চীন কী করে ভারতের দোস্ত থেকে দুশমন হলো

ভারত ও চীন সম্পর্ক নিয়ে একটি কার্টুন - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৯ মে ২০২০, ১৪:২৬

১৯৭৫ সালের পর চীন ও ভারতের সীমান্তে আর একটি গুলিও বিনিময় হয়নি। অথচ উভয়েই বিশ্বের সবচাইতে জনবহুল দু'টি দেশ। সামরিক খাতে প্রতি বছর উভয় দেশ ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকে। এ রকম দু'টি দেশের মধ্যে সংঘর্ষ, রক্তক্ষয়ই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি? অথচ কী অবাক কাণ্ড, ১৯৭৫ সালের পর দু' দেশের মধ্যে আর একটি গুলিও বিনিময় হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সীমান্তে উভয় পক্ষের মধ্যে ছোটখাট সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তা দেখে পর্যবেক্ষক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে, বৃহৎ এ দু' দেশ কি কোনো যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে?

এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে আমদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। প্রবীণরা ভালো বলতে পারবেন, একসময় চীন ও ভারতের মধ্যে ছিল গলায় গলায় দোস্তি। সে-সময় ভারতে প্রায়ই স্লোগান শোনা যেত, ''চীন-ভারত ভাই ভাই''। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় থেকে সেই 'ভাই ভাই' সম্পর্কটা হয়ে পড়ে দুশমনের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। সমস্যার সূত্রপাত হয় তখন, যখন তিব্বত দখল করার পর চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকেও নিজের এলাকা বলে দাবি করে। এভাবে যে সমস্যার শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়ায়। যুদ্ধে জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে চীন। তারা আকসাই চীনকে নিজ দখলে রাখলেও অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয় ভারতকে।

তারপর দু'দেশের সব নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ভারত-চীন সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বড়জোর হাতাহাতি, পাথর ছোঁড়াছুড়ি হয়, তার বেশি কিছু না। কেননা, ভারত ও চীনের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে যে, যতই মতভেদ হোক, সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে দেবে না কোনো দেশই। দু' দেশের মধ্যে এরকম সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, ফ্রন্ট লাইনে যেসব সেনা সদস্য মোতায়েন থাকবেন, তাঁদের কাছে কোনো রকম অস্ত্র থাকবে না। যদি সেনা র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী কোনো অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিয়ম হয়, তাহলেও তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনাসদস্যদের হাতাহাতি বা কুস্তি করার ভিডিও দেখা যায়, কোথাও গুলি বিনিময়ের ছবি দেখা যায় না। মজার ব্যাপার হলো, শক্তিশালী চীনের সাথে থাকলেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এরকম কোনো সমঝোতা বা চুক্তি নেই।

কিছুদিন আগে লাদাখে ভারত আর চীনা বাহিনীর মধ্যে একটা সংঘর্ষের একটা ঘটনা জানা গেছে। তবে এটা বরাবরের মতো হাতাহাতি বা পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে সীমিত ছিল না। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সংঘটিত এ ঘটনায় ব্যবহৃত হয় ভারী অস্ত্রও।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লিখেছে, ''ভারত-চীন সীমান্তের তিনটি সেক্টরই এখন উত্তপ্ত। গত ৫ মে থেকেই পশ্চিম ভাগে বা ওয়েস্টার্ন সেক্টরে লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাত চলছে। ‘ফিঙ্গার থ্রি’ ও ‘ফিঙ্গার ফোর’-এর মধ্যে রাস্তা তৈরির কাজে চীন প্রথম আপত্তি তোলে। একই সঙ্গে গালওয়ান ভ্যালির সঙ্গে সংযোগকারী রাস্তার কাজেও চীনের আপত্তি। ৫ মে রাতে পূর্ব লাদাখের প্যাঙ্গং লেকের কাছে ভারতীয় সেনার নজরদারি বাহিনীকে বাধা দেয় চীন। তার পর থেকেই ওই দু’টি এলাকায় দু’দেশের সেনা পরস্পরের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পূর্ব ভাগে বা ইস্টার্ন সেক্টরের উত্তর সিকিমেও এ মাসের শুরুতে দুই সেনাবাহিনীর সংঘাত বেধেছে। সাধারণত সেন্ট্রাল সেক্টরের উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের অংশ শান্ত থাকে। কিন্তু সেখানেও বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।''

উদ্বিগ্ন পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, তার মানে কি দুই দেশের মধ্যে সংযমের বাঁধ ভাঙ্গছে? সত্যিই যদি ওই ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে শান্তি বজায় রাখার যে ঐতিহ্য আছে দুই দেশের মধ্যে, তা কোথাও বোধহয় ভাঙ্গতে শুরু করেছে।
পর্যবেক্ষকরা আরো প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭৫ সালের পর যেখানে একটি বুলেটও বিনিময় হয়নি, সেখানে এখন কেন অশান্তির আগুন জ্বলে উঠছে?

এই 'কেন'র জবাব খুঁজতে চলুন যাওয়া যাক চীন-ভারত অমীমাংসিত সীমান্তের দিকে। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীরা গত মাসে কমপক্ষে চার বার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে। এর তিনটি হটস্পট ছিল বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলের লাদাখে। অন্যটি হয় নুকু লা পাস-এ, যে অঞ্চলটি ভারতের সিকিম রাজ্যের সাথে চীনের তিব্বতকে যুক্ত করেছে।

ভারত ও চীনের মধ্যে অ্যাকচুয়াল লাইন অব কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ হাজার ফুট ওপরে। এ অমীমাংসিত সীমান্ত কাশ্মির থেকে শুরু হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রলম্বিত। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর এই দীর্ঘ সীমান্তে দু'পক্ষের মধ্যে টুকটাক হাতাহাতি হলেও কোনো পক্ষই এলএসি অতিক্রম করেনি। কখনও তেমন কিছু ঘটলেও অপর পক্ষের হুঁশিয়ারি পেলেই সরে এসেছে।

তাহলে এখন এমন কী ঘটলো যে, দু'পক্ষ ফের একে অন্যের দিকে বন্দুক বাগালো? জানা যায়, এর সূত্রপাত ঘটেছে ভারতের একটি পদক্ষেপ থেকে। যে অরুণাচল প্রদেশকে চীন তার নিজের এলাকা বলে দাবি করে থাকে, সেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে ভারত সম্প্রতি নতুন একটি অ্যাকসেস পয়েন্ট খুলেছে। এতে তাদের সেনা ও সামরিক যান চলাচল সহজতর হবে।

এর আগে ২০১৭ সালেও দোকলাম মালভূমির অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়ে দু'দেশের মাঝে মাসব্যাপী টানাপোড়েন চলে। তার চাইতেও বড় কথা, চীন বরাবরই দাবি করে আসছে যে তার প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড ভারত দখল করে রেখেছে। এমন এক অবস্থায় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে চীনের চাইতে দুর্বল ভারত চেষ্টা করছে বিভিন্ন ফ্রন্টে তার সীমান্ত নতুন করে নির্ধারণ করতে। এ ক্ষেত্রে যখনই তারা চীনের মুখোমুখি হচ্ছে, তখনই দেশটির কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাহায্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছেন চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার কাছে।

ভারতের আশার আগুনে হাওয়া দিতে আমেরিকাও পিছ পা হয় না। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক একজন শীর্ষ মার্কিন নারী কূটনীতিকের কথায় তার আভাস মেলে। ওই কূটনীতিক বলেন, চীনের কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা দক্ষিণ চীন সাগরে যা করছে এখানেও তা-ই করতে চাইছে। যদি কেউ ভেবে থাকেন যে চীন কেবলই চাপাবাজি করছে, আসলে কিছু করবে না, আমি তাদের বলবো, দয়া করে একটু ইন্ডিয়ার সাথে কথা বলুন। তাহলে বুঝবেন, পরিস্থিতিটা কী।

ঠিকই বলেছেন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ মার্কিন নারী কূটনীতিক। পরিস্থিতিটা বোঝা দরকার। এ পর্যায়ে আমরা মনে করতে চাই, গত বছর ভারত তার একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের 'বিশেষ মর্যাদা' কেড়ে নিয়ে একে ভারতভূক্ত করে নেয়। প্রতিবেশী পাকিস্তান এ রাজ্যটিকে তার অংশ বলে দাবি করে থাকে আর পাকিস্তানের এ দাবিতে সমর্থন আছে চীনের। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। গত বছর কাশ্মীরে এক আত্মঘাতী হামলায় বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সেনা নিহত হলে দু' দেশ আবারও যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এ রকম সব ক্ষেত্রেই চীন ছিল এবং আছে পাকিস্তানের পাশে।

লাদাখ। চীন-ভারত বিবাদের ভূমি। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
লাদাখ। চীন-ভারত বিবাদের ভূমি। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

 

চীন-ভারত সম্পর্কের আরেকটি তিক্ত ইস্যু হলো তিব্বত। এ অঞ্চলটিকে চীন বরাবরই তার 'অবিচ্ছেদ্য অংশ' বলে দাবি করে থাকে। তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাই লামা ও তার বিপুলসংখ্যক অনুসারী চীনের এ দাবি মানতে নারাজ। তারা তিব্বতের স্বাধীনতা চায়। এ লক্ষ্যে তারা গঠন করেছে প্রবাসী সরকার। আর দালাই লামা ও প্রবাসী তিব্বত সরকারকে বছরের পর বছর আশ্রয় দিয়ে রেখেছে ভারত।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নেপালের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধ নিয়েও চীন-ভারত সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। বহু বছর ধরে নেপালের ওপর দাদাগিরি দেখিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে ভারত। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, এ নিয়ে কখনও উচ্চবাচ্য করেনি নেপাল। কিন্তু ভারতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্কে চিড় ধরে। এমনিতে নেপালীরা ভারতের সীমান্ত অবরোধের কথা ভুলে যায়নি, যে অবরোধের ফলে নেপালে জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। সেই দগদগে ঘা শুকানোর আগেই, কাশ্মীরের 'বিশেষ মর্যাদা' বাতিলের অল্পকাল পরেই ভারত সরকার তার সীমান্তের একটি নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে নেপালের কালাপানি এলাকাকে ভারত তার নিজের বলে দেখায়। ওই এলাকার আয়তনও একেবারে কম নয়, ৬২ বর্গকিলোমিটার।

চলতি মে মাসের গোড়ার দিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নেপালের ওই এলাকায় ভারতের নির্মিত একটি সড়ক উদ্বোধন করেন। নেপাল এর প্রতিবাদ জানালে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাবানে বলেন, এটা নেপালের নিজের কথা নয়, ''অন্য কারও'' কথা। ভারতীয় জেনারেল ''অন্য কারও'' নাম না-বললেও এটা যে চীন, সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

এ অবস্থায় রণহুঙ্কার দিচ্ছে ভারতও। সর্বশেষ খবর হলো, ২৭ মে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) ওপারে চীন সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন বাড়ালে ভারতও পাল্লা দিয়ে সেনা মোতায়েন বাড়াবে। ভারতের যে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ নিয়ে চীনা সেনা আপত্তি তুলেছে, সেই কাজও চালিয়ে যাওয়া হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৭ মে লাদাখের পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়ত ও তিন সামরিক বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার আগে মোদি ও রাজনাথ সামরিক বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়েছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে