ভুল যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত

বিমান ক্রয়ের মাধ্যমে হয়তো ভারতের অর্থ ভারতে থেকে যাবে - দ্যা উইক ডটইন

  • মেহেদী হাসান
  • ১৫ জুলাই ২০২০, ১৯:৪৪

চীনের সাথে গালওয়ান উপত্যকায় সংঘাতের পর ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৩টি যুদ্ধ বিমান ক্রয় করতে যাচ্ছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে চীনের মোকাবেলায় ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে ভুল যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে। রাশিয়ার এসব মিগ-২৯ আর এসইউ -৩০ যুদ্ধ বিমান চীনের মোকাবেলায় তেমন কাজে আসবে না। বিশেষ করে এসইউ ৩০ যুদ্ধ বিমান উচু পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযুক্ত নয়।

চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় অতি উচু পাহাড়ি অঞ্চলে। ভারতের কাছে আগেই থাকা এসব বিমান যেখানে পাকিস্তানের সাথেই মোকাবেলা করতে পারছেনা সেখানে আরো এসব বিমান কিনে কিভাবে চীনের মোকাবেলা করবে ভারত তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবেলায় ভারতের অনেক উন্নত শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান দরকার। কিন্তু তা না কিনে কেন অনেক পুরনো মডেলের রাশিয়ান মিগ-২৯ বা এসইউ-৩০ বিমান কেনা হচ্ছে তা নিয়ে ভারতের ভেতরে বাইরে বিতর্ক চলছে।

ভারত ২০১২ সালে ১২৬টি ফ্রান্সের রাফালে যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে ফ্রান্স সফরের সময় ১২৬টি রাফালের পরিবর্তে মাত্র ৩৬টি রাফালে বিমান ক্রয়ে চুক্তি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে মিগ-২৯ আর এসইউ-৩০ এর পরিবর্তে রাফালে বিমান ভারতের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত আর ভাল পদক্ষেপ হতে পারতো। কিন্তু রাফালের মত পশ্চিমা শক্তিশালী বিমানের পরিবর্তে রাশিয়ান মিগ কেনার সিদ্ধান্তের পর কংগ্রেস আবারো সরব হয়েছে মোদী সরকারের সমালোচনায়।

রাশিয়া থেকে ভারতের মিগ আর এসইউ-৩০ বিমান কেনার সমালোচনা করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ফোর্বস বিজনেস ম্যাগাজিনে। এতে লেখা হয়েছে- ভারতের বিমান বাহিনীর নতুন যুদ্ধবিমান দরকার। গালওয়ান ভ্যালিতে চীনের সাথে রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘাতের আগেই তাদের নতুন শক্তিশালী যুদ্ধবিমান দরকার ছিল। আর হিমালায়ে সীমানা নিয়ে চীনের সাথে সাম্প্রতিক বিরোধের তার তাদের এ বিমানের প্রয়োজনীয়তা আরো তীব্র হয়। ১৫ জুনের ঘটনায় ২০ ভারতীয় সৈন্য নিহতের ঘটনা স্বীকার করেছে ভারত। তবে চীনের সৈন্য নিহত হওয়া বিষয়ে চীন কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

এ অবস্থায় ভারত ৩৩ টি যুদ্ধ বিমান ক্রয় এবং ৫৯টি বিমান আপগ্রেডের জন্য আড়াই বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের খবরে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো চীনের মোকাবেলায় তারা কোন ধরনের যুদ্ধ বিমান ক্রয় করছে।

ভারত রাশিয়া থেকে ২১টি মিগ- ২৯ যুদ্ধ বিমান ক্রয় করবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড থেকে ১২টি রাশিয়ান-মেড এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধ বিমানের অর্ডার করবে।

মিগ-২৯ বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্তে অনেকে বিস্মিত। তাদের প্রশ্ন যেখানে এ বিমান দিয়ে ভারত পাকিস্তানকে মোকাবেলা করতে পারে না সেখানে চীনের কাছে তাদের নিজস্ব তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের কয়েক ধরনের শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান রয়েছে। এ ছাড়া চীনের কাছে আরো অনেক ধরনের শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত মিগ ও এসইউ-৩০ বিমান দিয়ে কিভাবে চীনের মোকাবেলা করবে। ভারতের কাছে আগে থেকেই বিদ্যমান মিগ-২৯, মিগ-২১ বিমান নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। সম্প্রতি পাকিস্তানের সাথে আকাশ যুদ্ধে মিগ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভারতের গণমাধ্যমে একে বুড়ো মিগ হিসেবে অভিহিত করে। পুরনো এ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ভারতের অনেক পাইলট। ফলে কেউ কেউ একে বিধবা তৈরির বিমান হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অপর দিকে এসইউ-৩০ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো এ বিমান পাহাড়ী অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জ

ন্য উপযুক্ত কোনো যুদ্ধ বিমান নয়।

ভারতের কাছে বর্তমানে ২৭২টি এসইউ-৩০ এবং ৬৫টি মিগ-২৯ বিমান র

য়েছে। অনেক দিন ধরে ভারতের পরিকল্পনা আরো এসইউ-৩০ এবং মিগ-২৯ বিমান ক্রয় করা। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে তৈরি ৮৩টি তেজাস হালকা যুদ্ধ বিমান এবং ১৪৪টি বিদেশী মাঝারি শক্তির যুদ্ধ বিমান ক্রয় করা।

এসইউ-৩০, মিগ, তেজাস এবং বিদেশী মধ্যমমানের এসব যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের উদ্দেশ্য ভারতের বিমানবাহিনীকে ২৮ ফ্রন্ট লাইন স্কোয়াড্রন থেকে ৪০ ফ্রন্ট লাইন স্কোয়াড্রনে পরিণত করা। যাতে করে একই সাথে ভারত পাকিস্তান এ

বং চীনকে মোকাবেলা করতে পারে দুই ফ্রন্টের যুদ্ধে।

বর্তমানে ভারতের যুদ্ধবিমানের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান মিগ-২১, মিগ- ২৯, এসইউ-৩০, ফ্রান্সের মিরেজ ২০০০, ভারতীয় তেজাস আর যুক্ত রাজ্যের জাগুয়ার বিমান। মিগ -২৯, মিরেজ ২০০০, এসইউ-৩০,, তেজাস এগুলো চুতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান। ভারত ফ্রান্সের কাছে ৩৬টি বহুমুখী রাফালে যুদ্ধ বিমান ক্রয় চুক্তি করেছে। এরোস্পেস এবং এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে রাফালে,

এসইউ-৩০ এবং মিগ-২৯ এসব মধ্যম মানের যুদ্ধ বিমান।

ভারতের বিমান ক্রয়ের তালিকায় এখনো ব্যাপকভাবে মধ্যম মানের বিমানের নাম দেখে অনেকে হতবাক। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ টম কুপারের মতে রাশিয়ান এসইউ-৩০ কাগজে কলমে অনেক শক্তিশালী। বাস্তবে পশ্চিমা যুদ্ধ

বিমানের বিপরীতে এর সক্ষমতা এবং দক্ষতা অনেক কম।

টম কুপারের মতে রাশিয়ার মিগ বা এসইউ-৩০ কেনার চেয়ে ভারতের উচিত ছিল ফ্রান্সের রাফালে বিমান আরো বেশি ক্রয় করা। টম কুপার ভারতের নতুন এ যুদ্ধ বিমান কেনা বিষয়ে লিখেছেন ভারতের কাছে ২০০ থেকে ২৫০টি এসইউ-৩০ আছে। কিন্তু তারপরও প্রতিবেশি কোনো জঙ্গি ঘাটিতে হামলার ক্ষেত্রে আপনাদের প্রয়োজন প্রায় ৪০ বছরের পুরনো মিরেজ২০০০।

২০১৯ সালে ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে হামলা শুরু করে মিরেজ বিমানের মাধ্যমে। আর এ আকাশ যুদ্ধে ভারতের একটি মিগ-২১ বিমান বিধ্বস্ত হয়। আর ১৯৯৯ সালেও কাশ্মির নিয়ে সংঘাতে মিরেজ ভাল ভূমিকা পালন করে। রাশিয়ান যুদ্ধ বিমানের সাহায্যে কাশ্মিরের উচু পাহাড়ি এলাকায় হামলা চালাতে সমস্যায় পড়ে ভারত।

টম কুপারের মতে গত কয়েক দশকে রাশিয়ান তৈরি এসইউ-৩০ এর চেয়ে ভারতের জন্য মিরেজের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি ভাল। মিরেজের উন্নত সংস্করণ হলো রাফালে। ভারতের জন্য বর্তমানে ভালো পদক্ষেপ হতো অধিক পরিমানে রাফালে যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করা। কিন্তু তারা মাত্র ৩৬টি রাফালে যুদ্ধ বিমান সংগ্রহ করতে যাচ্ছে।

ভূমিতে নিখুত হামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে এসইউ-৩০ বর্তমানে অনেক পেছনে রয়েছে। তা ছাড়া চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই করতে হচ্ছে উচু পাহাড়ি এলাকায়। এসব উচু এলাকায় তাদের তৈরি করতে হচ্ছে সামরিক ঘাটি। কিন্ত উচু পাহাড়ি এলাকার এসব সামরিক ঘাটিতে এসইউ-৩০ বিমান পরিচালনা উপযুক্ত নয় কুপারের মতে।

হিমালয় অঞ্চলে অপারেশনের জন্য লাদাখের লেহতে রয়েছে ভারতের কুশন বাকুলা রিমপোচি বিমান ঘাটি। ভারতীয় আর্মি বর্তমানে লেহ এবং একটি সেনা ছাউনির মধ্যে রাস্তা নির্মমান করছে । আর লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরের এ রাস্তাই সম্ভবত বর্তমান চীন ভারত সংঘাতের কারন।

কুশক বিমান ঘাটির ৯ হাজার ফুট রানওয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ফিট উচু। কুপারের মতে এ ধরনের পরিবেশে এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান ভাল ভ‚মিকা পালন করতে পারে না। যদি একটি বিমান দুটি মিসাইল ছুড়তে পারে সেটাই খুশীর বিষয়। আর প্রতিবার অভিযান পরিচালনার পর এসইউ-৩০ বিমানের ডিস্ক ভেঙ্গে যায় এবং টায়ার বদলাতে হয়।

রাশিয়া থেকে ভারতের মিগ আর এসইউ-৩০ বিমান কেনার সমালোচনা করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ফোর্বস বিজনেস  ম্যাগাজিনে ফোর্বস
রাশিয়া থেকে ভারতের মিগ আর এসইউ-৩০ বিমান কেনার সমালোচনা করে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ফোর্বস বিজনেস ম্যাগাজিনে ফোর্বস

কুপার লিখেছেন, তবে এসইউ-৩০ এর চেয়ে মিগ-২৯ এর ভ‚মিকা পাহাড়ী লেহ অঞ্চলে কিছুটা ভাল। কিন্তু তারপরও বলার সুযোগ নেই যে, পুরনো এই মিগ-২৯ ভারতের জন্য কোনো ভাল পছন্দ। এগুলো পুরনো মডেল আর রাশিয়ান শ্রমিকরা এগুলো ঘষামাজা করবে ভারতের কাছে হস্তান্তরের আগে। এগুলো ভারতের বর্তমান প্রয়োজনের তুলনায় ঠিক উপযুক্ত যুদ্ধ বিমান নয় । অনেকের অভিযোগ চীনের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে খুশী করে পক্ষে রাখার জন্য ভারত রাশিয়ান এসব বিমান কেনার পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারে।

এসইউ-৩০ বিমান ক্রয়ের মাধ্যমে হয়তো ভারতের অর্থ ভারতে থেকে যাবে। কারন এসব বিমান ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করে। কিন্তু ভারত চাইলে ফ্রান্সের রাফালে বিমানও লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করতে পারত। আর সেটাই হতে পারত তাদের জন্য ভাল। অন্তত ২০১৯ সালে পাকিস্তানের সাথে আকাশ যুদ্ধের পর ভারতের এ শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। তাদের আরো বেশি রাফালে বা এ ধরনের যুদ্ধ বিমান কেনা দরকার ছিল।

মনমোহন সিং সরকারের সময় ২০১২ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনী ১২৬টি রাফালে বিমান ক্রয়ের জন্য বাছাই করে দরদাম ঠিক করার পর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে প্যারিস সফরের সময় ৩৬টি রাফালে বিমান কেনার ঘোষনা দেন। ফলে বাতিল হয়ে যায় ১২৬টি রাফালে বিমান ক্রয়ের আগের সিদ্ধান্ত। এ ঘটনায় তখন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তীব্র সমালোচনা করেন নরেন্দ্র মোদির।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে