে। কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা হরনের পর এখন কাশ্মীরের জন বিন্যাস পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করেছে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিকদের কাশ্মীরে ভূমি কেনার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কাশ্মীরের নাগরিকদের সেখানে চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ছিলো তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আবার চীনের জিনজিয়ায়ংয়ের চাইতেও কাশ্মীর একটি মিলিটারাইজড এলাকায় পরিনত করা হয়েছে। সেখানে মানুষ স্বাধীনতাকামী সন্দেহে প্রতিনিয়ত গুম হয়ে যাচ্ছে তরুনরা। জিনজিয়াংয়ের নারীদের ওপর নিপীড়নের খবর আগ্রহের সাথে ভারতের মিডিয়ায় স্থান পায়। অথচ ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চলমান সহিংসতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে হাজার হাজার নারী। সহিংসতায় খালি হচ্ছে অগণিত মায়ের কোল। স্বামী হারিয়ে স্ত্রী হচ্ছে বিধবা।

ভারতে দাঙ্গা। ছবি : ইন্টারনেট

 

সেখানে দ্রুতই কমে যাচ্ছে পুরুষের সংখ্যা। বাড়ছে বিধবাদের নীরব মিছিল। পুরুষ সদস্যহীন পরিবারগুলো পড়ছে চরম বিপাকে। এক রকম ভিখারির জীবন কাটাচ্ছে এসব নারী। দিল্লির ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইন্সটিটিউটের প্রধান জেসুইট পল ডি সুজা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে স্বামী হারিয়েছেন ৮ হাজারের বেশি নারী। তারা এখনও জানেন না, তাদের স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। সরকারি বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর হদিস মেলেনি।

তাদের দুঃখের সীমা নেই। কিন্তু তাদের দুঃখের কথা শোনারও কেউ নেই। স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারের এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এ ধরনের নারীদেরকে বলা হয় ‘আধা-বিধবা। ভাগ্যপীড়িত এসব নারী জানতে চান, তাদের স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। কিন্তু তাদের এ সামান্য অধিকারটুকুও পূরণ করার জন্য এগিয়ে আসছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

মোটের ওপর আজ এটা পরিষ্কার যে, চীন ও ভারত উভয় দেশই নিজেদের দ্বন্দ্বে মুসলিমদের 'পলিটিক্যাল ফুটবল' হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশ্বের আরো অনেক দেশেই কম-বেশি এ রকম ঘটনাই ঘটে চলেছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে