আয়া সোফিয়া কি মসজিদ হচ্ছে

রোমানদের সময় আয়া সোফিয়া ছিলো চার্চ। মুসলমানদের বিজয়রে পর মসজিদ। আর সালতানাত বিলুপ্তির পর কামাল পাশার কৌশলে এই মসজিদটিকে জাদুঘর বানানো হয় - ইন্টারনেট

  • সাইমা আকন্দ
  • ০৩ জুলাই ২০২০, ১৯:৪৭

ইস্তানবুল, একটি প্রাচীন শহর। এই শহর কেটে মর্মর সাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে মিশেছে বসফরাস প্রণালী। প্রণালীর এক অংশ ইউরোপে। অন্য অংশ এশিয়ায়। অর্থাৎ ইস্তানবুল শহরটি দুই মহাদেশের অংশ। সম্ভবত এ কারণেই একে বলা হয় পৃথিবীর রাজধানী।

যখন ইস্তানবুল মুসলমানদের অধিকারে আসে, তখন পৃথিবীর বড় একটি অংশ শাসন হতো সেখান থেকেই। আর এই শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘আয়া সোফিয়া’।

রোমানদের সময় আয়া সোফিয়া ছিলো চার্চ। মুসলমানদের বিজয়রে পর মসজিদ। আর সালতানাত বিলুপ্তির পর কামাল পাশার কৌশলে এই মসজিদটিকে জাদুঘর বানানো হয়।

এর পর থেকেই তুরস্কের ধর্মপ্রাণদের দাবি, আয়া সোফিয়ায় আবারও নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। এরদোগান সরকার আসার পর সেই দাবি আরো জোড়ালো হয়। তার বিভিন্ন সমাবেশে ধর্মপ্রাণরা সরাসরি এই দাবি জানিয়েছেন বহুবার। এরদোগান জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন।

তুর্কী জনগণ সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন। এরদোগান সরকারও এ নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে। তবে আপত্তি আসছে গ্রিস থেকে। ‘আয়া সোফিয়া’ নিয়ে গ্রিসের নাক গলানোর দরকার নেই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু। তিনি জানিয়েছেন, এর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে’। গ্রিস বা অন্য কোনো দেশের এখানে কথা বলার অধিকার নেই। তুরস্ক যেভাবে চায়, সেভাবেই নির্ধারণ হবে এর ভবিষ্যৎ।

তুরস্কের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন থেকেই এই মসজিদে আবার নামাজ পড়ার দাবি জানিয়ে আসছে। এ বছর উসমানীয়দের কনস্টানটিনোপল জয়ের বার্ষিকীতে আয়া সোফিয়ার ভেতর নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। ১৪৫৩ সালে ওসমানীয় সুলতান ফাতিহ মোহাম্মদ এই এলাকা জয় করেন।

চলুন ঘুরে আসা যাক সেই সময় থেকে-
ঘোর লাগিয়ে দেওয়ার মতো এই স্থাপনাটি তৈরি হয় আনুমানিক পনের শো’ বছর আগে ৫৩৭ সালে বাইজ্যান্টাইন খৃস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। এটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক সনাতন খৃস্টানদের ক্যাথেড্রাল, রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথেড্রাল এবং মুসলিমদের মসজিদ হিসেবে। এখন খোলা আছে জাদুঘর হিসেবে। খৃস্টান ও মুসলিম সংস্কৃতির মিশেল এই জাদুঘরে ঢুকলে দেখা যাবে মেরির কোলে যিশু এবং তার পাশে বড় করে লেখা ‘আল্লাহু’।

আয়া সোফিয়ার আরেক নাম ‘হাজিয়া সোফিয়া’। এর অর্থ ‘পবিত্র জ্ঞান’। বিভিন্নসময় একে বিভিন্নভাবে গড়ে তোলা হয়। এ কারণে এর নির্মাণ কাঠামো একটু জটিল। আয়া সোফিয়া বিখ্যাত রহস্যময় আলোর জন্য। এর ডোমে আছে ৪০টি জানালা। সেগুলো দিয়ে ভেতরে আলো ঠিকড়ে যায়। এর ভেতরে থরে থরে সাজানো গ্যালারি। ডোম ও সোনার মোজাইক পর্যটকদের ঘোর লাগিয়ে দেয়।

ঘোর লাগানো এই স্থাপনা তখন ছিলো কনস্টানটিনোপল-এর আকর্ষণ। কনস্টানটিনোপল নিয়ে গোটা বিশ্বের ছিলো বিপুল আগ্রহ। ১৪৫৩ সালে এই খৃস্টানদের আক্রমণের জবাবে ওই এলাকায় অভিযান চালান উসমানীয় সুলতান মোহাম্মদ। বিশাল সেনাদল নিয়ে হাজির হন তিনি। কিন্তু তখনকার কনস্টানটিনোপল ছিলো দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেয়াল এখনো টিকে আছে, তবে আগের মতো দুর্ভেদ্য নয়।

সুলতান মোহাম্মদ এর সেনাবাহিনী বিশাল হলেও এই দেয়ালের কাছে নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিলো তার। উসমানীয়দের অনেক সেনাকে আটক করে রোমানরা। পরে দেয়ালের ওপর তুলে ২৬০ জনের শিরচ্ছেদ করা হয়। তবু হাল ছাড়েননি মুহাম্মদ। সেনাদেরও সরে যেতে বলেননি। দেয়াল সামনে রেখে কনস্পানটিনোপল অবরোধ করে রাখেন তিনি।
সুলতান মোহাম্মদের এই অভিযান ইতিহাসে মিরাকল হিসেবে খ্যাত। তার এই অভিযানে জলের জাহাজ ডাঙায় উঠেছিলো।

মোহাম্মদের স্থলবাহিনী শহরের পূব দিকে অবস্থান নিয়েছিলো। আর নৌবাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসছিলো বসফরাসে। কিন্তু জয়ের জন্য তাদের গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করতে হবে। রোমানরা এর প্রবেশমুখে শিকল এঁটে দিয়েছিলো। সেইসঙ্গে বসিয়েছিলো সতর্ক পাহারা। সেখান থেকে উসমানীয় জাহাজগুলোর ওপর গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো।

বেশকিছুদিন এই অবস্থায় থেকেও কোনো ফলাফল আসছিলো না। তাই সুলতান এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাদের যুদ্ধজাহাজগুলো ডাঙায় তুলে দশ মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে গোল্ডেন হর্নে নামাতে হবে।
রাতের অন্ধকারে শুরু হলো কাজ। পুরো পথে কাঠের পাটাতন বিছানো হলো। পাটাতনে মাখা হলো পানি এবং চর্বি। এর পর পিচ্ছিল পথে সত্তরটি জাহাজ ঠেলে গোল্ডেন হর্নে নামিয়ে আনা হলো।

সকাল যখন হলো, রোমানরা ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠলো। তাদের পেছন দিক থেকে তাড়া করতে শুরু করলো উসমানীয় যুদ্ধজাহাজ।

এবার সুলতানের অবরোধ আরো পাকাপোক্ত হলো। তিনি দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দিলেন। সেইসঙ্গে দিলেন সবার জীবনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রæতিও। কিন্তু এতে রাজি হয়নি রোমানরা। শেষে বড় কামানের গোলা ছুঁড়ে দেয়াল উড়িয়ে দেয় উসমানীয়রা। রোমানদের কাছেও কামান ছিলো। কিন্তু সেগুলো ছিলো উসমানীয়দের তুলনায় দুর্বল।
দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার মাধ্যমে পতন হয় রোমান সা¤্রাজ্যের। শহরের নাম হয় ইস্তাম্বুল।

সভ্যতার প্রতীক
সভ্যতার প্রতীক

 

প্রাচীর ভেদ করে তুর্কি সেনারা যখন শহরে প্রবেশ করছিলো, তখন শহরজুড়ে আতঙ্ক। রোমান খৃস্টানদের অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলো। যারা পালাতে পারেননি তারা দরজার খিল এঁটেছিলো। অনেকেই জড়ো হয়েছিলো ‘আয়া সোফিয়া’য়। শহরের নীতিনির্ধারকদের একটি শঙ্কা ঘিরে ধরলো, তারা বিপুল সংখ্যক তুর্কি সেনাকে দেয়ালের ওপর শিরচ্ছেদ করেছেন। সেই প্রতিশোধ নিশ্চয়ই নেবেন সুলতান মোহাম্মদ।

কিন্তু তিনি যখন কনস্টানটিনোপলে প্রবেশ করলেন। সবার আগে গেলেন আয়া সোফিয়ায়। সঙ্গে বিজয়ী সেনাদল। আর কয়েক হাজার পরাজিত চোখ উদ্বিগ্ন হয়ে দেখছিলো এ দৃশ্য। এদের কেউ কাঁদছে। কেউ বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছে। কেউ সুলতানের পায়ের কাছে মাথা নামিয়ে আনতে চাইছে।

তাদের ধারণা ছিলো এখন থেকে সবাইকে সুলতানের দাস হিসেবে থাকতে হবে। কিন্তু সুলতান সবাইকে আশ্বস্ত করলেন। পরাজিতদের জীবন এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেন। এমনকি তাদেরকে তুর্কি নাগরিকত্ব দিলেন। ঘোষণা করলেন, এরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ইস্তানবুলেই বসবাস করতে পারবেন।

আয়া সোফিয়ার পরের ইতিহাস মুসলিমদের। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের রাজধানী হয় এই শহর। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিল তুরস্কের রাজধানী।

সেইসময় আয়া সোফিয়া হয়ে উঠে মুসলিম সভ্যতার বড় প্রতীক। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতা ছড়িয়ে যায় এই মসজিদকে কেন্দ্র করেই। তবে আয়া সোফিয়া থেকে বাতাসে ছড়ানো আজানে রোমের পোপদের হৃদয় চৌচির হয়ে যেতো। তারা সবসময় এই মসজিদটিকে চার্চে ফিরেয়ে নিতে তৎপর ছিলো।

পৃথিবীর সামনে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তখন পরিস্থিতি পাল্টে যায়। উসমানীয় খেলাফত ভেঙে যায়। দেশের প্রধান হন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। ইউরোপ থেকে দাবি আসতে থাকে মসজিদটিকে চার্চ বানানোর। কামাল পাশা তাদের দাবিকে গুরুত্ব দেন। কিন্তু সরাসরি চার্চ বানিয়ে ফেললে জনতা ফুঁসে উঠতে পারে, এমন শঙ্কায় ঝুঁকি নেননি তিনি। ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও আয়া সোফিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ১৯৩০ সালের পর ইসলামবিরোধী নানা আইন চালু করতে থাকে তুরস্ক। এর অংশ হিসেবে কামাল পাশা আমেরিকা থেকে আর্কিওলজিস্ট থমাস হোয়াইমোরকে নিয়ে আসেন। তিনি সুলতান ফাতিহ মোহাম্মদের চিত্রকর্মগুলো দেয়াল থেকে মিশিয়ে দিতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো বাইজেন্টাইনদের করা চিত্রকর্ম। এই অবস্থাতেও মুসলমানরা নামাজ পড়ছিলেন সেখানে। কিন্তু ১৯৩৩ সালের পর নামাজ পড়া একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন দেয়ালের ছবিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। আর ছবি সামনে নিয়ে নামাজ পড়া হারাম।

এভাবেই মুসলমানদের সরিয়ে দেওয়া হয় আয়া সুফিয়া থেকে। ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর মসজিদে আয়া সোফিয়াকে বানানো হয় জাদুঘর।

১৯৭৪ সালে তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশের প্রধান প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান যখন উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়। তিনি নিজেদের ‘সুলতান ফাতিহ মোহাম্মদ’-এর উত্তরসুরি বলে ঘোষণা দেন। তার দলের ছাত্রসংগঠন আয়া সোফিয়ার সামনে বিশাল নামাজের আয়োজন করে। সেই নামাজের নাম দেওয়া হয় ‘ফাতিহ নামাজ’।

তখন থেকে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানানোর জোর দাবি উঠে। ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় আসেন নাজমুদ্দিন এরবাকান। মানুষ আবারও আয়া সোফিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিষয়টি গড়ায় সংসদের ভোটের দিকে। এরবাকান প্রধানমন্ত্রী হলেও তার ভোট ছিলো ২১.৪ শতাংশ। তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ৫০ শতাংশ ভোট দরকার। কিন্তু সংসদের না ভোটে থেমে যায় তার উদ্যোগ।

২০০২ সালে একে পার্টি ক্ষমতায় এলে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দিকে তাকিয়ে থাকে তুর্কীরা। প্রফেসর এরবাকানের জারি করা ‘ফাতিহ নামাজ’ প্রতি বছর পড়তে থাকে তুর্কীরা। কিন্তু বাস্তবতার কারণে এখনো জাদুঘরটিকে মসজিদে পরিবর্তন করতে পারছে না সরকার। একটি বেসরকারি সংস্থা বর্তমান জাদুঘরটির অবস্থা নিয়ে আদালতে আপিল করে।

তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাভুসোগলু বলেছেন, ‘আমরা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’

পাশাপাশি গ্রিসকে নিজেদের চরকায় তেল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। দেশটিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এথেন্সই ইউরোপের একমাত্র রাজধানী যেখানে কোনো মসজিদ নেই।’

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে