ভারতের সঙ্গে চীন-নেপালের উত্তেজনা

চীন থেকে নেপালকে দূরে রাখতেও মরিয়া নয়াদিল্লি - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ মে ২০২০, ১৫:৫৬

প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে আবার সম্পর্কের অবনতি হলো ভারতের। মানস সরোবর পর্যন্ত তীর্থযাত্রা সফল করতে ভারতের নতুন সড়ক নির্মাণ নিয়ে ক্ষুব্ধ নেপাল। ওই সড়ক দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত বলে অভিযোগ তুলেছে কাঠমান্ডু। ভারতের সঙ্গে বিরোধ তৈরির পর নেপাল তাদের সীমান্তে শক্তি বাড়াচ্ছে। কাঠমান্ডু ভারতের পদক্ষেপের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। অন্যদিকে সিমিকে আবার চীনা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ভারতীয় সেনারা। এসব ঘটনা এমন সময় ঘটছে যখন করোনার সংকট নিয়ে ভারত হিমশিম খাচ্ছে। আজ থাকছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত।

নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর ধরেই ভালো যাচ্ছে না। সর্বশেষ ভিডিও কনফারেন্সে ধারচুলা থেকে চীন সীমান্তের লিপুলেখ পর্যন্ত রাস্তাটি উদ্বোধন করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তবে এই অঞ্চলকে তাদের বলে দাবি করেছে নেপাল। তিব্বত ও চীনের সঙ্গে এ পথের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে। ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ লিপুলেখ সড়কটি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ও তিব্বতের মালভূমি কৈলাস-মানস সরোবরের মধ্যে সংক্ষিপ্ত রুট। এটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। চীন ও ভারতের মধ্যে একটি একটি গুরত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট।

ধারচুলা থেকে চীন সীমান্তে লিপুলেখ পর্যন্ত হিমালয়ের ১৭ হাজার ফুট উচ্চতায় এই রাস্তাটি উদ্বোধন করা হয়। রাস্তাটি নির্মাণ হলে নয়াদিল্লির সঙ্গে তিব্বতের মালভূমিতে অবস্থিত সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাস-মানস সরোবরের দূরত্ব অনেকটা কমে যাবে। আগে মানস সরোবর যাত্রা সম্পূর্ণ করতে তীর্থযাত্রীদের তিন সপ্তাহ লাগত। কিন্তু নবনির্মিত ৮০ কিলোমিটার রাস্তাটির মাধ্যমে তা শেষ হবে মাত্র এক সপ্তাহেই।

তবে ভারতের নতুন সড়ক নির্মাণ নিয়ে ক্ষুব্ধ নেপাল। ওই সড়ক দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত বলে অভিযোগ তুলেছে কাঠমান্ডু। এবার পরিস্থিতি আরও জটিল করে ভারত-নেপাল সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করার কথা জানালেন নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গিয়াওয়ালি।

এক বিবৃতিতে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমান্তে এককভাবে ভারত কোনও পদক্ষেপ নেবে না বলেই আমরা আশা করছি। এছাড়াও, অতীতে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সীমান্ত মেনে চলবে নয়াদিল্লির বলে আমরা মনে করছি। তবে সীমান্তে আমাদের বর্ডার পোস্ট ভারতীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক কম। সীমান্তে আমাদের মাত্র ১২০টি চৌকি রয়েছে। তাই আমরা অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করার কথা ভাবছি।

তিনি বলেন, নেপালের জমিতে সড়ক তৈরি করে ভারত দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করছে।

নেপালের অভিযোগ, এ সড়ক উদ্বোধনের মাধ্যমে ভারত দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করছে। কারণ, ১৮১৬ সালের সুগৌলি চুক্তি অনুসারে মহাকালী নদীর পূর্ব দিকের অঞ্চলটি তাদের, যার মধ্যে পড়ে লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি এবং লিপুলেখ। তাই ‘নেপালের সীমানা’দিয়ে যে কোনো কাজ ভারত যেন বন্ধ রাখে। তবে কাঠমান্ডুর আনা সীমান্ত লঙ্ঘনসহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভারত।

ভারত নেপালকে নিজের মর্জিমাফিক চলতে বাধ্য করতে চায়। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
ভারত নেপালকে নিজের মর্জিমাফিক চলতে বাধ্য করতে চায়। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, উত্তরাখন্ডের পিথোরাগড় জেলায় ধারচুলা থেকে চীন সীমান্তে লিপুলেখ পর্যন্ত স¤প্রতি উদ্বোধন হওয়া রাস্তা পুরোপুরি ভারতীয় ভূখন্ডের মধ্যেই পড়ে। রাস্তাটি সেখানে আগে থেকে ছিল। ওই রাস্তাটি কৈলাসের মানস সরোবর যাত্রায় তীর্থযাত্রীরা ব্যবহার করে। এখন শুধু তীর্থযাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের যাতায়াত সুগম করতে সেই একই রাস্তা চলাচল উপযোগী করা হচ্ছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য নেপাল ও ভারত নিজস্ব পদ্ধতি বানিয়ে নিয়েছে। নেপালের সঙ্গে সীমানা নির্ণয়ের কাজ চলছে। অনিষ্পন্ন সীমান্ত ইস্যুগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক আলোচনা এবং নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আলোকে সমাধানের জন্য ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

নেপালের অঞ্চল দিয়ে ভারত কেন রাস্তা নির্মাণ করছে সে বিষয়ে জানতে কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে একাধিক মতবিরোধ রয়েছে নেপালের। ২০১৫ সালে লিপুলেখ পাসকে চীন ও ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক রুট ঘোষণা করে বিবৃতি দিলে তার প্রতিবাদ জানায় কাঠমান্ডু।

ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ এবং জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার পর ভারত তাদের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে কালাপানিকে ভারতীয় অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। এরপর থেকেই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সীমান্ত -বিবাদ তৈরি হয়। এ নিয়ে কড়া আপত্তি জানায় কাঠমান্ডু। নেপালে বিক্ষোভও হয় এ নিয়ে। যদিও ভারত বলে আসছে, ম্যাপে সবকিছু আগের মতোই দেখানো হয়েছে।

কালাপানির কাছে লিপুলেখ পাস ভারতের পশ্চিম সীমান্তের শেষ প্রান্ত বলে ধরা হয়। কিন্তু এই কালাপানি এলাকায় সীমান্ত নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। যদিও দুই দেশই দাবি করে কালাপানি তাদের ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত। ভারতের দাবি, কালাপানি উত্তরাখন্ডের পীথোরগড় জেলার অর্ন্তগত । নেপালের পাল্টা দাবি, তাদের দেশের ধারচুলা জেলার অভ্যন্তরে পড়ে এই কালাপানি।

ভারত ও নেপালের মধ্যে কয়েক বছর ধরে উত্তেজনা চলছে। ২০১৫ সালে দুদেশের সীমান্ত এলাকায় নেপালি পুলিশের গুলিতে এক ভারতীয় যুবকের মৃত্যুর পর সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

ভারত-সীমান্তে অঘোষিত অবরোধ চলতে থাকায় নেপাল প্রথম তাদের উত্তরের প্রতিবেশী চীনের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে। ২০১৫ সালে নেপাল তাদের নতুন সংবিধান অনুমোদন করে, আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সে দেশের ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এলাকার মাধেশিরা । যাদের পেছনে দিল্লির প্রছন্ন সমর্থন আছে বলে মনে করা হয়।

ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে নেপালের জনগনের মধ্যে ক্ষোভ আছে। রাজনীতিকররাও ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছেন। দেশটিতে ভারত বিরোধী হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করছেন, ভারত নেপালকে নিজের মর্জিমাফিক চলতে বাধ্য করতে চায়। চীন থেকে নেপালকে দূওে রাখতেও মরিয়া নয়াদিল্লি।

সিকিমে ভারত-চিন সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি উত্তর সিকিমের নাকুলায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশের সেনাবাহিনী। হাতাহাতি এবং ঘুষোঘুষিতে দু’পক্ষের বেশ কয়েক জন আহতও হন। তবে সংঘর্ষ বড় আকার ধারণ করতে পারেনি।

ভারতের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা দেশটির গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন , মুগুথাং পেরিয়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় নাকুলা সেক্টরে দু’পক্ষের প্রায় ১৫০ সেনার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তাতে চার ভারতীয় জওয়ান ও চিনা বাহিনীর সাত জন আহত হন।

তবে ভারত ও চিনা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৭-র আগস্টে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে প্যাংগং লেক এলাকায় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন দু’পক্ষের জওয়ানরা। ঘুষোঘুষির পাশাপাশি একে অপরকে লক্ষ্য করে পাথরও ছোড়া হয় সেখানে। ডোকলামে টানা ৭৩ দিন ধরে দুই দেশের সেনা যখন মুখোমুখি অবস্থান করছিল, ঠিক সেইসময়ই এই ঘটনা ঘটে। তাতে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে। তবে শেষমেশ শান্তিপূর্ণভাবেই অবস্থান উঠে যায়। ভারত সরকার সংসদে জানিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চীনা বাহিনী ১০২৫ বার ভারতের সীমান্ত লংঘন করেছে।

ভারত মনে করে সিকিম রাজ্যটি তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সিকিম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারত চীনের যে কোন আগ্রাসনের জবাব দিতে পারে।

চীন এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে বলেই সেখানে তাদের কৌশলগত অবস্থান জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়েছিল। তখন ভারতের বিশাল এলাকা চীন দখল করে নেয়। চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনার আরেকটি কারণ রয়েছে। তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা ভারতে বসবাস করছেন, যেটি চীন মোটেও পছন্দ করছে না। অপরদিকে নেপাল ও সিকিমের সাথে বাড়ছে চীনের ঘনিষ্টতা। যা ভারত নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখে থাকে। বিশেষ করে নেপাল চলে গেছে ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে। দেশটিতে বাড়ছে চীনের বিনিয়োগ। নেপাল-চীন সামরিক সর্ম্পক ঘনিষ্ট হচ্ছে। যা ভারতের জন্য উদ্বেগের।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে