আয়া সোফিয়ায় বাঁধভাঙা আবেগ

জুমার নামাজে সমবেতদের আবেগ ঢেউ তুলেছিলো - রয়টার্স

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ০৫ আগস্ট ২০২০, ১৮:২৪

একটি আবেগ চাপা ছিলো ৮৬ বছর ধরে। গত শুক্রবার সেই চেপে রাখা আবেগ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে পাথর। তারপর নেমেছে বাঁধভাঙা স্রোত।

তুরস্কের ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়াকে খুলে দেওয়া হয়েছে নামাজের জন্য। এখন এই স্থাপনাটি পুরোদস্তুর মসজিদ। এর আগে ছিলো জাদুঘর। তারও আগে ছিলো মসজিদ। এবং তারও আগে এই স্থাপনাটি ছিলো রোমান ক্যাথেড্রাল। ১৪৫৩ সালে কনস্টানটিনোপল বিজয়ের পর নিজের খরচে খৃস্টানদের থেকে ক্যাথেড্রালটি কিনে নেন সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ। পরে ওয়াকফ করে দেন মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের জন্য।

সেই থেকে মসজিদই ছিলো আয়া সোফিয়া। কিন্তু তুরস্কের সালতানাদের পতনের পর স্বাধীন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তিনি দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এর অংশ হিসেবে আয়া সোফিয়াকে বানানো হয় জাদুঘর। সেইসঙ্গে চাপা পড়ে মুসলিমদের জীবন্ত আবেগ।

আয়া সোফিয়ায় বন্ধ হয়ে যায় নামাজ। মূল ভবনে যোকোনো ধর্মীয় প্রার্থনা নিষিদ্ধ করা হয়। ছোট পরিসরে একটি গির্জা আর একটি মসজিদ বানিয়ে দেওয়া হয়। যেগুলোতে কেবল জাদুঘরে কর্মরতদের প্রার্থনা করার সুযোগ রাখা হয়।
তবে তুরস্কের মুসলমানরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। সেই ১৯৩৫ সাল থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করতে।

তাদের সেই দাবি পূরণ হলো ২০২০ সালে, ২৪ অক্টোবর, শুক্রবার। এর কয়েকদিন আগে মাত্র দেশটির আদালত রায় দেয় ‘আয়া সোফিয়া’কে কেবল মসজিদ হিসেবেই ব্যবহার করা যাবে।

এই রায়ের পর থেকেই তুরস্কে বইতে থাকে নতুন আবেগের ঢেউ। সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, ২৪ অক্টোবর পবিত্র জুমআর নামাজের মাধ্যমে আবারও মসজিদ হিসেবে উদ্বোধন হবে আয়া সোফিয়া।

ইস্তানবুলের লোকেরা সেই অনুযায়ীই তৈরি হয়। সবার আকাঙ্খা, এই পবিত্র সময়ের স্বাক্ষী হয়ে থাকা।
কিন্তু এখন করোনার দুঃসময়। বিপুল লোককসমাগমে ঝুঁকি রয়েছে। তাই তুরস্কের সরকার সমাগমে করাকড়ি আরোপ করলো। ঘোষণায় জানিয়ে দেওয়া হলো, আয়া সোফিয়ার ভেতর, মূল কামরায় হাজারের বেশি সমাগম হওয়া যাবে না। আর এই কামরায় যারা ঢুকবেন, মুখে অবশ্যই থাকতে হবে মুখোশ। হাতে থাকতে হবে জায়নামাজ। কামরার ভেতরে জায়নামাজ বিছাতে হবে ঝুঁকিমুক্ত দূরত্ব ঠিক রেখে।

এই ঘোষণায় অনেকে দমে গেলেন। কেউ কেউ আবার মরিয়া হয়ে মূল কামরায় প্রবেশের আশায় থাকলেন।

এলো সেই কাঙ্খিত দিন। ছিয়াশি বছর পর মসজিদ খুলে দেওয়ার দিন। শুক্রবার সকাল থেকেই ইস্তানবুলের বাতাস মুখর হয়ে উঠলো। ইউরোপ আর এশিয়ার বিভক্তিরেখা বসফরাস প্রণালীতে বইতে শুরু করলো নতুন প্রবাহ। গোল্ডেন হর্ন স্মরণ করলো সেই দিনের কথা। যেদিন সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ কনস্টানটিনোপল বিজয় করতে জলের জাহাজ ডাঙায় তুলেছিলেন। দশমাইল শুকনো পথ টেনে নিয়েছিলেন সেগুলো। কাঠের গুড়িতে চর্বি মিশিয়ে তার ওপর তুলেদিয়েছিলেন জাহাজের পেট। উসমানীয় সেনারা সেই জাহাজগুলো পাহাড় ঠেলে টেনে নামিয়েছিলেন গোল্ডেন হর্ন-এ।

সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদের সেই বিজয় ছিলো অভূতপূর্ব। বিজয়ের পর আয়া সোফিয়ায় প্রথম প্রবেশ করেন তিনি। কামরায় লুকিয়ে থাকা খৃস্টানদের অভয় দেন। সবাইকে তুরস্কের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেন। সেইসঙ্গে জীবনের নিরাপত্তা আর স্বাধীন চলাফেরা নিশ্চিত করেন।

এর পর কেটে গেলো সাড়ে পাঁচশো বছর। আয়া সোফিয়াকে নিজস্ব মর্যাদায় ফিরিয়ে দিয়ে সেই কামরায় আবার প্রবেশ করলেন ‘নতুন সুলতান’। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ‘নতুন সুলতান’ হিসেবেই চেনেন অনেকে।

আয়া সোফিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ায় তুরস্কের মুসলিমরা তার কাছে এবং দেশটির আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতা আর ঐতিহাসিক এই স্থাপনার প্রতি আবেগ নিয়ে শুক্রবার সেখানে দেখা যায় আনন্দঘন দৃশ্য।

সময়ের আগেই আয়া সোফিয়ার আঙিনা ভরে যায় মুসলমানদের উপস্থিতিতে। হাতের জায়নামাজ বিছিয়ে যার যার জায়গা করে নেন মুসল্লিরা। আশপাশের বাগান, সড়ক সব লোকে টইটম্বুর। পাশেই বসফরাস প্রণালী।

অন্য দিনের মতো বসফরাস ব্যস্ত। তবে ওই দিনের সব ব্যস্ততা যেন আয়া সোফিয়াকে ঘিরে।

জুমার সময় ঘনিয়ে আসে। জাদুঘর থেকে মসজিদ হওয়া আয়া সোফিয়া থেকে ভেসে আসে আজান। চার কোনোয় চারটি মিনার। সবগুলো থেকেই বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয় আজানের ধ্বনি।

ঐতিহাসিক ওই সময়ের স্বাক্ষী যারা ছিলেন, তারাও আবেগে টইটম্বুর হয়ে যান। কারো চোখ থেকে নামছিলো পানি। কেউ তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকে।

সংবাদমাধ্যম জানায়, শুক্রবার আয়া সোফিয়াকে ঘিড়ে ছিলো আপামর জনসাধারণ। যারা মুসলমান, তবে ধর্মে ততটা বিশ্বাস নেই, তারাও ওইদিন এসেছিলেন নামাজ পড়তে। ইতিহাস তৈরির এই সময়ের স্বাক্ষী হতে।

আজানের পর মসজিদ প্রস্তুত হয় নামাজের জন্য। তার আগে খুৎবা। ওইদিন আরো একটি আকর্ষণ ছিলো প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান। শুভ সময়ের সূচনা করতে তিনি এসেছিলেন। নিজের কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন।
আজানের আগেই এরদোয়ান পাঠ করেছিলেন সূরা আল ফাতিহা। তারপর সূরা আল বাকারাহ। তার তেলাওয়াত শেষ হওয়ার পর চার মুয়াযজিন মসজিদের চার মিনার থেকে আযান দেন।

শুভ সময়ে এরদোয়ান সুলতান ফাতিহ এর কবর জিয়ারত করেন। তিনিই এই শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘ইস্তানবুল’।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান উপস্থিতদের সামনে রেখে কিছু কথাও বলেন। তিনি বলেন, আয়া সোফিয়া ছিলো একটি মসজিদ। আবারও মসজিদে পরিণত হলো। আমার প্রত্যাশা মসজিদ হিসেবেই এটি মুমিনদের সেবা করবে।

তিনি বলেন, আয়া সোফিয়া মসজিদ হলেও, সব ধর্মের লোক এখানে আসতে পারবে। ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে।

আদালতের রায়ের পর খুব কম সময়ের মধ্যেই আয়া সোফিয়াকে নামাজের উপযোগী করতে হয়েছে তুরস্ককে। এই সময়ের মধ্যেই খৃস্টান চিহ্নগুলোকে প্রযুক্তির মাধ্যমে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এরদোয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, এই স্থাপনার খৃস্টান চিহ্নগুলোকে নষ্ট করা হবে না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনেকেই মসজিদে পরিবর্তন করার পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে এরদোয়ান বলেন, আমরা শ্রদ্ধার সাথে তাদের মত নিচ্ছি। ঐতিহ্যের সব অংশ যতœ করে রাখা হবে। তবে একে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিষয় নয়। সেটা তুরস্কের সার্বভৌম অধিকারের আওতায়।

তিনি জানিয়েছেন, আয়া সোফিয়া দেখভাল করবে সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

জুমার নামাজের আগে খুৎবা দেন ধর্ম বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান আলি ইরবাস। গত বৃহস্পতিবার মসজিদটির জন্য তিনজন ইমাম নিয়োগ করে তুরস্ক। এদের একজন মেহমেত বয়নুকালিন। বাকি দুইজন ফেরুহ মুস্তুয়ার এবং বুনিয়ামিন টপকুলু।

সবকিছু মিলিয়ে শুক্রবার ছিলো ইস্তানবুলের জন্য রোমাঞ্চকর দিন। শহরের গভর্নর বলেন, জুমার নামাজ নিয়ে শহরের সবাই রোমাঞ্চিত ছিলো।

সিএনএন জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই তুরস্কের অন্যান্য এলাকা থেকে ইস্তানবুলে লোক আসতে শুরু করে। তারা ইস্তানবুলে রাত কাটান। খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করেন অভ’তপূর্ব এক সকালের।

সেই সকালে আহমদ নামের এক মুসল্লি সিএনএনকে বলেন, পবিত্র হজের মাসের তৃতীয় দিনে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটছে। আমাদের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন হয়েছে। শুকনো হৃদয় পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে এর জন্য ধন্যবাদ।

সময়ের আগেই আয়া সোফিয়ার আঙিনা ভরে যায় মুসলমানদের উপস্থিতিতে । ছবি : ইন্টারনেট
সময়ের আগেই আয়া সোফিয়ার আঙিনা ভরে যায় মুসলমানদের উপস্থিতিতে । ছবি : ইন্টারনেট

 

শুক্রবারের জুমার নামাজে সমবেতদের আবেগ যেমন দুলছিলো, তেমনি দুলতে দেখা গেছে আয়া সোফিয়ার কামরা। এই কামরার ভেতর থেকে দেওয়া হয় আবেগে ভরপুর খুতবা।

খুতবা প্রচার করা হয় দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। আনাদুলো জানায় আবেগঘন সেই খুতবায় এমন দিন উপহার দেওয়ার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।

খুতবায় বলা হয়, সালাম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি এই বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় হবে। সেই বিজয়ী সেনাপতি এবং সেনারা হবেন মহান।’

সালাম জানানো হয় সাহাবিদের প্রতি। সাহাবিদের কয়েকজন এর আগে কনস্টানটিনোপল বিজয়ের চেষ্টা করেছিলেন।
খুতবায় অতীতের সুলতানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। যারা আনাতোলিয়ার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অতীতে শহীদ এবং বীরদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ইমাম। স্মরণ করা হয় আয়া সোফিয়ার উল্লেখযোগ্য ইমামদের। ইস্তানবুলের নেতাদের। আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের কারিগরদের। তাদের সকলের উপর আল্লাহর রহমত কামনা করা হয়।

বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়, একসময় এই ইমারত থেকে ছড়ানো হতো শান্তির বাণি। এখনও ছড়ানো হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে