মিশর বনাম তুরস্ক : লিবিয়ায় কে জিতবে

সিসি চাচ্ছেন, লিবিয়া সংকটে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি জড়িত হোক এবং তার উদ্বেগগুলো আমলে নিক - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৫ জুন ২০২০, ০০:০৯

মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসনের হুমকি দিয়েছেন। তার এ হুমকি মূলত তুরস্কের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছ, মিশর কী লিবিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর মতো অবস্থায় আছে? কিংবা তুরস্কের সঙ্গ মিশরের যুদ্ধ হলে কে জিতবে? সিসির হুমকি কতটা বাস্তবোচিত সেই বিশ্লেষন আজ আমরা তুলে ধরবো।

মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি দেশের বাইরে সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকতে তার দেশের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। লিবিয়ায় তুরস্কের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে সিসির এ হুমকি এলো। সিসি লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জিএনএ সরকারকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, তারা যেন বর্তমান রণাঙ্গনের সীমা অতিক্রম না করে।

লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছেন সিসি এবং তার মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও রাশিয়া। তবে জিএনএকে তুরস্কের সামরিক সহায়তার ফলে হাফতার বাহিনী সম্প্রতি একের পর এক পরাজয় বরণ করেছে। লিবিয়া সীমান্তে মিশরের একটি সামরিক ঘাঁটিতে জঙ্গিবিমানের মহড়া পরিদর্শনকালে সিসি তার সেনাবাহিনীকে আরও বলেন, মিশর লিবিয়ায় রাজনৈতিক সমাধান চায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন।

তুরস্কের নাম উল্লেখ না করেই তিনি বলেন, কাউকেই সির্তে ও জুফ্রা অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না। এটা আমাদের রেডলাইন। লিবিয়ার সঙ্গে মিশরের ১২০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

মিশর সির্তে ও জুফ্রাকে রেডলাইন ঘোষণার কারণ হচ্ছে দেশটির তেলক্ষেত্রগুলো মূলত এখানে অবস্থিত। এই এলাকাকে অন্তুর্ভুক্ত করে লিবিয়াকে দুই ভাগ করতে চায় মিশর। জবাবে লিবিয়ার জিএনএ সরকার বলেছে, সিসির এই হুমকি সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা শামিল। জিএনএন আরব লীগের একটি বৈঠকে অংশ নিতেও স্বীকার করেছে। জিএনএ বলেছে, তারা নিরপেক্ষ রাজনৈতিক মধ্যস্ততায় আগ্রহী। তবে কারো একতরফা হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। সির্তে ও জুফ্রাকে সিসির রেডলাইন ঘোষণার জবাবে জিএনএ বলেছে, সমগ্র লিবিয়ায়ই তাদের কাছে রেডলাইন।

এদিকে তুরস্ক বলেছে, হাফতার এবং তার মিত্ররা স্থায়ী অস্ত্রবিরতি চাইলে তাদেরকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সির্তে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। বর্তমানে সির্তে শহরে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে হাফতার ও জিএনএ বাহিনী। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কলিন বলেছেন, হাফতারকে আগে সির্তে ছাড়তে হবে। সিসি এর আগে হাফতারকে নিয়ে একতরফা অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিলে তুরস্ক তা নাকচ করে দিয়েছে। তুরস্ক বলেছে, এটা হাফতারকে রক্ষার শেষ চেষ্টা।

সিসি তুরস্ক ও লিবিয়ার বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিলেও বাস্তবতা বলছে, এটা অনেকটাই বাগাড়ম্বর। সিসির সমর্থিত মিলিশিয়ারা লিবীয় যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। এ কারণে তাকে সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলতে হচ্ছে। তবে লিবিয়ায় তুরস্ক সেনা পাঠানোর কথা কখনোই বলছে না। সেখানে সে দিচ্ছে সমরাস্ত্র।

মিশর লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে কিনা জানতে চাইলে দোহা ইন্সটিটিউট ফর গ্রাজেুয়েট স্টাডিসের কনফ্লিক্ট রিজোলিউশনের অধ্যাপক ইব্রাহিম ফ্রেইহাত আল জাজিরাকে বলেন, এমন চিন্তা অযৌক্তিক। সিসি এখন বহু নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নীল নদে ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাঁধ তার দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। সিনাইয়ে জঙ্গিদের দমন করতে পারেনি মিশরের সেনাবাহিনী। মিশরের অর্থনীতিও খুব খারাপ অবস্থায় আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাস সমস্যা।

তিনি বলেন, এ অবস্থায় লিবিয়ায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করার ঝুঁকি নেবেন না সিসি। তবে হ্যা লিবিয়ায় মিলিশিয়াদের সাহায্য দিচ্ছে মিশর বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু সেই মিলিশিয়ারা এখন পলায়নপর। মিশর এতোদিন মিলিশিয়াদের সমর্থনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। এবার সিসি তা জনগণকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন, এই যা। কারণ, মিশরের জনগণ সিসির ওপর অসন্তুষ্ট যে লিবিয়ায় তিনি হেরে যাচ্ছেন। আর সিসি তুরস্কের জয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি চেয়েছিলেন লিবিয়াতেও সিসি মডেল প্রতিষ্ঠা করতে। অধ্যাপক ইব্রাহিম ফ্রেইহাত বলেন, লিবিয়া নিয়ে এই সংকটে ন্যাটো রাশিয়া ও মিশরের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দিয়েছে। বিপরীতে লিবিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতির বিরুদ্ধে ন্যটো বা ট্রাম্প প্রশাসন কোনো কথা বলেননি।

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজের বিশেষ দূত গুমা আল হামাতি বলেন, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে মিশর তুরস্কের সমকক্ষ নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, লিবিয়া তুরস্কের সমর্থনে সেরাজ সরকারের উত্থান সিরি জন্য এক বিরাট দুঃস্বপ্ন। সিসি, আরব আমিরাত ও সৌদি জোট মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের ভয়ে শঙ্কিত। রাজনৈতিক ইসলামকে দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এই জোট। সিসি মনে করেন, লিবিয়ায় খলিফা হাফতারও হবে তার মতোই আরেক স্বৈরশাসক যিনি রাজনৈতিক ইসলামকে কঠোরভাবে দমন করবেন।

তুরস্ক সমর্থিত জিএনএ সরকার মিশরে স্থিতিশীলতা ফেরাতে চায়। সেখানে জিএনএ সরকার টিকে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে পৌছে যেতে পারে। তুরস্ক লিবিয়ায় জিএনএ সরকারকে টেকাতে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মিশরের সেনাবাহিনী অন্যতম বৃহত্তম হলেও তার সক্ষমতা পরীক্ষিতি নয়।

জেরুজালেম পোস্টে সেথ জে ফ্রানৎম্যান লিখেছেন, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে মিশর ও তুরস্ক প্রায় কাছাকাছি হলেও মিশরের সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে আরেকটি দেশে গিয়ে তারা কতটা সুবিধা করতে পারবে তা নিশ্চিত নয়। মিশরের সেনাবাহিনী সিনাইয়ে জঙ্গিদের সঙ্গেই পেরে উঠছে না বহু বছর ধরে।

বিপরীতে তুরস্কের সেনাবাহিনী এক ধরনের যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করছে তুর্কি সেনারা। সম্প্রতি সিরিয়ায় রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিয়ে সেখানে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে তুর্কি বাহিনী।

তুরস্কেও নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে এমনকি ফ্রান্স ও গ্রিসকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। এরকম একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে মিশরের সেনারা কয়েক দশকেও মুখোমুখি হয়নি। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক । এ সামরিক জোটে যুক্তরাষ্ট্রের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি তুরস্কের। ন্যাটোর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততাও মিশরের তুলনায় অনেক বেশি।

প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সিসি কেন তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করার হুমকি দিচ্ছেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, সিসি চাচ্ছেন, লিবিয়া সংকটে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি জড়িত হোক এবং তার উদ্বেগগুলো আমলে নিক। তবে ট্রাম্প প্রশাসন লিবিয়া নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়নি। অন্যদিকে সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, লিবিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ভালো বোঝাপড়া হয়ছে যা লিবিয়ায় নতুন যুগের সূচনা করবে। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলও তুর্কি সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তুরস্ক চাচ্ছে মেরকেল হাফতারের সমর্থক ফ্রান্স ও গ্রিসকে যেন থামায়।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় তুরস্ক। নয়টি দেশে এখন সামরিক ঘাটি আছে তুরস্কের। তুরস্কে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখছে তুরস্ক। শুধু তুরস্কেও সহায়তার কারণে কাতারকে দখল করার সৌদি ও আমিরাতের পরিকল্পনা ভেসে গেছে।

অন্যদিকে হাফতারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া বুঝতে পারছে যে লিবিয়া নিয়ে তুরস্ক ছাড় দেবে না । তাই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি তুরস্কে পূর্ব নির্ধারিত গুরুত্বপূর্ণ সফর বাতিল করেছেন। ওই সফরে লিবিয়া নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি লিবিয়ার রাশিয়ার উপস্থিতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন না দিলে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে মার্কিন বাহিনীকে বিপাকে ফেলতে পারে আঙ্কারা।

তবে কৌশলগত কারণে মিশর বেকায়দায় থাকলেও সিসির মতো সামরিক একনায়ক যে কোনো হটকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন। সিসির হাতে তামাক খেতে মরিয়া হয়ে আছে আমিরাত ও সৌদি আরব। এরই মধ্যে আমিরাত ও সৌদির অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমে সেরকম কিছু খবরও এসেছে।

যেমন লন্ডনভিত্তিক আরবি দৈনিক আল-আরাবি আল-জাদিদ মিশরের কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশেষ নৌ-কমান্ড গঠন করেছে। লিবিয়া উপকূলে তুর্কি স্বার্থে আঘাত হানবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে এই কমান্ড। খবরে বলা হয়েছে, যেসব পথে তুরস্ক লিবিয়ায় সামরিক সহযোগিতা পাঠায় সেগুলোকে বাধা দেওয়া হবে এই সামরিক স্কোয়াডের মূল লক্ষ্য।

বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, মিশরের নৌবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এরইমধ্যে ৫০ জন যোদ্ধা লিবিয়ার পূর্ব উপকূলের একটি নৌ ঘাঁটিতে ফিরেছে। ঘাঁটিটি তুরস্কের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। খবরে দাবি করা হয়, তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত উন্নতমানের সামুদ্রিক বোট সরবরাহ করবে। এসব বোট লিবিয়ার বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারের যোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তরের আগে মিশরের সামরিক বিশেষজ্ঞরা সার্বিক পরিস্থিতি তত্ত্বাবধান করবেন।

জেরুজালেম পোস্টে সেথ জে ফ্রানৎম্যান লিখেছেন, লিবিয়ায় সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মত অবস্থায় নেই মিশর। কারণ এতে লিবিয়ায় সঙ্গে বিশাল সীমান্তে মিশরকে ঝামেলায় পড়তে হবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন


বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে