আরব বিশ্বে ইসলামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যত কী ?

তিউনিসিয়ায় আন নাহাদা কর্মীরা - সংগৃহীত

  • মুনতাসীর মুনীর
  • ২২ মে ২০২২, ২১:০৪


মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলজুড়ে ইসলামপন্থী আন্দোলন, দল এবং সংগঠনের অবস্থা কখনোই খারাপ বলে মনে হয়নি। ২০১০-১১ আরব অভ্যুত্থানের পরে অল্প সময়ের জন্য রাজনৈতিক অনুকুল পরিবেশের শুভসূচনা দেখেছিল কিছু সুন্নি ইসলামি সংগঠন। তাদের অন্যতম মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তিউনিসিয়ার আন নাহদা। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসকদের বিদায়ের পর অবাধ নির্বাচনে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।


তবে তাদের এই সাফল্য ছিল স্বল্পস্থায়ী। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিশরের ব্রাদারহুডকে অপসারণ করা হয়। তারপর থেকে প্রতিবিপ্লবীরা মিশরসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থী আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। ইসলামপন্থীরা গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক চর্চা করলেও তাদেরকে অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সত্ত্বা এবং এমনকি সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।


মিশরের সেনা অভ্যুত্থানের এক দশকেরও বেশি সময় পরেও ওই অঞ্চলজুড়ে ইসলামী আন্দোলন নতুন করে দমনপীড়ন, রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণ এবং ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে ইসলামী রাজনীতি শেষ হয়ে যায়নি। ইসলামী দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতেও খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম বলে প্রমান হয়েছে। তাই বর্তমান অন্ধকার সময় তাদের পুনর্জীবনের সুযোগ হতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্ক লিঞ্চ মনে করেন, রাজনৈতিক ইসলামের বর্তমান বিপর্যয়ে কিছু স্পষ্ট প্রবণতা ধরা পড়েছে। প্রথমত, গণঅভ্যুত্থানের পরে ইসলামী আন্দোলনগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা পেয়েছে কিন্তু সেই সুযোগটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। তাছাড়া তারা দেশ শাসনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছ। কারণ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ক্রসেড পরিচালনা করছে। এতে ইসলামী আন্দোলনগুলো বৈধতা এবং সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে সংকটে পড়েছে। ইসলামপন্থীরা আবারও ব্যাপকভাবে পৈশাচিকতার শিকার হচ্ছেন। এটা তাদের রাজনৈতিক জীবনে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।


নতুন করে দমন-পীড়ন এবং ইসলামপন্থী নেতাদের জোরপূর্বক নির্বাসন ইসলামী আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামোর উপর একটি বড় আঘাত। ইসলামী আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল ঐতিহাসিকভাবে তাদের শক্তির উৎস। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং দলীয় শ্রেণীবিন্যাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানাতে মতাদর্শ, দিকনির্দেশনা এবং কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক বিচ্যুতি এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন ঘটেছে। এতে অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতি ইসলামপন্থীদের ঐতিহাসিক অঙ্গীকারের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।


ইসলামী আন্দোলন গভীর আদর্শিক এবং কৌশলগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ তাদের মধ্যপন্থী এবং শান্তিপূর্ণ পন্থায় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি কয়েক দশক ধরে তাদের বিকাশে সহায়ক ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটাই আবার তাদের ধ্বংস ও নিপীড়নের দিকে নিয়ে গেছে। তাই তাদের জনপ্রিয় ঘাঁটিগুলো পুনর্গঠনের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধে অসন্তুষ্ট তরুণ কর্মীদের সন্তুষ্ট করতে হবে। একইভাবে ইসলামী আন্দোলন অতীতে কঠিন পরিস্থিতিতেও অদম্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখনও একই ঘটনা ঘটতে পারে।


মুসলিম ব্রাদারহুড বিশে^র প্রাচীনতম ইসলামি আন্দোলন। তাদের বিভিন্ন সাংগঠনিক এবং আদর্শিক বৈশিষ্ট্য অনেক সমসাময়িক ইসলামপন্থী দল অনুসরণ করে থাকে। ১৯৫০ এর দশকের পর বর্তমানে দলটি সবচেয়ে কঠোর দমনপীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে। মিশরে ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতনের পর দলটি রাজনৈতিক ভাবে অল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল। পার্লামেন্টে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী বিজয় অর্জন করে দলটি। কিন্তু ২০১৩ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে এটি নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মধ্যে রয়েছে। দলটির হাজার হাজার শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং কর্মী-সমর্থককে হত্যা অথবা গ্রেফতার করা হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মীকে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে।
ব্রাদারহুড এখন অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি। তবে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দলটির পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর নির্বাসন নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, মতাদর্শগত সংশোধন এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত চিন্তাভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মিশরীয় সরকার বারবার ব্রাদারহুডের ওপর ক্রাকডাউন চালিয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্রাদারহুড দমন-পীড়ন প্রতিরোধ করার এবং একটি শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।


বাস্তবতা হচ্ছে ব্রাদারহুড দমনকে পুঁজি করতে শিখেছে। একে শক্তি ও সংহতির উৎসে পরিণত করেছে। স্বৈরাচারী সরকারগুলোর দমন দলটিকে একটি বৈধ বিরোধী সংগঠন হিসাবে ভাবমূর্তি শক্তিশালী করে জনসমর্থন জোগাড় করতে সাহায্য করেছে। এতে দলটির প্রতি সদস্যদের প্রতিশ্রুতি শক্তিশালী হয়েছে। এতে মূল আদর্শগত বৈশিষ্ট্য বা কৌশলের সঙ্গে আপোস করতে হয়নি। নেতাকর্মীরা শত প্রতিকূলতার মুখেও অটল থাকতে পেরেছেন। সাংগঠনিক শক্তি এবং সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তোলার মতো প্রতিরোধের হাতিয়ার এখনো আছে ব্রাহারহুডের। এর উপর ভিত্তি করে ব্রাদারহুড বর্তমান দমনপীড়ন সত্ত্বেও টিকে থাকার জন্য ভাল অবস্থানে রয়েছে।


তবে বর্তমান ক্র্যাকডাউনের এমন কিছু মাত্রা রয়েছে যা ব্রাদারহুডের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে গুণগতভাবে আলাদা করে তোলে। স্বৈরশাসক সিসির বর্বরতা ছিল অকল্পনীয়। সরকারে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতার পরপরই ব্রাদারহুড দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়। ফলে অনেক সদস্য দলটির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
দমনপীড়ন তরুণ সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং তাদের নিজস্ব উদ্যোগ, রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আনুগত্যের মতো মূল নীতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার গুরুত্বপূর্ণ দরজা খুলে দিয়েছে। ব্রাদারহুড নেতারা এখন নির্বাসনে। তাদের পুনরায় একত্রিত হয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আরেকটি গুরত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ২০১৩ সালের পর ব্রাদারহুডে মতবিরোধ দেখা যায়। তখন এর শ্রেণীবিন্যাস কাঠামো ক্রমবর্ধমানভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তবে নেতাকর্মীদের নির্বাসন তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। তুরস্কে অবস্থানরত সদস্যরা তাদের কার্যকলাপের জন্য আরও অনুকূল আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সুবিধা গ্রহণ করে।


ব্রাদারহুডের বিভাজন, নির্বাসনে থাকায় নিজেদের মধ্যে দূরত্ব এবং নারী ও যুবকদের নানা উপদল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। তবে এটি অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরে। এটা অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্রাদারহুডকে পুনরায় একত্রিত ও পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনার সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দলের তরুণ সদস্যরা এবং ব্রাদারহুডের নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আন্দোলন ত্যাগকারীরা আবার ধীরে ধীরে মূল সংগঠনে ফিরে আসছেন।
মনে রাখতে হবে ইসলামী আন্দোলন কোনো একক নেতার একচেটিয়া অবস্থানের জায়গা নয়। ব্রাদারহুড ২০১৩ সাল থেকে যে গতিপথ গ্রহণ করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে দলটি পুনরুজ্জীবনের পথে রয়েছে। এর সাংগঠনিক কাঠামো, আদর্শ, নেতৃত্ব এবং মূল্যবোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কেও দ্বার উদ্বুদ্ধ হয়েছে। দলটি সদস্যদের আত্মসমালোচনা থেকে কী শিক্ষা নেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।


ব্রাদারহুডের কর্মপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দলটি নিজেকে একটি অনন্য অবস্থানে খুঁজে পেয়েছে। তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত গতিপথকে সম্পূর্ণরূপে অনুধাবনের জন্য পর্যবেক্ষকদের ইসলামী আন্দোলনকে রূপদানকারী প্রধান সমসাময়িক শক্তিগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। এর জন্য একটি গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। মৌলবাদী এবং মধ্যপন্থীর মতো বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ইসলামী আন্দোলনকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে।


ইসলামী আন্দোলন নেতার একচেটিয়া অধিক্ষেত্র নয়। দলে স্বতন্ত্র সদস্যদের ভূমিকা আরো বাড়তে পারে। কীভাবে তারা রাজনীতি এবং আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশ্নের মোকাবিলা করছে তা গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট অনেক সময় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আদর্শিক মিলনে অবদান রাখে। এটা নতুন সহযোগিতা এবং জোট গঠনের দ্বার খুলে দেয়।কিছু বৈশ্বিক লক্ষণ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে ইসলামী রাজনীতির দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে তা নয়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে ব্রাদারহুডের মতো দলগুলো শেষ হয়ে যায়নি। তাদের পুনরুজ্জীবনের শক্তিশালী সুযোগ রয়েছে।