গালওয়ান ভ্যালি কী চীনের হাতে তুলে দিল ভারত

গালওয়ান উপত্যকা - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ জুন ২০২০, ২০:২০

লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে চীন-ভারত রক্তাক্ত সংঘর্ষ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, চীনা কোনো সৈন্য ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেনি। মোদির এ বক্তব্য ভারতে তীব্র বিতর্ক, বিরোধীতা আর সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিস্মিত ভারতের বুদ্ধিজীবী, ক‚টনীতিক, নিরাপত্তা আর স্ট্রাটেজিক কমিউনিটি। ভারতের অভ্যন্তরেই মোদির এ বক্তব্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অনেকে।

ভারতের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মোদির এ বক্তব্য সরাসরি ভারতের অবস্থান ও স্বার্থ বিরোধী । একই সাথে মোদির এ ঘোষণা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হলো- ভারত কি তাহলে গালওয়ান উপত্যাকা আর গালওয়ান নদীর মোহনা চীনের কাছে হস্তান্তর করেছে? চীনা সৈন্যরা যদি ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে তাহলে ভারতীয় সৈন্যরা কোথায় মারা গেল। চীনা সৈন্যরা যদি ভারতে প্রবেশ না করে থাকে তাহলে কি ভারতীয় সৈন্যরা চীনে প্রবেশ করেছিল? তাদের মতে মোদীর এ বক্তব্য চীনের পক্ষে শুধু নয় বরং লাদাখ নিয়ে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ ঘটনায় বৈধতা দেয়া হয়েছে চীনকে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অভিযোগ করেছে চীনা সৈন্য লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করেছে এবং স্ট্যাটাস কো বা স্থিতাবস্থা নস্যাতের চেষ্টা করছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকায় চীনা সৈন্যদের সাথে ভারতীয় সৈন্যদের সামনা সামনি লড়াইয়ে ২৩ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়েছে। ভারতের ভিন্ন ধারার অনলাইন দি ওয়্যার এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর দাবি সরকারের ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রীর দাবি যদি সত্য হয় তাহলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দাবি ভুল।

সীমান্ত সংঘাত কেন্দ্র করে গত ৫০ বছরের মধ্যে চীন -ভারত সম্পর্ক এখন সবচেয়ে খারাপ। সরকারের তরফে ১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠকের আহবান করা হয় লাদাখ পরিস্থিতি নিয়ে। এ বৈঠকে মোদী এই বক্তব্য দেন। যা ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করছে।

লাদাখ ঘটনার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্কর চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ইর সা

থে বৈঠকের পর একটি প্রেস নোট প্রকাশ করা হয়। ১৭ জুনের এই প্রেসনোটে বলা হয় ‘গালওয়ান ভ্যালিতে লাইন অব কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে একটি স্থাপনা নির্মানের চেষ্টা করে চীন। চীন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এ পদপেক্ষ গ্রহণ করে যা সরাসরি সংঘাত এবং হতাহতের জন্য দায়ী। বলা হয় চীনের এই পদক্ষেপে উভয় দেশের মধ্যে সমস্ত চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে। চীন যদি লাইন অব কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে অবকাঠামো নির্মান করতে চায় তাহলে এটা পরিষ্কার যে, চীনকে তাহলে ডি ফ্যাক্টো বর্ডার বা প্রকৃত সীমানা অতিক্রমের প্রয়োজন হবে।’

ওয়্যার বলছে গালওয়ানের ওপর চীনের দাবি দেশটির প্রকাশিত মানচিত্রের সাথে  সাংঘর্ষিক। পুরো গালওয়ানকে চীন নিজের দাবি করলেও তাদের মানচিত্রে পুরো গালওয়ান  অন্তর্ভুক্ত নেই
ওয়্যার বলছে গালওয়ানের ওপর চীনের দাবি দেশটির প্রকাশিত মানচিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। পুরো গালওয়ানকে চীন নিজের দাবি করলেও তাদের মানচিত্রে পুরো গালওয়ান অন্তর্ভুক্ত নেই

মোদির বক্তব্য পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এ প্রেস নোটের বিরোধী এবং সাংঘর্ষিক। গালওয়ান ঘটনার ঠিক পরপরই ১৬ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়- চীনের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে স্টাটাস কো পরিবর্তনের পদক্ষেপের ফলে সেখানে সামনা সামনি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে মোদীর এ বক্তব্য চীনের পক্ষে শুধু নয় বরং লাদাখ নিয়ে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ ঘটনায় বৈধতা দেয়া হয়েছে চীনকে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে এ বক্তব্যর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন ভারতীয় সৈন্যরা সফলভাবে চীনা সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়েছে।

দ্য ওয়্যার অনলাইনে প্রকাশিত দেভি পুরা মিত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় যখন বলে, চীন একতরফভাবে গালওয়ানে স্টাটাস কো পরিবর্তন করতে চেয়েছে তখন অবশ্যই ওই ভ‚খন্ড নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। হয় সেটা লাইন অব কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে পড়েছে অথবা তা এমন একটি এলাকা যেখানে ভারত এবং চীন উভয়ের সমান দাবি রয়েছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পশ্চিমের লাদাখ থেকে পূর্বের অরুনাচল প্রদেশ পর্যন্ত উভয়ের দাবিকৃত এ ধরনের ২৩টি এলাকা রয়েছে । এগুলো ‘এরিয়াস অব ডিফারিং পারসেপশন’ বা এডিপি নামে পরিচিত। কিন্তু গালওয়ান এ ২৩টি এডিপি এলাকার বাইরে। এখন পর্যন্ত চীন পুরো গালওয়ান উপত্যাকা তাদের নিজের বলে দাবি করছে। আর নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন, চীনা সৈন্য ভারতীয় ভ‚খন্ডে প্রবেশ করেনি তখন এটাকে স্ট্রাটেজিক কমিউনিটি শুধু ভুল হিসেবে দেখছে না বরং মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করছেন।’

সোজা কথায় নরেন্দ্র মোদীর এ কথার অর্থ দাড়ায় গালওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত বা গালওয়ানকে চীনের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

ভারতের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নরেন্দ্র মোদির শব্দ চয়নে। দ্য ওয়্যারকে বলেন, নরেন্দ্র মোদির এ বক্তব্য অ-বিবেচিত এবং ভ্রান্ত। তার এ বক্তব্য চীনের দাবি এবং আগ্রাসনকে স্বীকৃতি দেয়ার শামিল। চীনা সৈন্যরা যদি ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ না-ই করে থাকে তাহলে ভারতীয় সৈন্যরা কেন মারা গেল। আর তারা কোথায়ই বা মারা গেল। চীনা আর্মি ১০ জন্য ভারতীয় সৈন্য ধরে নিল কেন? তাহলে কি ভারতীয় সৈন্যরা চীনে প্রবেশ করেছিল? ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রাভিন সাভনি বলেন, চীনকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে এবং তা খুব তাড়াতাড়ি। তুষ্টিকে চীনারা ভারতের দুর্বলতা হিসেবে দেখছে যা তারা পুরোপুরি কাজে লাগাবে।

দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে -চীনা আর্মির ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডার মুখপাত্র ১৬ জুন অভিযোগ করেন ভারতীয় সৈন্য লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রন রেখা অতিক্রম করেছে এবং উসকানিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের এ অভিযোগের মানে হলো গালওয়ান উপত্যাকা তারা তাদের নিজের বলে দাবি করছে।

ওয়্যার বলছে গালওয়ানের ওপর চীনের দাবি দেশটির প্রকাশিত মানচিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। পুরো গালওয়ানকে চীন নিজের দাবি করলেও তাদের মানচিত্রে পুরো গালওয়ান অন্তর্ভুক্ত নেই। তাদের মানচিত্রে কয়েকশ মিটার কম রয়েছে গালওয়ান নদীর শাখা শিয়ক নদীর কাছে। এভাবে চীনা মানচিত্র অনুযায়ীও গালওয়ানের একটি অংশ লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রন রেখার ভারতীয় অংশে পড়েছে।

দি ওয়াইর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারত ও চীনের মধ্যে প্রকৃত সীমানা যথা নিয়ন্ত্রন রেখা কখনোই চিহ্নিত করা হয়নি। দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে সীমান্ত টহল এবং সীমান্ত বৈঠকের মাধ্যমে প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট সীমানা মেনে চলে। নিয়ন্ত্রন রেখায় যেসব এলাকার উপর উভয় দেশের দাবি সেসব এলাকায় উভয় দেশের সৈন্যরা প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হয়।

ভারতের সরকারি ভাষ্য হলো চীন যেখন এসব বিবদমান এলাকায় প্রবেশ করে সেটা অবৈধ প্রবেশ নয় বরং নিয়ন্ত্রণ রেখার লঙ্ঘন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবার সেটাও ব্যবহার করেননি। ভারতের দাবি ১৯৬২ সালে চীন যেসব এলাকা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে এখন তার বাইরের এলাকা তাদের বলে দাবি করছে। ১৯ জুন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে পুরো গালওয়ান তারা নিজেদের দাবি করেছে এবং তাতে দেখা যায় তারা তাদের ১৯৬২ সালের মানচিত্রের বাইরে গিয়ে এ দাবি করছে। অপর দিকে নিয়ন্ত্রণ রেখার চীনা অংশ সরকারিভাবে ভারতের অংশ। আকসাই চীনের ওপর থেকে ভারত তাদের দাবি প্রত্যাহার করেনি।

সর্বদলীয় বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী যখন বলেছেন, ভারতে কোনো চীনা সৈন্য প্রবেশ করেনি তার কয়েক ঘন্টা পরে দিল্লীর চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র একটি টুইট বার্তায় জানান কিভাবে ধাপে ধাপে গালওয়ানে চীনা সৈন্য অগ্রসর হয়েছে। গালওয়ান ঘটনা বিষয়ে একটি লিঙ্ক প্রকাশ করেন তিনি। এর শুরুতেই দাবি করা হয়েছে গালওয়ান উপত্যকা নিয়ন্ত্রন রেখা বা লাইন অব কন্ট্রোলের চীনা অংশে অবস্থিত।

দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কৌশলগতভাবে গালওয়ান উপত্যকা গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। ভারত নির্মিত দারবুক-শিয়ক-দৌলত বেগ ওল্ডি সড়কের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতা রয়েছে উচু এ গালওয়ান উপত্যকা থেকে। চীন অভিযোগ করে আসছে গত এপ্রিল থেকে ভারত গালওয়ান উপত্যকায় অবকাঠামো নির্মান করছে।

চীনের দাবি ৬ মে রাতে ভারতীয় সৈন্য নিয়ন্ত্রন রেখা অতিক্রম করে। তারা সেখানে দেয়াল নির্মান করে এবং টহল কাজে বাধা সৃষ্টি করে। এভাবে সেখানে প্রথম সংঘাতের সূচনা হয়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দাবি ভারত পরে সেখান থেকে সরে আসতে এবং অবকাঠামো ধ্বংস করতে রাজি হয়েছে। চীন আরো জানায় একমাস পরে ৬ জুন দুই দেশের কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ভারতীয় সেনা গালওয়ান নদীর মোহনা অতিক্রম করবে না।

এর মানে হলো চীন গালওয়ান এবং শিয়ক নদীর মোহনা পর্যন্ত তাদের দাবি বৃদ্ধি করেছে। আর এর খুব কাছেই ভারতের দৌলত বেগ ওল্ডি সড়ক।

অপর দিকে ৬ জুন বৈঠক বিষয়ে ভারত বলছে এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বাইরে ভারতের পক্ষ থেকে বিস্তারিত আর কিছ‚ বলা হয়নি এবং বলা হচ্ছে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে সংঘাত বন্ধ বিষয়ে।

চলমান চীন ভারত সংঘাতের আরেকটি কেন্দ্র হলো পাংগং টিসো লেক। আর এটা রয়েছে এডিপি তালিকায়। এ লেক পর্যন্ত বিস্তৃতি একটি পাহাড় যা ফিঙ্গার -৮ নামে পরিচিত সে পর্যন্ত ভারত নিজেদের দাবি করছে। ফিঙ্গার ৬ পর্যন্ত এর আগে ভারত টহল দিয়েছে। চীনের দবি লাইন অব কন্ট্রোল ফিঙ্গার -২ তে পড়েছে। কিন্তু চীন এবার ফিঙ্গার -২ পর্যন্ত নেমে এসেছে এবং ১০ ও ১১ মে রাতে সেখানে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে সংঘাত ঘটে। আর স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা গেছে সেখানে চীন অবকাঠামো নির্মান করেছে। নাথান রাসের অব অস্ট্রেলিয়ান স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটর এর প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন সেখানে ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো নির্মান করছে। ভারতের ভ‚খন্ডে নিয়মিত চীনা ট্রাক ও সৈন্যদের যাতায়াত চলছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে