নজর রাখছে পাকিস্তান বিমান বাহিনী

ছবি : পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ওয়েবপেজ থেকে - পাকিস্তান বিমান বাহিনী

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৪ জুন ২০২০, ২৩:৪৯

পাকিস্তান ও ভারত - এশিয়ার এ দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের বৈরিতা আজ কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ দু' দেশ এক দিনের জন্যও যেন শান্তিতে পাশাপাশি বাস করেনি। এখনও ছোট-বড় নানা ইস্যুতে তাদের মধ্যে খিটিমিটি থাকে এবং আছে। আছে দু' দেশের অস্ত্র প্রতিযোগিতাও। এ প্রতিযোগিতারই অংশ হিসেবে আগামী জুলাই মাসের শেষ দিকে চারটি স্টেট-অব-দ্য-আর্ট রাফায়েল জঙ্গি জেট বিমানের প্রথম ব্যাচের সরবরাহ পেতে যাচ্ছে ভারত। বহু বিতর্ক ও বিলম্বের পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ও ভারতের মধ্যে এসব বিমান বিক্রির চুক্তি হয়। সম্পাদিত চুক্তিমাফিক ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারত এ রকম ৩৬টি জঙ্গি বিমান পাবে। এর দাম বাবদ ফ্রান্সকে ভারতের দিতে হবে সাত দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ইউরো। ২০২২ সালের মে মাসের মধ্যে সবগুলো জঙ্গি বিমানের সরবরাহ সম্পন্ন হওয়ার কথা। মেতেওর মিসাইল এবং অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার স্যুইটসজ্জিত এসব রাফায়েল জঙ্গি বিমানের মালিক হলে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর অনুকূলে চলে যাবে।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন কর্মসূচির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে পাকিস্তান বিমান বাহিনী। কিন্তু আগ্রহ থাকলেও একই ক্ষমতাসম্পন্ন জঙ্গি জেট বিমান কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান তাদের দেশে তৈরী জেএফ-১৭ থান্ডার মাল্টিরোল জঙ্গি বিমানের সর্বশেষ সংস্করণের প্রতি নজর ফিরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নতুন জেএফ-১৭ ব্লক থ্রি জঙ্গি বিমানের একটি প্রটোটাইপ বা প্রতিরূপ প্রথম বারের মতো আকাশে ওড়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তার পর থেকে এটি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর লক্ষ্য, ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লক থ্রি জঙ্গি বিমানের এ ই এস এ রেডার ক্যাপেবল অনেকগুলো প্রটোটাইপ বা প্রতিরূপ নির্মাণ করা। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভবিষ্যতের যে কোনো যুদ্ধে এটাই ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিজয় ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হবে।

মিডিয়ার অসংখ্য খবর থেকে আভাস পাওয়া গেছে, ব্লক থ্রি-তে সংযোজন করা হবে চীনের পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র, যে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে চীনের গর্বের শেষ নেই এবং যার আওতা ভারতীয় বিমান বাহিনীর হাতে থাকা সকল ক্ষেপণাস্ত্রের চাইতে বেশি।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত যেমন নতুন অস্ত্র সংগ্রহে মনোযোগ দিয়েছে, পাকিস্তান বিমান বাহিনী এর বিপরীতে গিয়ে হাতে থাকা জঙ্গি বিমানবহরের উইপন সিস্টেম এবং সেন্সর আপগ্রেডেশনের প্রতি মনোযোগী হয়েছে। পাকিস্তানের এ কৌশল যে বেশ কাজে দিয়েছে তা ইতিমধ্যে প্রমাণও হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রূয়ারি দু' দেশের বিমান বাহিনী মুখোমুখি হলে এ প্রমাণ মিলে। ওই সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনী সাফল্যের সাথে কাশ্মীরে ভারতের আকাশসীমায় ঢুকে পড়তে এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি মিগ-২১ জঙ্গি বিমানকে ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়।

তবে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সেদিনের সাফল্য সত্ত্বেও যা সত্য তা হলো, ভারতীয় বিমান বাহিনীর রয়েছে জঙ্গি বিমানের এমন বহর, যা সংখ্যা ও প্রযুক্তিগত মান বিচারে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চাইতে অনেক বেশি ও উন্নত। এর মধ্যে আছে আকাশযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতো সুখোই এসইউ-৩০ এম কে আই এবং মিরেজ ২০০০ এর মতো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাল্টিরোল জঙ্গি বিমান। অন্যদিকে পাকিস্তানকে এখনও প্রধানত নির্ভর করতে হয় তাদের সীমিতসংখ্যক এফ-১৬ ফ্যালকন জঙ্গি বিমানের ওপর। তাদের হাতে আছে ৭৫টি এফ-১৬ জঙ্গি জেট বিমান এবং বেশ কিছু ভিন্টেজ ব্লক এ ভ্যারিয়েন্ট। তবে এর সবগুলো সেই ১৯৮০এর দশকের। ব্লক-১ ও ব্লক-২ ভ্যারিয়েন্টের কিছু ১০০-প্লাস জেএফ-১৭ এবং মিরেজ থ্রি জঙ্গি বিমানের একটি বড় বহরও পাকিস্তানের হাতে আছে। তবে তা-ও সেই ১৯৬০এর দশকের।

এসব পুরনো দিনের সরঞ্জাম নিয়ে কোনো আকাশযুদ্ধে ভারতের মোকাবিলা করা পাকিস্তানের জন্য বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পাকিস্তানের জন্য আরও উদ্বেগজনক হলো, ভারতীয় নৌবাহিনীরও রয়েছে আকাশযুদ্ধ চালানোর মতো আলাদা ব্যাপক অস্ত্রসজ্জা। কোনো সংঘাত শুরু হলে এ অস্ত্র দিয়েই তারা পাকিস্তানের শিল্প নগরী করাচিতে হামলা করতে সক্ষম। পাকিস্তান নৌবাহিনীর কাছে কোনো জঙ্গি বিমান নেই। আক্রান্ত হলে তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে বিমান বাহিনীর দিকে।

এ পরিস্থিতি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জন্য একটা বাড়তি ঝামেলা তৈরি করেছে। কেননা, তাদেরকে দীর্ঘ ঝুঁকিপূর্ণ পূর্ব সীমান্তে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর, একই সাথে দক্ষিণ উপকূলে পাল্লা দিতে হচ্ছে ভারতীয় নৌবাহিনীর আকাশ অস্ত্রের সাথে। এ সমস্যার সমাধান হতে পারে যদি পাকিস্তান নৌবাহিনী স্বল্প ব্যয়ে একটি অ্যারিয়াল স্ট্রাইক প্ল্যাটফর্ম হাতে পায়। পাকিস্তান তার বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা বুঝিয়ে বলে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের কাছ থেকে জে এইচ -৭ হেভি স্ট্রাইক ফাইটার পেতে পারে। যদি তা পাওয়া যায় তাহলে আকাশযুদ্ধে ভারতের সাথে পাল্লা দেয়ার সক্ষমতা বাড়বে দেশটির, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের রণাঙ্গনে।

ছবি : পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ওয়েবপেজ থেকে
ছবি : পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ওয়েবপেজ থেকে

 

পুরনো দিনের এয়ার ফ্রেম ব্যবহার করলেও জেএইচ-৭ বড় অভিযানের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। এটি প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালের দিকে এর অল্পকিছু সরবরাহ করা হয় চীনা গণমুক্তি ফৌজের বিমান বাহিনীকে। ২০০৪ সালে চীনের দেশীয় বিমান শিল্প খাত রোলস রয়েস স্পেই ইঞ্জিন নির্মাণে সক্ষমতা অর্জন করলে জেএইচ-৭এর উন্নততর সংস্করণ আসে এবং এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।স্নায়ুযুদ্ধকালে স্পেই ইঞ্জিনের ডিজাইন করেছিল ব্রিটিশরা। এর লক্ষ্য ছিল খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম একটি বিমান তৈরি করা, যাতে সোভিয়েত নেভিকে ঠেকানো যায়। তবে বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অঙ্গনে ব্রিটেনের প্রভাব যখন ক্ষীয়মান আর প্রতিরক্ষা বাজেটও যখন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন সোভিয়েত হুমকি মোকাবিলা করার মতো বড়সড় নৌবাহিনী পোষাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপরও ব্রিটেন চাইছিল নৌবাহিনীর জন্য জঙ্গি বিমান তৈরি করতে, যাতে করে ভবিষ্যতের কোনো সংঘাতে সোভিয়েত নৌবাহিনীকে অন্তত ঠেকানো যায়। এক্ষেত্রে স্পেই ইঞ্জিন বেশ কাজে দেয়। এ ইঞ্জিন পরে রাজকীয় বিমান বাহিনীর এফ-৪ ফ্যান্টম বিমানে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে এসব বিমান পায় আরও বেশি ওড়ার ক্ষমতা এবং স্বল্পতর টেক অফ ডিসট্যান্স।

দেখা গেল, স্পেই ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় কম আর এর সেফটি রেকর্ডও বেশ ভালোই। তবে সবচাইতে ভালো দিক হলো, এগুলোর ডিজাইন করা হয়েছিল মূলত খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার উপযোগী করে, যাতে শত্রূর নৌযানে থাকা রেডারে এর উপস্থিতি ধরা না-পড়ে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে জেট বিমানের ইঞ্জিনের অনেক উন্নতি ঘটলেও এখনকার বেশিরভাগ ইঞ্জিনই মাঝারি থেকে উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার উপযোগী করেই নির্মিত। শত্রূর রেডারকে ফাঁকি দেয়ার জন্য দীর্ঘ সময় নিচু দিয়ে উড়ে গেলে ইঞ্জিনের রেঞ্জ বহুলাংশে হ্রাস পায়।

এক্ষেত্রে বলা যায়, জেএইচ-৭ পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমব্যাট ডকট্রিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের ডকট্রিন হলো অ্যান্টি-অ্যাকসেস/এরিয়া ডিনায়াল বা এ২/এডি। এই এ২/এডি কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান উপাদান হলো পাকিস্তান নৌবাহিনীর তিনটি খালিদ শ্রেণীর সাবমেরিন। কোনো যুদ্ধে যদি ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি বন্দর অবরোধ করে, এগুলো দিয়েই তাদের ঠেকানো হবে। জেএইচ-৭ হাতে পেলে পাকিস্তানের আক্রমণক্ষতাও বাড়বে এবং করাচি বন্দরের কাছাকাছি হওয়ার আগেই ভারতীয় নৌবাহিনীকে থামিয়ে দিতে পারবে।

এছাড়াও জেএইচ-৭ তার আক্রমণের দীর্ঘ আওতা, বিপুল বহনক্ষমতা এবং শত্রূর রেডারকে ফাঁকি দিয়ে চলার ক্ষমতা দিয়ে পাকিস্তানের জন্য পরিণত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আকাশযানে, যাকে তারা ভারতের সংরক্ষিত পশ্চিম উপকূলে হামলার কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এ যুদ্ধবিমানটি পেলে তা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ - উভয় কাজেই লাগবে। এ বিমানের একটি উন্নত সংস্করণ এখন চীনা গণমুক্তি ফৌজের বিমান বাহিনীতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা জাহাজবিধ্বংসী চারটি দূরপাল্লার কেডি-৮৮/ওয়াইজে-৮৩ ক্ষেপণাস্ত্রসহ সাত টনেরও বেশি অস্ত্রসরঞ্জাম বহনে সক্ষম। এসব ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুর ১০০ মাইলেরও বেশি দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এ সক্ষমতা জেএইচ-৭ জঙ্গি বিমানকে দিয়েছে গেরিলা কায়দায় 'হিট অ্যান্ড রান' অর্থাৎ শত্রূ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আঘাত হেনে পালিয়ে যাওয়ার দুর্দমনীয় ক্ষমতা। এ ক্ষমতার সবচাইতে ভালো ব্যবহার দেখা গিয়েছিল ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ড যুদ্ধে। ওই যুদ্ধে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত একটি ফরাশি জঙ্গি বিমানের সাহায্যে ব্রিটেনের দু'টি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনী।

পাকিস্তানের কাছে জেএইচ-৭এর বিকল্প হলো তাদের হাতে থাকা ক্রূজ মিসাইল। তবে এ মিসাইল ব্যবহারের বেশ ঝুঁকিও রয়েছে। প্রথমত, এগুলোর অবস্থান শত্রূ নানাভাবে শনাক্ত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ তুঙ্গে উঠে যেতে পারে, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের দিকেও গড়াতে পারে।

পাকিস্তানের রয়েছে চীনের তৈরী এইচ-৫, জে-৬ ও এফ-৭ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা। কাজেই জেএফ-১৭ হাতে না-আসা পর্যন্ত আত্মরক্ষা ও আক্রমণের কাজে জেএইচ-৭ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। চীনারাও এ ধরনের জঙ্গি বিমান বিপুল সংখ্যায় বিক্রি করতে আগ্রহী। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে পাকিস্তানের জেট বিমান পাওয়ার আশা যখন একেবারেই শূন্য, তখন সদাউত্তেজনাপূর্ণ একটি অঞ্চলের দেশ হিসেবে তাদের বিমান বাহিনীর জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিকল্প হতে পারে জেএইচ-৭।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে