ইসলামের প্রতি মেসুত ওজিলের ভালোবাসা

-

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:৫০

দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। দাপটের সাথে খেলেছেন স্পেন ও ইংল্যান্ডের শীর্ষসারির ক্লাবে। তবে বিসর্জন দেননি স্বকীয়তা। বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে জার্মানির মতো দলের হয়ে খেলা ছাড়তেও দ্বিধা করেননি। আবার উইঘুর মুসলিমদের পক্ষে কথা বলে বাদ পড়েছেন ক্লাব থেকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে তার বন্ধুত্ব নিয়েও ঘোর আপত্তি পশ্চিমা বিশ্বের। তবু তারকা ইমেজ রক্ষার জন্য কখনও আপস করেননি। এমন একজন ফুটবলার মেসুত ওজিল।

২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানি দলের প্রাণভোমরা ওজিল। ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ আর আর্সেনালেও নিজের সময়ের সেরা তারকাদের একজন তিনি। সর্বশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপেও তার গায়েই ছিল জার্মানির ১০ নম্বর জার্সি; কিন্তু দৃঢ়চেতা মেসুত ওজিল নিজের ধর্ম আর সংস্কৃতির সাথে আপস করেননি। মুসলিম হওয়ার কারণে জার্মান ফুটবলে তার সাথে যে বিরূপ আচরণ করা হয়েছে তার প্রতিবাদেই ২০১৮ সালের মে মাসে জানিয়ে দেন জার্মানির জার্সি গায়ে আর তিনি মাঠে নামবেন না। বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদে ছেড়েছেন উজ্জ্বল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।

পেশাদার খেলোয়াড়দের সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও ধর্মপ্রাণ ওজিল তার ধার ধারেননি। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিশ্বে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন এই ফুটবলার। জার্মানরা পছন্দ করে না বুঝতে পেরেও পিতৃপুরুষের ভিটে তুরস্কের প্রতি টানের কথা কখনো গোপন করার চেষ্টা করেননি। ওজিল প্রায়ই বলেন, আমার ভেতর দুটি স্বত্ত্বা। ফুটবলের প্রতি টান, আর খেলার টেকনিক- এটি তুর্কি অংশ থেকে পাওয়া। আর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম এগুলো জার্মান ওজিলের।

১৯৮৮ সালে জার্মানিতে অভিবাসী হওয়া একটি তুর্কি মুসলিম পরিবারে জন্ম মেসুত ওজিলের। জার্মানির পরিবেশে বড় হলেও ওজিল পূর্ব পুরুষের দেশ তুরস্কের রীতি-সংস্কৃতিও হৃদয়ে ধারণ করেন প্রবলভাবে। সেই সাথে পারিবারিক পরিবেশেই শিক্ষা পেয়েছেন ধর্মচর্চার; জার্মানির একটি পত্রিকাকে নিজেই বলেছেন, মাঠে নামার আগে আমি কোরআন থেকে কিছু অংশ পড়ি। আমার টিমমেটরা জানে এই সময় আমার সাথে কথা বলা নিষেধ।কিন্তু এই বিষয়গুলোই শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাড়িয়েছে তার ফুটবল ক্যারিয়ারের পথে।

জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় গেলসেঙ্কিরিশেন শহরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ওজিলের। ওই শহরের কয়েকটি ক্লাবে অপেশাদার ফুটবল খেলেছেন কৈশোরে। এরপর ২০০৫ সালে সুযোগ হয়ে যায় সেখানকার নামকরা ক্লাব শালকে জিরো ফোরে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি দারুণ প্রতিভাবান এই ফুটবলারকে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে ক্লাবের যুবদলে খেলে দ্রুতই জায়গা করে নেন মূল দলে। এই ক্লাবের পারফরম্যান্স দিয়ে জায়গা করে নেন জার্মানির অনূর্ধ-১৭,১৯ ও ২১ দলে।

দুই দেশের নাগরিকত্বের কারণে তুরস্ক কিংবা জার্মানি- যে কোন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সুযোগ ছিলো ওজিলের। যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে ফুটবল শিখেছেন- সেই জার্মানিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ৩ বছর শালকে জিরো ফোর ক্লাবে খেলার পর ৫০ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় জার্মানির আরেক ক্লাব ওয়েরডার বারমেন। ২০০৯ সালে অনূর্ধ-২১ ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জেতে জার্মানি। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে হারানোর দিন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটি ওজিলের হাতেই উঠেছিল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে নরওয়ের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে অভিষেক তার সাদা-কালো জার্সিতে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের তৃতীয় ম্যাচেই পান গোলের দেখা।

২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে নজর কাড়েন তরুণ প্লেমেকার ওজিল। টুর্নামেন্টের গোল্ডেন বল পুরস্কারের ১০ জনের তালিকায়ও নাম ছিলো তার। বিশ্বকাপের পর ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যায় তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সবাইকে টেক্কা দিয়ে তাকে দলে ভেড়ায় স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। ট্রান্সফার ফি ছিলো দেড় কোটি ইউরো।

রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম মৌসুমেই ২৫টি গোলে অ্যাসিস্টের রেকর্ড গড়েন। পাশাপাশি নিজেও কয়েকটি গোল করেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা ডেল রে’র মতো আসরে। পরের মৌসুমে কোচ হোসে মরিনহো তার গায়ে তুলে দেন ১০ নম্বর জার্সি। ব্রাজিলিয়ান তারকা কাকাকে সরিয়ে ওজিলই হয়ে ওঠেন দলের মূল ভরসা। সেবার রিয়াল মাদ্রিদকে জেতান ৩২তম লা লিগার শিরোপা। নাম ওঠে ফিফা ব্যালন ডি অরের শর্টলিস্টেও।

টানা তিন মৌসুম দুর্দান্ত খেলেছেন রিয়ালের মাঝমাঠে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেন আর্সেনালে। এবার ট্রান্সফার ফি গোপন রাখা হয়। তবে সোয়া চার কোটি ইউরো বলে গুজব শোনা যায়। ইংল্যান্ডের ক্লাবটিতেও খেলছেন দুর্দান্ত। তিনটি এএফএ কাপ শিরোপা জিতিয়েছেন ক্লাবটিকে। আর্সেনালের সর্বোচ্চ বেতন পাওয়া ফুটবলারও তিনি। ক্লাবটিতে তার বেতন প্রতি সপ্তাহে সাড়ে ৩ লাখ ইউরো। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে বিরোধের কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে আর মাঠে নামা হয়নি ওজিলের।

২০১৪ সালে জার্মানিকে বিশ্বকাপ জেতানো ছাড়াও ২০১২ ও ২০১৬ ইউরোর সেমিফাইনালে তুলেছেন। মিডফিল্ডার হয়েও জার্মানির জার্সিতে ২৩টি গোল করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন শতাধিক। ক্লাবের হয়েও তার গোল ৬৫টি। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর ফুটবল কিংবদন্তী মিশেল প্লাতিনি ওজিলের খেলায় মুগ্ধ হয়ে তার জার্সি চেয়ে নিয়েছিলেন। সেবার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হিসেবে পাওয়া সব অর্থ ব্রাজিলের ২৩ গরিব শিশুকে দান করে আসেন ওজিল- যারা টাকার অভাবে জটিল অপারেশন করাতে পারছিল না।

তবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে জার্মানি প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়। যেটি ছিল এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন। আর এর জের ধরেই বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকেই থামিয়ে দিয়েছেন প্রজন্মের সেরা এই মিডফিল্ডার।

বিশ্বকাপের আগে লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের সাথে দেখা করার পর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। লন্ডনে সরকারি সফরে যাওয়া এরদোয়ানের সাথে একটি দাতব্য সংস্থার অনুষ্ঠানে দেখা করেন দুই তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল ও গুনদোয়ান। তারা এরদোয়ানকে নিজেদের জার্সিও উপহার দেন।

এরদোয়ানের সাথে ওজিলের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। এরদোয়ানের ফুটবল প্রেম কারো অজানা নয়। প্রথম জীবনে এরদোয়ানও ফুটবলার ছিলেন। তাই ওজিলের সাথে তার সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ।২০১৭ সালে ওজিল বিয়ে করেন মিস তুর্কি আমিন গুলসেকে। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্টলেডি।

কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে এই সুসম্পর্ক ভালোভাবে নেয়নি জার্মানি। অনেক দিন ধরেই জার্মানির সাথে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছিলো তুরস্কের। তাদেরই বিশ্বকাপ জয়ী এক তারকা তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে সেটি পছন্দ ছিলো না জার্মানির অনেক রাজনীতিকের। বিশ্বকাপে জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার পর সেটি চলে যায় নোংরামির পর্যায়ে। এর মূল কারণ যে ওজিলের ধর্ম ও তুর্কি শেকড় সেটি সহজেই বোঝা যায়। তাই এই আচরণের প্রতিবাদে জার্মানির হয়ে আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেন ওজিল।

২০১৮ সালের মে মাসে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা আমার সাথে যে আচরণ করেছে, তাতে সাদা-কালো জার্সি গায়ে তোলার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে। দলের হয়ে ভালো খেললেই আমি জার্মান, খারাপ করলে হয়ে যাই অভিবাসী’।

জার্মান দর্শকদের ভোটে রেকর্ড পাঁচবার দেশটির সেরা ফুটবলার নির্বাচত হয়েছেন; কিন্তু সেই ওজিলকে খোদ ফুটবল ফেডারেশন, জাতীয় পর্যায়ের অনেক রাজনীতিক তার তুর্কি শেকড় নিয়ে অনেক বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেছেন। ওজিল বলেছেন, ২০১৮ বিশ্বকাপে দল বাদ পরার পর থেকেই জার্মানির সংবাদমাধ্যম আমার তুর্কি শেকড় নিয়ে এমন সমালোচনা করেছে, যেন আমার ওই পরিচয়ের কারণেই দল প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে।

ওজিলের প্রতিবাদী চরিত্রের আরেক উদাহরণ পাওয়া গেছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর দেশটির কমিউনিস্ট সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হয়েছেন তিনি। টুইটারে একটি বড় পোস্ট দিয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। যেখানে তিনি উইঘুরদের ‘অত্যাচার প্রতিহতকারী যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি বলেছেন, ‘এই গৌরবময় বিশ্বাসীরা একসাথে লড়াই করে তাদের বিরুদ্ধে- যারা মানুষকে জোরপূর্বক ইসলাম থেকে সরিয়ে দিতে চায়।’

ওজিল ওই স্ট্যাটাসে আরো লিখেছেন, ‘সেখানে কোরআন পোড়ানো হচ্ছে..... মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে... ইসলামিক স্কুল, মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে....ধর্মীয় নেতাদের একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে.... এত কিছুর পরও সারা বিশ্বের মুসলিমরা নিরব রয়েছে’।

ওজিলের এই বক্তব্যের জোড়ালো প্রতিবাদ জানায় চীন। এমনকি চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পরদিন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে আর্সেনালের ম্যাচের সম্প্রচার বাতিল করা হয়। ক্লাবের স্পন্সর প্রতিষ্ঠানও ক্ষুব্ধ হয়। তবে ওজিল কখনোই নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। এই ঘটনার পর থেকেই আর্সেনালের সাথে ওজিলের সম্পর্ক খারাপ হয়। অনেক দিন একাদশের বাইরে থাকার পর ২০২১ সালের শুরুতেই তার আর্সেনাল ছাড়ার খবর আসতে থাকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।