কোকিলকণ্ঠী জেনিফার কেন ইসলাম গ্রহণ করলেন

ইসলাম গ্রহণের পর জেনিফার গ্রাউট - আলজাজিরা

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৪

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে এক নারীর নির্মল ও সুললিত কণ্ঠের কুরআন তেলাওয়াত। যেন প্রতিটি হরফ অন্তরের অন্তস্থল থেকে বেরিয়ে আসছে। গলার কারুকাজ দেখে পরিণত মনে হলেও খানিকটা শিশুসুলভ আবহ আছে। তেলাওয়াতের সময় তার শরীরী ভাষা ও চেহারায় এর প্রতিফলনের ছবি একেবারেই ভিন্ন, অন্যদের মতো নয়। মনে হবে, এ জগতে তিনি নতুন কেউ। এ তেলাওয়াত আপনাকে টেনে অন্যজগতে নিয়ে যাবেই! আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে, এ নারী কি মুসলিম? তিনি কি সদ্য ধর্মান্তরিত? কে তিনি?

তিনি ধর্মান্তরিত মুসলিম জেনিফার গ্রাউট। ইংরেজি ও আরবি গানে অভ্যস্ত। খ্রিস্টান পরিবারেই জন্ম। এখনও মুসলিম নাম ধারণ করেননি।

মহাকবি কায়কোবাদের ‘আজান’ কবিতাটি মনে আছে? ‘কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি / মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর / আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী / কি মধুর আযানের ধ্বনি!’ এই আজানের সুরই জেনিফারকে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি জানিয়েছেন, আজানের সুর তাকে অসাধারণ শক্তিতে সম্মোহিত করত, যা উচ্চাঙ্গ সংগীত তাকে কখনও করতে পারেনি।

জেনিফার গ্রাউটের জন্ম ১৯৯০ সালের ২১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায়। আরবি এবং অ্যামেজিগ সংগীতে খ্যাতি রয়েছে এ আমেরিকান গায়িকার। উচ্চাঙ্গ সংগীতে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার পিতা ড্যারিল গ্রাউট পিয়ানো বাজান, মা সুসান গ্রাউট বেহালাবাদক। পিতামাতার হাত ধরে তিনি ৫ বছর বয়সে সংগীত চর্চা শুরু করেন।

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আমেরিকায় হলেও ছোটবেলা থেকেই আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তার আলাদা টান ছিল। কিন্তু আরবের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র ছিল না। আরবের প্রতি শৈশবের টান পরিণত বয়সে তাকে আরবে আসতে বাধ্য করে। তিনি মরক্কো সফরে আসেন। ২০১২ সালে মরক্কো ভ্রমণের পর, জেনিফার গ্রাউট আরবি এবং অ্যামেজিগ সংগীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখানে আরবি গানের তালিম নেন। এরপর আরবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মিউজিক্যাল শো ‘আরব গট ট্যালেন্ট’-এ অংশ নেন। ২০১৩ সালে এ প্রতিযোগিতায় আরবি ভাষায় গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জেনিফারের একাধিক অ্যালবাম রয়েছে, বেশিরভাগ অ্যামেজিগ। এখন স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে নিউইয়র্কে আছেন তিনি।

২০১৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন এ মার্কিন গায়িকা। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি জানান, ইসলাম তার চোখ খুলে দিয়েছে এবং কোরআন সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে প্রতিনিয়ত তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেনিফার নিজের ইসলাম গ্রহণ নিয়ে বলেন, ইসলাম সম্পর্কে জানার চেষ্টার ফলেই আমার চোখ খুলে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার ভেতর বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। এমনটি আমার জীবনে আর কখনও ঘটেনি। এভাবেই ইসলামের দিকে আমার পথচলা শুরু।

একজন অনারব, যিনি আরবিতে নিজের পরিচয় দিতেও পারেন না, এমন একজন তরুণী ‘আরব গট ট্যালেন্ট’-এ আরবিতে গান গেয়ে হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করতে সমর্থ হন এবং অনারব নারী হিসেবে সর্বপ্রথম প্রসিদ্ধ এই মিউজিক্যাল শোর ফাইনাল রাউন্ডে পদার্পণ করেন। সেই জেনিফার ইসলাম গ্রহণ করার পরও সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়।

এর আগে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নাস্তিক। তার বিশ্বাস ছিল, ধর্ম কোনো উপকারে আসে না, বরং ক্ষতিই করে। জেনিফার বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণের জন্য আমি মসজিদে যাইনি, কোনো ইমামের সাহায্য নিইনি এবং কোনো দলিল-দস্তাবেজেও সই করিনি। তবে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা থেকে আমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি এবং ইসলামের হুকুম মেনে জাকাত দিই।’ তিনি বলেন, ‘এসব হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি অবশ্যই ইসলাম, কোরআন ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।’

ইসলাম ধর্মের প্রতি কেন আকৃষ্ট হয়েছিলেন জেনিফার? আলজাজিরার এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে মুসলমানের জীবনপ্রণালী, যা একটি মুসলিম দেশে সফর করার সময় দেখেছিলাম। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করার পর আমি মরক্কো সফরে যাই। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে সেখানে গিয়েছিলাম। পুরো গ্রীষ্মে মরক্কোয় ছিলাম। তখন যে বিষয়টি আমাকে প্রথম আকর্ষণ করে তা হলো আজানের ধ্বনি। যেখানেই যেতাম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান শুনতে পেতাম। আমি জানতে পারলাম, আজানের মাধ্যমে সবাইকে নামাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিষয়টি আমাকে আন্দোলিত করে। সত্যি বলতে কী, আজানের সুরই আমাকে প্রথম ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। আজান যেভাবে আমাকে আন্দোলিত করত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তা কখনও করতে পারেনি।’

আমি দেখেছি, অন্যের প্রতি মরক্কোর মানুষের বেশ সম্মানবোধ রয়েছে। তাও আমাকে স্পর্শ করে। আমি অনুভব করি, এখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মুসলিমদের রীতি-নীতির সম্পর্কে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ জন্মায় আমার ভেতর। জানতে থাকলাম। ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে পড়তে শুরু করলাম। কিছু পড়ার পর আল্লাহ, নবী-রাসুল ও ইসলামের সৌন্দর্য আমাকে বিস্মিত করল। ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে ঝুঁকে গেলাম এবং একপর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করলাম।

‘আরব গট ট্যালেন্ট’-এ অসাধারণ সাফল্যের পর হঠাৎ করেই অন্তত তিন বছর সব রকম সংগীত থেকে আড়ালে চলে যান তিনি। এ প্রতিযোগিতাকে আধ্যাত্মিক সফর আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, যখনই আপনার কোলে নতুন অতিথির আগমন হবে, স্বাভাবিকভাবেই আপনার জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তো সব কিছু গোছগাছ করার জন্য আমার একটি বিরতির প্রয়োজন ছিল। আর এই আড়ালে থাকার আরেকটি কারণ, যেন অর্থবহ একটি নতুন ও সুন্দর জীবনে প্রবেশ করতে পারি। আল্লাহর প্রশংসা, আমার বিশ্বাস, আমি লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

কোরআন তেলাওয়াত শুনে ভক্তরা জেনিফারের কণ্ঠকে ঐশীস্বর আখ্যা দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। আমি মিসরের বিখ্যাত কারি শায়খ সিদ্দিক আল মিনশাবির তিলাওয়াত খুব বেশি শুনি। সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী তিলাওয়াতে তিনি অদ্বিতীয়। মিনশাবির কণ্ঠে সুরা ইউসুফ ও সুরা তাকবীর শুনতে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। তাকে অনুকরণের চেষ্টা করি।

তাকে প্রশ্ন করা হয়, সবচেয়ে পছন্দের জায়গা কোনটি, যেখানে বারবার যেতে মন চায়? জেনিফার বলেন, মক্কা-মদিনার চেয়ে আমার কাছে বেশি প্রিয় আর কোনো জায়গা নেই। মক্কায় পবিত্র কাবা শরিফ জিয়ারত করাই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর সময়।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমি ইসলামকে বেছে নেইনি; বরং ইসলামের সৌন্দর্যই আমাকে টেনে নিয়েছে।’ এক ব্রিটিশ সম্প্রচার সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত এই গায়িকা খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রসঙ্গে নিজের অনুভূতি জানিয়ে একথা বলেন। জেনিফার গ্রাউট জানান, ইসলাম গ্রহণের আগে অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তেমন ঝোঁক ছিল না তার।

তিনি বলেন, আমরা এমন এক জীবন প্রণালী অনুসরণ করি, যেখানে বাহ্যিক বিষয়সমূহকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে এবং সর্বোপরি একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের আত্মার উন্নতি নিয়ে কাজ করা উচিত। তিনি মনে করেন, আমরা সত্যিকার অর্থে কেমন, এটা শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন। এজন্য আমরা কারও বাহ্যিক দেখে তার ভালোমন্দ বিচার করতে পারি না।

মরক্কোর যুবক সাঈদ জেনাতি ও জেনিফারের সংসারে ‘কমর’ নামের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ‘কমর’ শব্দের অর্থ চাঁদ। জেনিফার বলেন, ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে আগে থেকেই এই সুন্দর নামটি আমি মেয়ের জন্য পছন্দ করে রেখেছিলাম। আমার মেয়ের মুখ আমার কাছে চাঁদের মতোই উজ্জ্বল ও সুন্দর। যখন আমার মেয়েকে গর্ভে ধারণ করি, তখনই সিদ্ধান্ত নিই, যদি আমার মেয়ে হয়, তবে তার নাম ‘কমর’ রাখব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জেনিফার গ্রাউটের কুরআন তেলাওয়াত ও আরবি গানের বিপুল ভক্ত রয়েছে। আলজাজিরা মোবাশের-এর ইউটিউব চ্যানেলে তার সুরা ফাতিহা তেলাওয়াতের যে ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, তা এক বছরে ভিউ হয়েছে এক কোটির কাছাকাছি। নিজের চ্যানেলসহ অসংখ্য যোগাযোগমাধ্যমে তার কুরআন তেলাওয়াতের অসংখ্য ভিডিও রয়েছে, যেগুলোর ভিউ, লাইক ও কমেন্ট হু হু করে বাড়ছে। তার গানের ভক্তের চেয়ে তেলাওয়াতের ভক্তের সংখ্যা অনেক বেশি।

জেনিফার গ্রাউটের গানের সুরে একসময় বুঁদ হয়ে থাকত লাখো তরুণ। রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে তার ভক্তদের শ্রেণিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তার ফেইসবুক ফলোয়ার কিংবা ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তার পরিবর্তিত জীবনকে উৎসাহিত করতে।

পশ্চিমা আবহ থেকে এখনও হয়তো পুরোপুরি উঠে আসতে পারেননি জেনিফার। শৈশব থেকে যার মস্তিষ্কে পিয়ানো ও বেহালার শিকড় জন্মেছে, তার চিহ্ন কি সহজেই মুছে যাবে! তবে তার মেধা ও মননে বদলের যে ঢেউ লেগেছে, তা হয়তো তাকে আজীবন ডুবিয়ে রাখবে। তিনিও তার তেলাওয়াত ও আরবি গানের সুরে সম্মোহিত করে রাখবেন ভক্তদের।