ইসরাইলের ছায়া কাশ্মীরে

মিলিটারি লকডাউন এবং ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের প্রতিবাদে কাশ্মীরিরা - দানিশ ইসমাইল, রয়টার্স

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৭ জুন ২০২০, ২৩:১৬

১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান। কথা ছিল, এবার পাশাপাশি সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে সদ্যস্বাধীন দু'টি দেশ। কিন্তু মানুষের এ আশাবাদ দেখে সৃষ্টিকর্তা বুঝি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। নইলে এমন হবে কেন? ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের নিগড়ে বন্দী হয়ে থাকার পর জম্মু ও কাশ্মির গত বছর তার বিশেষ মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। মনে করা হচ্ছে, এখানেই শেষ নয়, সবে শুরু। নরেন্দ্র মোদির দিল্লি সরকার 'ইসরাইল মডেল' ব্যবহার করে কাশ্মীরীদের নিশ্চিহ্ন করার অপকৌশল নিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে। এ ধারায় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে 'বিশেষ মর্যাদা' প্রদান এবং সংবিধানের বেশ কিছু ধারা প্রয়োগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। একই সাথে বাতিল করা হয় সংবিধানের ৩৫এ ধারাও। এ ধারায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কিছু আবাসন অধিকার নির্ধারণ করা হয়, আবার পাশাপাশি তাদের কিছু সুরক্ষাও দেয়া হয়।

এই দুই ধারায় কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দাদের জমি কেনার এবং সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। এতে বহিরাগতদের কাশ্মীরে এসে ব্যবসা করায় এবং বড় কোনো ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাশ্মীরের ভূমি ও অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও নিষিদ্ধ করা হয়। এসবই কাশ্মীরীদের অধিকারের সুরক্ষা দেয় এবং দেয় একটা পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের 'রাজ্য' মর্যাদা বিলুপ্ত করে তাদেরকে জম্মু এবং কাশ্মীর ও লাদাখ - এ দু'টি ইউনিয়ন টেরিটরিতে রূপান্তরিত করা হয়। এর মানে দাঁড়ালো, তাদের আর আইন প্রণয়নের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো আইনসভা থাকবে না এবং নয়া দিল্লি চাইলে যখনতখন এ দু' অঞ্চলকে কেন্দ্রের শাসনে নিয়ে যেতে পারবে। 'রাজ্য' মর্যাদা বিলুপ্ত করার আগ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর ছিল ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। দু' টুকরো করায় তা-ও হারালো জম্মু-কাশ্মীর।

৩৭০ ধারা বাতিল এবং 'রাজ্য' মর্যাদা বিলুপ্ত করার ফলে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ এখন বৃহত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠীর অংশ এবং তাই ঐতিহাসিক কাল থেকে তারা যে বিশেষ সুবিধাটুকু ভোগ করে আসছিল, তা আর থাকছে না। তবে ক্ষমতা হারানোর আসল বেদনাটি এখনও টের পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাবে শিগগিরই।

৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু-কাশ্মীরের 'রাজ্য' মর্যাদা বিলুপ্ত করার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে ভারতের সংবিধানকে উপেক্ষা করে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, এমন একটি ব্যবস্থা নেয়ার আগে জম্মু-কাশ্মীরের আইনসভার মতামত নেয়া। কিন্তু তা করা হয়নি। গৃহীত ব্যবস্থাটিকে চ্যালেঞ্জ করে অনেক আবেদন পড়েছে আদালতে। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহু বার তার শুনানিও স্থগিত করেছে।

আসলে জম্মু-কাশ্মীরে ভারত সরকারের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বার্থেই বাতিল করা হয়েছে ৩৭০ ধারা। পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে ফুটে উঠছে তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। এর অংশ হিসেবে গত ৩১ মার্চ মধ্যরাতে জম্মু-কাশ্মীরে এক নতুন আবাসন নীতি ঘোষণা করে দিল্লি সরকার, যাতে শয়তানি চেহারাটি স্পষ্ট হয়।

নতুন এ নোটিফিকেশন অনুযায়ী যদি কেউ ১৫ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীরে বসবাস করে থাকেন অথবা সাত বছর ধরে লেখাপড়া করে থাকেন অথবা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা হিসেবে সব ধরনের সুবিধা লাভের যোগ্য বিবেচিত হবেন। এমনকি সরকারি চাকরিও পাবেন।

কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরে পুলিশ দেখে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন এই নারীরা। কিন্তু তবুও পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হয় তাদের। ছবি : দানিশ ইসমাইল, রয়টার্স
কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরে পুলিশ দেখে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন এই নারীরা। কিন্তু তবুও পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হয় তাদের। ছবি : দানিশ ইসমাইল, রয়টার্স

 

নোটিফিকেশনটি জারি করা হয়েছে এমন এক সময়, যখন কোভিড-১৯এর সংক্রমণ ঠেকাতে ভারতজুড়ে জারি করা হয়েছে লকডাউন। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরবাসীর কাছে এ লকডাউন যেন এক লকডাউনের ভেতরেই আরেক লকডাউন। তারা তো গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এক ধরনের লকডাউনের ভেতরেই আছে, যেখান থেকে তারা তাদের ক্ষোভ জানাতে পারছে না, সেখানে কি ঘটছে তা-ও জানছে না বাইরের কেউ। ২০১৯ সালের ওই লকডাউন ছিল অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক এবং নৈতিকভাবে ভ্রান্ত। এখন সেটিই হয়ে গেছে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় কৌশল বাস্তবায়নের মূল নীতি।
নতুন জারি করা আবাসন বিধিটি ধর্ম-বর্ণ-মতাদর্শ নির্বিশেষে কাশ্মীরী যুব স¤প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছে উদ্বেগ যে সরকারি চাকরিতে এতদিন তাদের একচেটিয়া অধিকার ছিল, তা আর থাকছে না। এখন এতে ভাগ বসাবে বহিরাগতরাও। এখানে সরকারই সবচাইতে বড় চাকরিদাতা। অথচ এই বসন্তে সরকার বেশকিছু নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে।

সরকারের এ পদক্ষেপ ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি করেছে যে, নতুন আবাসন আইনের সুযোগ নিয়ে বহিরাগতদের নিয়োগ দিতেই সরকার এ অপকৌশল নিয়েছে। জেঅ্যান্ডকে ব্যাঙ্কে ১,৪৫০ টি শূন্য পদে লোক নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া গত ২৭ ফেব্রæারি বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এরপর গত ২ জুন ১,৫৮০ টি শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ব্যাঙ্কটি। এবার এতে নতুন আবাসন আইনের সুবিধাপ্রাপ্ত বহিরাগতরাও আবেদন করতে পারবে।

করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর অন্যসব হাসপাতালে চিকিৎসাসঙ্কট থাকলেও হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু অঞ্চলের শ্রীনগর ও কাথুয়া জেলায় অস্থায়ী চুক্তিতে কয়েক শ' স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি এসবও দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ ছিল। কেননা, জম্মু ও কাশ্মীর 'রাজ্য' মর্যাদা হারিয়ে ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত হওয়ায় সেখানকার পাবলিক সার্ভিস কমিশনও বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশেষে গত মে মাসে একজন নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়।

বহিরাগতদের কাছে চাকরি হারানোর আতঙ্কের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে সরকারি চাকুরেদের বেতন, পদোন্নতি ইত্যাদি নিয়ে ন্যায় বিচার না-পাওয়ার ভয়। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের ৩০ হাজারেরও বেশি মামলা ঝুলে আছে। রাজ্য মর্যাদা হারানোর প্রেক্ষাপটে গত ২৯ এপ্রিল সেখানে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বিধি-১৯৮৫ বলবৎ করা হয়। জুন মাসে ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের জম্মু বেঞ্চ গঠনের কথা। এ ট্রাইব্যুনাল জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখের প্রশাসনিক মামলাগুলো দেখাশোনা করবে। প্রশ্ন উঠেছে, পর্বতসঙ্কুল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে স্থাপিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আসা কতটা সম্ভব হবে বিচারপ্রার্থীদের?

চাকরিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি এমন বৈষম্য গত কয়েক দশক ধরেই চলে আসছে। তাদের হয় কোণঠাসা করে রাখা হয়, নতুবা ডেপুটেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হালে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। এখন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোর বেশিরভাগই বহিরাগতদের দখলে। নতুন আবাসন নীতির তাৎক্ষণিক সুবিধাভোগী হচ্ছে হাজার হাজার হিন্দু ও শিখ, যারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে জম্মু নগরীর উপকণ্ঠে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল। এরা এখন খুব সহজেই জম্মু বা কাশ্মীরের 'বাসিন্দা' হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে 'স্থানীয়' হয়ে যেতে পারছে হাজার হাজার বেসরকারি চাকরিজীবী এবং ভারতীয় সেনাসদস্যও। তারা এখন জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা হিসেবেই সরকারি চাকরি পাবে।

শুধু চাকরি নয়, বহিরাগতরা এখন জম্মু ও কাশ্মীরে জায়গাজমি কিনতে, স্থায়ীভাবে বসবাস করতে এবং ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারবে। আগে স্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারতো কেবল স্থানীয়রাই। এখন ভারতের যে কোনো স্থান থেকে এসে জম্মু ও কাশ্মীরে জায়গাজমি কিনতে পারা যাবে। এ ব্যবস্থার ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদেরও ফিলিস্তিনীদের মতোই বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীরে আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা থাকতো, থাকতো চাকরিতেও। প্রফেশনাল কলেজগুলোতে নারীদের জন্য ৫০ ভাগ আসন সংরক্ষিত থাকতো। ১৯৫০ সাল থেকে সরকারি স্কুল-কলেজে লেখাপড়া ছিল অবৈতনিক। এসব সুবিধার সবই এখন বাতিল করা হয়েছে।

গত প্রায় ১৫০ বছর ধরে প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে রাজধানী জম্মু থেকে শ্রীনগরে সরিয়ে নেয়া হয়। এবার করোনা অতিমারীর অজুহাত দেখিয়ে তা-ও বন্ধ করা হয়েছে। যদিও দুই রাজধানী ছিল, বাস্তবে কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর থেকেই কাশ্মীরের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীনগরই।

ক্ষমতাকাঠামোতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নির্বাচনী এলাকা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যাতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মুর আসনসংখ্যা বেড়ে যায়। এছাড়া পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের ২৪টি আসন গত ৭০ বছর ধরে 'শূন্য' বলে গণ্য করা হতো। ১৯৪৭ সালে আজাদ কাশ্মির থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু ও শিখদের দিয়ে এবার ওসব আসন পূরণের ব্যবস্থা হচ্ছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে নোংরা খেলা। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিসহ বহু মুসলিম রাজনীতিক কারাগারের অন্ধকারে বন্দী। এ অবস্থায় দিল্লির পরোক্ষ মদদে দলছুট একদল লোক গঠন করেছে আপনা পার্টি নামে নতুন একটি দল। তবে জনসমর্থন পেতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে দলটি।

এভাবেই ইসরাইল যেমন পশ্চিম তীরে স্থানীয় অধিবাসীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে উপনিবেশিকীকরণ করেছে, একই মডেলে জম্মু ও কাশ্মীরেও স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষ করে মুসলিমদের উদ্বাস্তু করার নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি সরকারও। এ অবস্থায় কাশ্মিরীদের ভাগ্যে কী আছে, তা কেবল বিধাতাই জানেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে