পর্তুগাল খুঁজছে ইসলামী অতীত

এটি কি মিহরাবযুক্ত গির্জা, নাকি ক্রুশওয়ালা মসজিদ - মিডল ইস্ট আই

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ৩০ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৭


পর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চলে, স্পেন সীমান্তের একেবারে কাছেই অবস্থিত শহরটি। নাম মারতোলা। গুয়াদিয়ানা নদীর তীরে অবস্থিত সেই শহরের অনতিদূরেই সারি সারি পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাদদেশে একটি ভবন, যার মাথায় শোভা পাচ্ছে গোলাকৃতি গম্বুজ।

এ ভবনটাকে কী বলা যায় - এটি কি মিহরাবযুক্ত গির্জা, নাকি ক্রুশওয়ালা মসজিদ? সাদা চুনকাম করা ভবনটি নোসা সেনহোরা দা আনুনসিয়াচাও-এর গির্জা নামেই পরিচিত। তবে যেসব দর্শনার্থী এর ভেতরের মূল্যবান কারুকার্য দেখতে যান, তাদের বলা হয়, এটা হলো পর্তুগালের সবচাইতে সংরক্ষিত মধ্যযুগীয় মসজিদ। স্থানীয় বাসিন্দা জারমানো ভাজ বলেন, 'এটি অনেককিছুর মিশ্রণ। এটি বানানো হয়েছিল একটি রোমান গির্জার ওপর। এটি ছিল মসজিদ, আর এখন গির্জা। দু'টি ধর্ম ও সংস্কৃতি কেমন একাকার হয়ে গেছে! আমরা এ নিয়ে গর্বিত।'


এককালের মসজিদ এখন গির্জা আর সেই গির্জায় খ্রিস্টানরা মক্কামুখী হয়ে প্রার্থনা করে। এর মূল বেদির ঠিক পেছনেই মিহরাব। ওখানে আছে একটি টাওয়ার। এককালে ওই টাওয়ার থেকে আজান দেয়া হতো। কতো আর আগে, এক হাজার বছরও হবে না।


এখন যে পর্তুগাল ও স্পেন নামের দু'টি দেশ, তার বেশিরভাগ এলাকা ৮ম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমানরা শাসন করতো। আল-আন্দালুস নামে পরিচিত এ অঞ্চলটি ওই সময় সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে চর্চা হতো বিজ্ঞান, স্থাপত্য ও চিত্রকলার। মুসলিম শাসনামলে এখানে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয়া হতো। ঘারব আল-আন্দালুস নামে পরিচিত দক্ষিণ পর্তুগালে এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা তুলনামূলক শান্তিতে বসবাস করতো।


এখন পর্যন্ত পর্তুগাল দেশটি মুসলিম শাসনামলের স্মৃতিচিহ্নে ভরতি - স্থাপত্যকলা থেকে শুরু করে পর্তুগিজ ভাষা ও সঙ্গীতে। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতিদিন দুপুরবেলায় মারতোলার রাজপথে আজান শোনা যায়। না, এটা মধ্যযুগে নির্মিত মসজিদের আজানখানা থেকে আসছে না। আসছে চলমান ইসলামিক ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে শহরের চারদিকে বসানো লাউড স্পিকার থেকে। এই মেলাটি ২০০১ সালে শুরু হয়। এতে পর্তুগালে মুসলমানদের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় সঙ্গীত, চারু ও কারু, কর্মশালা ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে।


মারতোলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দফতরের প্রধান ম্যানুয়েল মারকুয়েস এ বিষয়ে বলেন, এই মেলা করে আমরা দেখাতে চাই, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে অনেক মিল আছে। সারা দুনিয়ায় অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থা যখন বেড়ে চলেছে তখন আমরা দেখাতে চাই যে একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করা এখনও সম্ভব। আমাদের মারতোলায় বিভিন্ন জাতির অনেক লোক বসবাস করে। এ শহর  সবাইকে নিয়ে শান্তিতে বসবাসের একটা মহান দৃষ্টান্ত।


মারতোলায় মুসলমানদের আগমন ৮ম শতাব্দীতে। এর পরবর্তী ৫০০ বছর তারাই এ দেশ শসন করে। পুরনো শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় এখনো ইসলামী বৈশিষ্ট্য জ্বলজ্বল করছে। মারকুয়েস বলেন, 'মারতোলা শহর তার ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত। আমরা ইসলাম এবং আমাদের অভিন্ন ঐতিহ্যকে সম্মান দেখাতে চাই। আমাদের শহরটি বরাবরই বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল। এ শহরই দক্ষিণ পর্তুগালকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বাকি অংশের সাথে যুক্ত করেছে।'


মারতোলা ফেস্টিভ্যালের একেবারে শুরুর দিকে এর সাথে জড়িত ছিলেন জরগ রেভেজ। এখন এডিপিএম নামে স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংস্থার প্রেসিডেন্ট তিনি। এর মাধ্যমে আল-আন্দালুসের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে মরক্কোর কয়েকটি সংগঠনের সাথে কাজ করছে তার সংস্থা। এ প্রসঙ্গে রেভেজ বলেন, আফ্রিকার উত্তর অংশের সাথে পর্তুগালের যে মিল আছে, আমরা তা-ই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।


খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় এবং বন্দর থাকায় মধ্যযুগে মারতোলা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ব্যবসাকেন্দ্র। সময়ের বিবর্তনে একসময় সেই গৌরব ম্লান হয়ে আসে। তবে ১৯৭০ সালে সেখানে ইসলামী শিল্পকর্ম আবিষ্কৃত হলে মারতোলা ফিরে পায় তার হারানো গৌরব। মারতোলা এখন দাবি করতে পারে যে তাদের হাতেই আছে পর্তুগালের সবচাইতে সমৃদ্ধ ইসলামী চিত্রকলার সংগ্রহ। এরই মধ্যে কোনো এক শুক্রবার রাতে নদীর পাড়ে আয়োজন করা হয় এক কনসার্টের। ব্রিটেনে অবস্থিত ফিলিস্তিনী ব্যান্ড ৪৭সৌল-এর শিল্পীরা সেই রাতে আরবী ও ইংরেজি ভাষায় গান করেন। তাদের গানের সাথে বাজানো হয় প্রচলিত ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্র। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও নাইজারের গায়করা রাতভর গান করে, নাচে। 

ইসলামী ও ইহুদি অতীত

১৪৯৬ সালে পর্তুগালের তৎকালীন রাজা প্রথম ম্যানুয়েল তার সাম্রাজ্য থেকে সব ইহুদি ও মুসলমানকে বিতাড়িত করার হুকুম জারি করেন। এভাবে আল-আন্দালুসে সহাবস্থান ও সহযোগিতার দিন শেষ হয়ে আসে।


বর্তমানে এলাকাটির জনসংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ; এর মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ০.৫%এরও কম। নোভা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, ন্রি-বিজ্ঞানী মারিয়া কারদেইরা ডি সিলভা বলেন, স্বৈরাচারের রাজত্বকালে  এ দেশে ইসলামের ইতিহাসের সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়।  ১৯৩৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পর্তুগাল শাসন করে খ্রিস্টান স্বৈরাচারী শাসকরা। তারা মূর নামে পরিচিত মুসলমানদের শত্রূ বলেই গণ্য করতো। স্বৈরাচারের পতনের পর পর্তুগালে আন্দালুস বিষয়ে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এভাবেই দেশটির ইসলামী অতীত মানুষের সামনে আসতে থাকে।


ন্রি-বিজ্ঞানী কারদেইরা বলেন, মারতোলায় যে প্রত্নতাত্বিক কাজ হয়েছে তাতে করে মুসলিমদের 'পর' ভাবার  বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ এতে দেখা গেছে, আমাদের ইতিহাস বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত এবং স্তরগুলো পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। এভাবে ইসলামী স্তরটিও আমাদের অংশ। এটি আমাদের আইডেন্টিটির অন্তর্ভুক্ত।  প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লদিও টরেস বলেন, ইতিহাসবিদরা যেমন বলেন যে ''পর্তুগালে মুসলিম শাসকরা ইসলামকে চাপিয়ে দিয়েছিল'', আসলে তা নয়। ইসলাম এ দেশে এসেছিল পর্যায়ক্রমে; বণিকদের মাধ্যমে।


মারতোলায় গত ৩০ বছর কাজ করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক লোপেজ। তিনি বলেন, ভূমধ্যসাগরের দুই তীরের মানুষদের মধ্যে ধারাবাহিকতা খুঁজে পেতে  প্রত্নতত্ত্ব আমাদের সাহায্য করেছে। মারতোলার প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন, পর্তুগালে ইসলাম শাসকের তরবারীর মধ্য দিয়ে আসেনি, এসেছে বন্দরে আসা বণিকদের হাত ধরে আর ধর্মান্তরের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়েছে।


লোপেজ বলেন, প্রত্নতত্ত্ব আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, এই ''অন্যরা'' আমরা যতটা ভাবি, তার চাইতে বেশি আমাদের নিকটজন। আমাদের উভয়ের একটি অভিন্ন অতীত আছে এবং আমাদের সংস্কৃতিতেও অনেক মিল আছে। উত্তর ইউরোপের চাইতে আমরা উত্তর আফ্রিকার বেশি কাছাকাছি।


লোপেজের এ কথার সাথে একমত হন লায়লা আলী, যদিও মারতোলা ফেস্টিভ্যালে আসা মিশরীয় এ নারী কখনো প্রত্নতত্ত্ব পড়েননি। গত ১২ বছর ধরে তিনি পর্তুগালে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, পর্তুগালে আসার আগে আমি জার্মানিতে ছিলাম। কিন্তু ভালো লাগছিল না। দেশটা কেমন ঠাণ্ডা, মানুষগুলোও সেরকম - শীতল। আর পর্তুগালের মানুষগুলো আরবদের মতো - আন্তরিকতায় উষ্ণ, বন্ধুত্বপরায়ণ।


লায়লা ২০১১ দাল থেকে মারতোলা ফেস্টিভ্যালে আসছেন। কিন্তু এবারের ফেস্টিভ্যালটা রমজান মাসে পড়ে যাওয়ায় বেশ কঠিন হয়ে গেছে। লায়লার মতোই মারতোলা ফেস্টিভ্যালের আরেক নিয়মিত দর্শক হুসেইন বদর। তিনি মাদ্রিদে বাস করছেন গত ৩৫ বছর যাবৎ আর ১৫ বছর ধরে ফেস্টিভ্যালে আসছেন। এবার একদিকে রোজা অন্যদিকে তীব্র গরম - সব মিলিয়ে খুবই ক্লান্ত তিনি। এর মধ্যেই তিনি মেলায় আগত অতিথিদের চা পরিবেশন এবং আরব দেশের মিষ্টান্ন বিক্রি করেছেন। নিজে রোজা রেখেও অন্যদের চা দেয়ার কাজে অসন্তুষ্ট নন তিনি। বলেন, আমি এতে কিছু মনে করি না। আর মারতোলা এক বিশেষ ধরনের শহর। আমার এখানে আসতে খুব ভালো লাগে।