মুসলমান খুন করলে ‘সন্ত্রাস’, যদি শ্বেতাঙ্গ করে?

নিউজিল্যান্ড মসজিদে হামলা -

  • শাহনওয়াজ আলি রায়হান 
  • ২০ মার্চ ২০১৯, ১৭:২৯

 

কী অদ্ভুত! নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে পঞ্চাশজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে অথচ কেউ আমাকে ঘটনার নিন্দে করতে বলেনি! ইসলাম সন্ত্রাসকে সমর্থন করে কিনা সেই পুরনো প্রশ্নটাও এতগুলো লোকের হত্যার পর কেউ আমাকে একবারও করেনি। পাঠক হয়তো বলবেন ‘ধুর! আপনি তো নিজেই মুসলিম, মৃতরাও মুসলিম — আপনাকে কেন কেউ এ সব প্রশ্ন করতে যাবে!’ ঠিকই। টুইন টাওয়ার থেকে চার্লি এবদো, লন্ডন বম্বিং থেকে মুম্বই হামলা — সব রক্তপাতের সময় আমাকে, আমার মতো দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাজার মাইল দূরে থাকামুসলিমদেরকে সাফাই দিতে হয়েছে ইসলাম সন্ত্রাসের সমর্থক নয় বলে। যাঁরা যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলার পেছনে চোদ্দশো বছর আগের কোরানের সমর্থন থেকে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র নীরব সমর্থন দেখতে পান, তাঁরা কি গত শুক্রবারে ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ডের জন্য শুধুই ব্রেন্টন টারান্টকেই অপরাধী মনে করেন, না সাফাই চান আরও অনেকের থেকেই ? 

সন্ত্রাসবাদী অ-মুসলিম হলে, বিশেষ করে সাদা চামড়ার হলে, গণমাধ্যম থেকে জনমানস সর্বত্র বেশ কিছু ছাড় পান। প্রথমত তাঁকে নিছকই বন্দুকবাজ বা হতাশাগ্রস্ত একজন অপরাধী হিসেবেই চিত্রায়িত করা হয় যাঁর ঐতিহাসিক নিয়মে খুনটা করার কথা ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে কোনও রকমে। হয়েই যখন গেছে তখন এর পেছনে তাঁর ধর্ম বা কোনও আদর্শের ভূমিকা খুঁজতে যাওয়া বোকামি। ছোটবেলায় মা-বাবার বিবাহ-বিচ্ছেদের দরুণ ক্ষতিগ্রস্ত শৈশব বা কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য সম্প্রতি হারানো কাজই এর মূল কারণ! এমন কিছু কারণ না থাকলে তবে অবশ্যই হিংসাত্মক সব ভিডিয়ো গেমের ক্যাসেটগুলোই নাটের গুরু! ঘাতক মুসলিম হলে যেমন অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু হয় জেহাদি সাহিত্য বা প্রশিক্ষণ, সাদা হলে তা বদলে গিয়ে‘মানসিক স্বাস্থ্য’। 

ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় ধরা পড়েছে একজন।কিন্তু সে একাই এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র আসামী নয়। এর দায় অসংখ্যজনের । তারা কেউ মসজিদে মসজিদে বন্দুক হাতে নামাজিদের গুলি করে বেড়ায়নি ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে মাইক হাতে নিয়ে জনমানসে মুসলিমদের ব্যাপারে বিষোদ্গার করে বেরিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার নানা প্রান্তে। কেউ বা সাংবাদিক সেজে খবরের কাগজের পাতায় টুপি-হিজাব-মিনারের বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ ক্রুসেডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। টিভির ক্যামেরাকে কেউ বা বন্দুকের নলের মত তাক করে অন্যের চোখে প্রতিবেশী মুসলিমকে ‘অপর’ হিসাবে চিত্রায়িত করছে। পরের বার আরও একটু বেশি ফান্ড, গ্রান্ট পাবার আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠান্ডা ঘরে রচিত সন্দর্ভটিতে কেউ বা কল্পনার মাধুরী তাত্ত্বিকতার ছদ্মবেশে মিশিয়ে অসহায় কারও রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের গল্পকে নাম দিয়েছে ‘টেররিজম’ , আর দখলদারদের ‘টেররিজম’-কে বানিয়েছে ‘সেল্ফ ডিফেন্স’! তাই এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্রেন্টন টারান্ট নামের এক অস্ট্রেলীয় হলেও, হত্যার অনুকূল পরিবেশ রচনার অপরাধী ইউরোপ ও আমেরিকার অনেকেই। ব্রেন্টন টারান্টকে তাই নিছক ‘বন্দুকবাজ’ দেখানোর প্রয়াস ঠুনকো দেখায়। হত্যাকাণ্ডের পূর্বে তিনি লিখে ফেলে ৭৪ পাতার ম্যানিফেস্টো। তিনি তাঁর ম্যানিফেস্টোতে শ্বেত অস্মিতা পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যে দিন ক্রাইস্টচার্চে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে, সে দিনই ট্রাম্প মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে তাঁর বহুচর্চিত দেয়াল গাঁথার যুক্তি সাজাতে গিয়ে ‘ইনভেশন’ শব্দের ব্যবহার করেন। এই একটি শব্দ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ট্রারান্টের ম্যানিফেস্টোতে। তিনি শ্বেতাঙ্গদের দেশগুলোতে মুসলিমদের ‘ইনভেডার’ বা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখেন। এই একই কথা ব্রিটেনে নাইজেল ফারাজ, টমি রবিনসন বা ফ্রান্সে মেরিন লে পেন, নেদারল্যান্ডসে গ্রিট উইল্ডার্স, আমেরিকায় স্টিভ ব্যাননের মত জনপ্রিয় নেতারা বলছেন।

ফলে এবারের ‘বন্দুকবাজ’ কোনও অবয়ববিহীন আততায়ী নয়। নিজেকে ম্যানিফেস্টোতে শ্রমিক শ্রেণির সদস্য জাহির করলেও, তিনি এমন একটা বিদ্বেষপূর্ণসাদা এলিট শাসক সমাজের বেলাগাম হওয়া হিংস্র মুখ, যাঁরা কোর্ট-প্যান্ট-টাই পরে সংসদে, গণমাধ্যমে বা বিদ্যায়তনিক ময়দানে প্রতর্ক তৈরি করে— উপনিবেশিকতাবাদের সময়কার শ্বেত আধিপত্য কী করে উত্তর-উপনিবেশিক যুগেও ‘মানবতা’, ‘মানবাধিকার’, ‘সুশাসন’ ইত্যাদিশব্দের আশ্রয়ে জিইয়ে রাখা যায়। এরা যখন ‘মানবতা’ শব্দটা বলে তখন মুখে না বললেও নিজ ধর্ম-সংস্কৃতির সমার্থক হিসেবে বলে। যেহেতু মনে করে তাদেরটাই শ্রেষ্ঠ, তাই অন্যদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় সেটাকে আপন করার। এরই নাম কোনও দেশে ‘মূল স্রোতে নিয়ে আসা’, আবার কোথাও ‘অ্যাসিমিলেশন’! ইউরোপ-কেন্দ্রিকতার অনুসারীরা মনে করে যাহা কিছুই ইউরোপীয় তাহাই বিশ্বজনীন। কেউ যদি এর বাইরে পোশাক পরে, সুবিচারের ধারণা দেয়, ন্যায়ের কথা বলে তবে সেটা প্রাক-আধুনিক, আজকের দিনে কার্যকরী নয়। সেটা আখ্যায়িত করতে ‘ধর্মান্ধ’ থেকে ‘মৌলবাদী’ — নানা মাত্রার পরিভাষা ব্যাবহার করা হয়। 

অথচ প্রাক-উপনিবেশিক যুগে নানা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলেও নানা ধর্মের লোক শান্তিপূর্ণ ভাবেই একত্রে বসবাস করত, ব্রেভিক বা টারান্টের মতো অন্যদের হত্যা করে সভ্যতা বিশুদ্ধ রাখার ‘দায়িত্ব’ নিজ হাতে তুলে নিত না। যার নমুনা হল আল-আন্দালুস বা ৭১৬ থেকে ১৪৯২ সালের স্পেন। স্পেনের কর্ডোভায় মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টানরা সে দিন পাশাপাশি বসে জ্ঞানের চর্চা না করলে শুধু ইতালির রেনেসাঁর হাত ধরে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত সমৃদ্ধ হতে পারত না। ইউরোপকে আজকে যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের মুসলিম অভিবাসীরা নিজেদের চিরস্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করেছে তার একটা কারণ এই বহুমাত্রিক ইতিহাসবোধ। এদের আগের প্রজন্ম এক দিন বাধ্য হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ বা উত্তর আফ্রিকার স্বদেশ ছেড়ে রুজি রোজগারের খোঁজে ইউরোপে আসতে। ঔপনিবেশিক প্রভুরা ওই সব দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। নতুন জীবনের খোঁজে বিলেতে এলে শুরুতে সেটা ছিল ‘কিছু টাকা কামিয়ে দেশে ফিরে যাব’ এই বাসনা থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেবিধ্বস্ত ইউরোপেও তখন পুনর্নির্মাণের জন্য লোক চাই। শুরুতে আশ্রয়দায়ী সমাজের সঙ্গে বন্ধন তাই ছিল আলগা, পায়ের তলায় মাটি শক্ত করার তাড়া ছিল বেশি।আজ চাইলেই ছেঁড়া শেকড় পুরনো মাটি ফিরে পাবেনা। ছেলেমেয়ে ব্রিক লেনের সিলেটি পরিবারে জন্ম নিলেও তাঁদের মুখের ভাষা আজ ইংরেজি, হবিগঞ্জ-সিলেট এক দু’মাস ছুটি কাটানোর জন্য ঠিক আছে কিন্তু বাড়ি বলতে পূর্ব লন্ডনই। তাই লন্ডনের মেয়র সাদিক খানকে যখন পাকিস্তান সফরে সময় যখন বিবিসি-র সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন ‘ডাজ ইট ফিল লাইক কামিং হোম?’ তিনি প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে বলেন ‘হোম ইজ সাউথ লন্ডন, মেট। বাট ইট’স গুড টু বি ইন পাকিস্তান’। টারান্ট তাঁর ম্যানিফেস্টোতে আহ্বান জানিয়েছেন সাদিক খানকে হত্যার। গত জুলাই মাসেই ডোনাল্ড ট্রাম্প লন্ডন সফরের সময় সাদিক খানকে সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যর্থ বলে ব্যঙ্গ করেন! কিছু দিন আগে একজন শামিমা বেগম আইসিস-এ যোগ দিলে সেটা নিয়ে ফলাও করে প্রচার হয়, তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয়, বাচ্চা মারা যায়। টিভি-ইন্টারনেটে এ সব দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, ব্রিটিশ মুসলিমদের একটা বড় অংশ আইসিস সমর্থক। 

আদতে উল্টোটা। বিলেত থেকে আইসিস-এ যোগ দেওয়া মুসলিমদের সংখ্যা .১ শতাংশও নয়! সকলেই প্রায় আইসিসকে ইসলামের শত্রু ভাবে, স্থানীয় ইমামদের অনেক ফতোয়াও আছে সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে। খোদ শামিমাওসম্প্রতি সাক্ষাৎকারে আইসিস-এর দুর্নীতি দেখে মোহভঙ্গের কথা বলেছে, এবংবিচারে শাস্তি গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছে। পশ্চিমের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম যত দিন অ-পশ্চিমি দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের পাপেট করে রাখবে, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামকে ‘জেহাদ’, ‘সন্ত্রাস’ প্রভৃতি পরিভাষায় আখ্যায়িত করতে থাকবে, তত দিন ব্রেভিক বা টারান্টদেরম্যানিফেস্টো রচনার রসদ পেতে অসুবিধা হবে না। এই সে দিনও, আশির দশকে এ ভাবে সবাইকে ‘মুসলিম’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হত না পাশ্চাত্যে। পাকিস্তানি,কুর্দ, তুর্ক, বাংলাদেশি, আলজিরিয় ইত্যাদি পরিচয় মুখ্য ছিল। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর নিজেকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা পাশ্চাত্যের নেতাদের কাছে আজ আর কেউ কুর্দ বা সিলেটি না— সবাই শুধুই মুসলিম! পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে অপরাধ করা মুসলিমের পাপের সমান ভাগীদার! এটাই ইসলামোফোবিয়া। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া, কালচার ও কমিউনিকেশনের শিক্ষকঅরুণ কুন্দনানি তার ‘দ্য মুসলিমস আর কামিং!: ইসলামোফোবিয়া, এক্সট্রিমিজম, অ্যান্ড দ্য ডোমেস্টিক ওয়ার অন টেরর’ বইটিতে দেখিয়েছেন যে যতই ভালো ইসলাম / জেহাদি ইসলাম পার্থক্য করা হোক, সংঘাতের মূল বুনিয়াদ ধৰ্মীয় শিক্ষা নয়, শরিয়তও নয়, বরং সাম্রাজ্য। নিজেদের ভুল নীতি, সামরিক অভিযানের ফলে সৃষ্ট ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাকে পরে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে দেখাতে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কিছু কল্পিত বয়ান বুনতে হয়েছে। সেই বয়ান নিওকন থেকে প্রো-ইজরায়েল লবি নানা হাতে রচিত হয়ে গণমাধ্যম বা হলিউডে যায়। তাই প্যালেস্টাইনে জায়ন-বাদীদের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করলেও বিপক্ষের নেতারা অ্যান্টি-সেমিটিজম-এর আওতায় চলে আসেন! যদিও ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা প্রমাণ করল মুসলিমবিদ্বেষই নতুন বর্ণবাদ। আশার কথা, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডের্ন, বিলেতের জেরেমি করবিন, আমেরিকার বার্নি স্যান্ডার্স বা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অনেকেই এই ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সরব। আমাদের পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান কোন পথে যান সেটাই দেখার। 
লেখক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক 

[ এই সময়ের সৌজন্যে ]