ইসরাইল প্রীতি : সৌদি রাজপরিবারে দ্বন্দ্ব

পিতা-পুত্রের প্রাসাদ বিজয় - তাসনিমনিউজ

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৬ অক্টোবর ২০২০, ১৮:২০

ইসরাইলের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়া নিয়ে সৌদি রাজ পরিবারে চরম বিবাদ শুরু হয়েছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। তবে তার বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছেন সৌদি বাদশাহ সালমান। পিতা-পুত্রের এই নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। আসুন, শুনি সেই গল্প।

সৌদি প্রাসাদের অভ্যন্তরে বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পর তাদেরও একই পথ অনুসরণ করা উচিত কিনা?

ইহুদি রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা নিয়ে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ তার ছেলে যুবরাজ মোহম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। আরব দেশগুলোর ইসরাইলকে বয়কট ও স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবির একনিষ্ঠ সমর্থক বাদশা সালমান। কিন্তু যুবরাজ চাচ্ছেন এসবকে অতীতের বিষয় হিসেবে রেখে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে জোট গঠন করতে।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দিলে হতবাক হয়ে পড়েন ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ। তখন সবে তিনি গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন শুরু করেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এবং সৌদি উপদেষ্টারা এসব তথ্য দিয়েছেন।

যুবরাজ কিন্তু বিস্মিত হননি। তিনি বরং আশঙ্কা করছিলেন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দাবির ব্যাপারে অগ্রগতি ছাড়া কোনো চুক্তি তার বাবা মানবেন না। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অর্থনীতি ও ইসলামের দুটি পবিত্রতম স্থানের অভিভাবক সৌদি বাদশাহর সমর্থন ছাড়া প্রতিবেশী আমিরাতের পক্ষে চুক্তির ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এ চুক্তির ব্যাপারে যুবরাজ তার বাবাকে আগেভাগে কিছুই জানাননি।

আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কোনো কথা নেই। বাদশা এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরবের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার জন্য।

এরপর বাদশার ঘনিষ্ঠ রাজপরিবারের একজন সদস্য সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ লেখেন। এতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি সৌদি আরবের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয় এবং ইসরাইলকে আরও ছাড় দিতে চাপ দেওয়ার জন্য আমিরাতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

রাজ পরিবারের সিনিয়র সদস্য সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘কোনো আরব দেশ আমিরাতের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে তার বিনিময়মূল্য দাবি করা উচিত। এবং সেটা হতে হবে খুবই উচ্চমূল্য।’ তুর্কি আল ফয়সাল যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিকম্পের মতো ব্যাপার হবে। এতে কয়েক দশকের প্যান-আরব অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে। এ ইস্যুতে সৌদি রাজ পরিবারের এই বিভক্তিতে মনে হচ্ছে সহসাই তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। আর অবস্থান বদলের সিদ্ধান্ত নিলে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

অবশ্য ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও ইসরাইলকে এক কাতারে নিয়ে আসতে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ইরান ও উপসাগরীয় ডেস্কের সাবেক পরিচালক ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইলকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এটা ঘটবে কিনা সেটা কোনো প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো এটা কবে ঘটবে। এজন্য ইসরাইলকে কত মূল্য দিতে হবে তা নিয়ে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সৌদি আরবের দর কষাকষি চলছে।

তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সৌদি আরব দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে। দুটি দেশ গত ৩০ বছর ধরে নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশেষ করে ইরান নিয়ে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে সৌদি আরবকে মাঝে মাঝেই প্রকাশ্যে এক কথা আর গোপনে আরেক কথা বলতে হয়।

বাদশা সালমান সৌদ রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে। তিনি জীবনভর দেখেছেন ইসরাইলের আরব ভূমি জবরদখল। এটা দেখে দেখে তার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে। সৌদি আরবে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত বাসেম আল আঘা জানান, বাদশাহ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন রিয়াদের গভর্নর। এসময় তিনি নিজেকে প্রায়ই সৌদি আরবে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলে পরিচয় দিতেন।

মিশর ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেওয়ায় ১৯৭৩ সালে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরে সৌদি আরব অন্যান্য আরব দেশকে নিয়ে অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে। জানানো হয় স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা মেনে নিলে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে রাজি এসব দেশ। এতোদিন পর্যন্ত এই অবস্থানই ছিল আরব দেশগুলোর। তবে এখন আমিরাত ও বাহরাইন ওই দাবি বাদ দিয়েই ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করল। এর আগে মিশর ও জর্ডানও ইহুদি রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।

কয়েক দশক যাবত ফিলিস্তিনিদের জন্য শত শত কোটি ডলার দান করেছেন বাদশা সালমান। ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ নেতার সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ওয়েস্টফাল ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালকে জানান, ২০১৭ সালে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার সময় বাদশা সালমান তাকে একটি বার্তা পাঠান। তাতে বাদশাহ লিখেন, তিনি ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকারে বিশ্বাস করেন। তবে ফিলিস্তিনিদেরও নিজেদের রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরবে যান। এ সময় রিয়াদ থেকে নজিরবিহীনভাবে ট্রাম্পের বিমান সরাসরি ইসরাইলের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। বাদশা আশা করেছিলেন, এ কারণে ট্রাম্প ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু শিগগিরই তাকে হতাশ হতে হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোন আলাপেও সৌদি বাদশা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করেন বলে সৌদি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।

তবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিসের অবস্থান কিন্তু বিপরীত মেরুতে। ২০১৭ সালে কার্যত সৌদি শাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তার আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করেন। পরে মধ্যরাতের এক প্রাসাদ অভ্যুত্থানে মাধ্যমে যুবরাজ হওয়ার পর থেকেই ৩৫ বছর বয়সী এমবিএস ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রণীত ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে ফিলিস্তিনি নেতাদের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেন। তবে ফিলিস্তিনি নেতারা তার চাপের কাছে নতিস্বীকার করেননি।

সৌদি যুবরাজের ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন খুবই দরকার। ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজিকে হত্যার পর সারা বিশ্বে তিনি নিন্দিত হন। এরপর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোনো দেশে সফরে যাননি। ট্রাম্প দম্ভ করে বলেছেন, এই কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি যুবরাজকে রক্ষা করেছেন।

নভেম্বরের নির্বাচনের আগে ট্রাম্প চাচ্ছেন আরও আরব দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করুক। এতে তার বিদেশনীতির সফলতার গল্প প্রচার করতে সুবিধে হয়। এজন্য ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার গত ১ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের নিয়মে বাদশা ও তার ছেলের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে যুবরাজ জানান যে তার বাবা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা মেনে নেবেন না।

বৈঠকের পর যুবরাজ কুশনারকে জানান, তিনি তাদের অনুগত বাহরাইনকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে বলতে পারেন। এরপরই ক্ষুদ্র মুসলিম দেশটি ইহুদিবাদী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়।

পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলছেন, সৌদি আরবে রয়েছে প্রচন্ড ইহুদি-বিদ্বেষ। তাদের পাঠ্যপুস্তকে ইুহদিদের কঠোর সমালোচনা রয়েছে। আলেমরা মসজিদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য মুনাজাত করেন। ইসরাইলকে ইহুদিবাদী শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে দেশটির গণমাধ্যম।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং নেতানিয়াহু। ছবি : তাসনিমনিউজ
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং নেতানিয়াহু। ছবি : তাসনিমনিউজ

 

সৌদি আরবে ১৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী রান্ডেল বলেন, বাস্তবতার নিরিখে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যুবরাজ তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছেন না। বরং তিনি চাচ্ছেন সৌদ রাজ পরিবারের অনুগত অন্যান্য আরব দেশ যেমন সুদান ও মরক্কো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করুক। সব দেশগুলো এ ইস্যুতে এক হলে সৌদিও এগিয়ে যাবে। আরবের শেষ দেশ হিসেবে সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেবে।

তবে যুবরাজের দুজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা জানান, তিনি ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি করতে চান। কিন্তু তিনি এটাও জানেন যে তার বাবা বাদশা সালমান বেঁচে থাকতে এটা সম্ভব নয়। তবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার ক্ষেত্র তৈরি করে রাখতে চান যুবরাজ। এজন্য তিনি সৌদি গণমাধ্যমগুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাত ও বাহরাইনের চুক্তির গুণগান করার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন সৌদি উপদেষ্টা বলছেন, যুবরাজ জনমত যাচাই করছেন এবং ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখছেন। জনগণ যাতে বুঝতে পারেন যে তিনি বাদশা হলে কী করবেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে