ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ইসলামীকরণ

উইদোদো ও মারুফ আমিন - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৩ মার্চ ২০২০, ১৬:৪৭


বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় উত্থান ঘটছে রাজনৈতিক ইসলামের। দেশটিতে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতেও এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। মুসলিম ইস্যুতে সরব হয়ে উঠেছে জাকার্তা। কিভাবে ঘটল এই পরিবর্তন, নিউইয়র্ক টাইমস ও ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধের ভিত্তিতে তুলে ধরা হলো তার নানা দিক। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সাম্প্রতিক দাঙ্গায় মারা গেছে বহু মানুষ। এর প্রতিবাদে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাকার্তায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইনকে ঘিরে সৃষ্ট ওই দাঙ্গায় নিহতদের বেশিরভাগই মুসলিম।


ওই আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া অন্য দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে সুকৌশলে এর মাধ্যমে ভারতের মুসলিমদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতে বাস করে ২০ কোটি মুসলিম।


এ আইনের বিরুদ্ধে ভারতে নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। এর জেরে দিল্লির প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। এর আগে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার আকস্মিকভাবে দেশটির একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন তথা সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেয়। আন্তর্জতিক সম্প্রদায় এর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে ইন্দোনেশিয়াই অন্যতম প্রধান দেশ যেটি প্রকাশ্যে এবং কূটনৈতিকভাবে দিল্লির দাঙ্গার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার এই অবস্থানের পেছনে কাজ করছে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ইন্দোনেশিয়ার প্রধান দুটি মুসলিম সংগঠন নাহদাতুল উলামা ও মুহাম্মাদিয়া দিল্লি সহিংসতার তীব্র সমালোচনা করেছে। নাহদাতুল উলামা বিশ্বের বৃহত্তম ইসলামি সামাজিক সংগঠন। উদারপন্থী ইসলামের বিকাশে কাজ করছে সংগঠনটি। ভারতে শান্তি ফেরাতে ইন্দোনেশীয় সরকারকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। অন্যদিকে মুহাম্মাদিয়া বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলার দাবি জানায়। ইন্দোনেশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য। ইন্দোনেশিয়ার প্রধান দুটি ইসলামী সংগঠনের চাপে পড়েই কার্যত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে দিল্লি সহিংসতার প্রতিবাদ জানায় সরকার।

গত কয়েক বছরে ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে ইসলামী পরিচিতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালের জাকার্তার গভর্নর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নির্বাচনের আগে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গর্ভনর বাসুকি জাহাজা পূর্ণমা অশোকের ইসলামবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদে জাকার্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। দেশটিতে এর আগে এমন বড় বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি।

প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর দীর্ঘদিনের সহযোগী ছিলেন অশোক। ফোরইলেভেন ও টুটুয়েলভ নামের এই আন্দোলনের পর নির্বাচনে পরাজিত হন অশোক। এরপর ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ধর্মীয় বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন সেক্যুলার প্রেসিডেন্ট উইদোদো।

যেসব ইসলামী সংগঠন অশোককে পরাজিত করে, উইদোদো নির্বাচনে তাদের সঙ্গে জোট করেন । তিনি নাহদাতুল উলামার প্রধান এবং দেশটির অন্যতম ক্ষমতাধর আলেম মারুফ আমিনকে তার রানিংমেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। ফলে এই মুসলিম সংগঠনটির সমর্থন লাভ করেন উইদোদো। অন্যদিকে উইদোদোর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাভোয়ো সুবিয়ান্দোকে সমর্থন দেয় মুহাম্মাদিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।


সাবেক জেনারেল সুবিয়ান্তো একজন খ্রিস্টানের সন্তান এবং ইউরোপে শিক্ষিত হলেও জোরালোভাবে দেশটিতে ইসলামী শাসনের পক্ষে। তার দাপটে উইদোদো ডানপন্থার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ছিলেন উইদোদোর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। অবশ্য নির্বাচনের পর তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন উইদোদো।

ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসলামের এই প্রভাব দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতেও পড়েছে। ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব এই নিরিখেই দেখতে হবে। দেশটির রাজনীতিতে রক্ষণশীলতার এই উত্থান এবং বিদেশনীতিতে তার প্রভাব শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের অ্যাকশন টু ডিফেন্ড ইসলাম বা ‘আকসি বেলা ইসলাম’ নামের আন্দোলনের মাধ্যমে। ওই আন্দোলনেই অশোকের পতন ঘটে। ওই আন্দোলনের পর দেশটির বিদেশনীতিতে ইসলামীকরণের প্রথম প্রভাব দেখা যায় রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে।


এর আগে ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি রক্ষা করে চলতো। জাকার্তার কূটনীতির মূলে ছিল মানবিক সহায়তা। উইদোদো সরকার এর আগে দেশটির ইসলামপন্থী দলগুলোর উদ্বেগকে আমলে নিলেও মিয়ানমারকে ত্যাগ করেনি। তবে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার পর এই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে।


রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে আকসি বেলা ইসলাম ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভ করে। অন্যদিকে ইসলামী সংগঠনগুলোর জোট টুটুয়েলভ মুভমেন্ট ‘অ্যাকশন টু ডিফেন্ড রোহিঙ্গা’ বা ‘আকসি বেলা রোহিঙ্গা’ নামে দেশটিতে সিরিজ বিক্ষোভ করে। অশোকের বিরুদ্ধেও তারাই ছিল সোচ্চার।

তারা জাকার্তায় মিয়ানমারের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে। জাভার প্রাণকেন্দ্রে বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে আয়োজন করা হয় রোহিঙ্গা সংহতি সমাবেশ। জাকার্তায় ‘আকসি ওয়ান সিক্সটি নাইন’ নামের বিশাল বিক্ষোভে অনেক বিরোধী রাজনীতিকও অংশ নেন। এর মধ্যে প্রাভোয়ো সুবিয়ান্তোও ছিলেন।

অশোক বিরোধী বিক্ষোভ থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার রোহিঙ্গা সংকটে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় উইদোদা সরকার। এর আগে উইদোদো কখনও প্রকাশ্যে মিয়নামারের সমালোচনা করতেন না। কিন্তু এবার তিনি ভিন্ন পথ ধরলেন। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগেই সংবাদ সম্মেলন করে উইদোদো রাখাইনে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে পাঠান দেশটির নেত্রী অং সান সূচির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য।


এভাবে ইসলামপন্থীদের কারণে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আসছে। তবে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়া সরকার সরব হলেও চীনের উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরব রয়েছে। এটাকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যায় সরকার। দেশটির ইসলামপন্থী দলগুলোও এ ইস্যুতে ততটা সোচ্চা নয়। এর মূলে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ওপর চীনের প্রভাব।


নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উইদোদো মধ্যপন্থার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এক সময় দাঙ্গা থেকে খ্রিস্টানদের রক্ষা করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামী আইন চালুর দাবিতে সোচ্চার একটি সংগঠনকে তিনি নিষিদ্ধও করেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি মন্ত্রিসভায় নারীদের জায়গা দেন। ফলে তার বিজয়কে মধ্যপন্থী ইসলামের বিজয় হিসেবে দেখা হয়।  তবে গত নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বদলে যায়। তিনি আলেমদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। ভোটের প্রাক্কালে তিনি ওমরাহ পালন করেন।

আর তিনি যাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করেছেন সেই মারুফ আমিন ফতোয়া দিয়েছেন যে সমকামিতা হারাম এবং মুসলিমরা সান্তা হ্যাট পরতে পারে না। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কও হারাম।

ইসলামের জন্মভূমি থেকে ৫০০০ মাইল দূরে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইন্দোনেশিয়া প্রমাণ করেছে ইসলাম ও গণতন্ত্র সহাবস্থান করে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে। ইন্দোনেশীয় রাজনীতিক লুকমান হাকিম সাইফুদ্দিন বলেন, তার দেশের জনসংখ্যা ২৬ কোটি। ১৭ হাজার দ্বীপে বাস করে এই মানুষগুলো। এখানের এই বৈচিত্রময়তাকে মানুষ সম্মান করে।


আধুনিক সমাজে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে সারা বিশ্বেই আলোচনা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া জাতীয় পর্যায়ে ধর্মের ভূমিকাকে মেনে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির বেশিরভাগ মুসলিমের বেশভূষায় ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আরবের মত পোশাক আর আরবি নামের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সালাফি ইসলামের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। আমলারাও মসজিদমুখী।

সায়ারিফ হিদায়াতুল্লাহ স্টেট ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ধর্মতত্ত্ববিদ দ্বীন ওয়াহিদ বলেন, ইন্দোনেশিয়ার গ্রাম ও শহরে, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সালাফি মতবাদ শক্ত ভিত্তি গড়েছে। তারা দেখতে পাচ্ছে চারদিকে দুর্নীতি। মানুষ মনে করছে শরিয়াভিত্তিক শাসন চালু হলে সমাজ সঠিক ধারায় ফিরবে। জোকোর সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী সুবিয়ান্তো জিহাদের ডাক দিয়েছেন। জাকার্তার নাইটক্লাবে হামলার জন্য আলোচিত এবং স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা রিজিক সিহাবকে দেশে ফেরাতে চান সুবিয়ান্তো। শরিয়া আইনও বাস্তবায়ন করতে চান তিনি।


হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইন্দোনেশিয়া বিষয়ক গবেষক এবং ‘পিস, ইসলাম অ্যান্ড পাওয়ার’ গ্রন্থের লেখক অ্যান্ড্রেস হারসোনো নিউইয়র্ক টাইমকে বলেন, গত দুই দশকে ইন্দোনেশিয়ায় রাজনৈতিক ইসলাম ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

অশোকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল কারিগর ছিলেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মারুফ আমিন। অশোককে পরে ২০ মাস জেল দেওয়া হলেও উইদোদো তার পাশে দাড়াননি। নাহদাতুল উলামার গবেষক জুহাইরি মিসরাওয়ি বলেন, রাজনৈতিক নেতারা ভোট পেতে নিজেদের ধার্মিক হিসেবে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত।

তবে রাজনীতিক লুকমান হাকিম বলেন, সরকারিভাবে ইন্দোনেশিয়া ইসলামী রাষ্ট্র নয়। আবার একথাও সত্য যে দেশটি সেক্যুলার রাষ্ট্রও নয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে আরব ও ভারতীয় বণিকদের মাধ্যমে। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধ, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে। ফলে ইন্দোনেশিয়ার ইসলামের আলাদা এককটা বৈশিষ্ট্য ছিল। এখানকার কিছু মসজিদের নকশায় মন্দিরের প্রভাব ছিল। নারীদের পোশাকও ভিন্ন ধরনের।
তবে আশির দশকের শুরু থেকে দেশটিতে সৌদি অর্থ আসতে শুরু করে আর বদলে যেতে থাকে ইসলামের বাহ্যিক প্রকাশ। আগের ছাদবিহীন মসজিদের স্থানে গড়ে ওঠে সুদৃশ্য মিনার সম্বলিত মার্বেলখচিত মসজিদ। এসব মসজিদে সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতের স্থাপত্যশৈলি দৃশ্যমান।

১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার তিন দশকের স্বৈরশাসক সুহার্তোর পতন হলে দেশটিতে রক্ষণশীল ইসলামের বিকাশ ঘটে। এরপর প্রাদেশিক সরকারকগুলোর ক্ষমতা বেড়ে যায়। মানুষ ভোগ করতে শুরু করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার ফলে আচেহ প্রদেশে শরিয়া আইন প্রবর্তন করার সুযোগ পায় ইসলামপন্থীরা।