মধ্যপ্রাচ্যের মহান মধ্যস্থতাকরী

আরব লীগের একটি আয়োজনে কুয়েতের আমীর শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ - এএফপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৭ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৪৯

কুয়েতের আমীর শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ আর নেই। ৯১ বছর বয়সে গত মঙ্গলবার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটলো তাঁর প্রায় ৬০ বছরের শাসনের। সৃষ্টি হলো এক বিশাল কূটনৈতিক শূন্যতারও।

শেখ সাবাহ ছিলেন কুয়েতের দ্বিতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশের হয়ে এ গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৩ সালে তিনি হন কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে তিনি দেশের আমীর মনোনীত হন। এর আগে তাঁরই এক জ্ঞাতিভাইকে কুয়েতের আমীর বানানো হয়। কিন্তু মেডিক্যাল টেস্টে প্রমাণিত হয় যে, নতুন আমীর দেশ পরিচালনায় শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্ষম নন। ফলে মাত্র নয় দিনের মাথায় তাঁকে বাদ দিয়ে আমীর মনোনীত করা শেখ সাবাহকে।

শেখ সাবাহ আমীর হিসেবে ১৪ বছর কুয়েত শাসন করেন। এ সময় মানবিক কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সময় উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেকার নানা বিরোধ অবসানে মধ্যস্থতা করে তিনি আন্তর্জাতিক মহলের বিপুল প্রশংসা অর্জন করেন।

অবশ্য শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভেতরে অনেক জটিল সমস্যার সমাধানেও তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হতো। অনেকেই জানেন, আমীরশাসিত দেশ হলেও কুয়েতে আছে একটি সংসদ। ১৯৬১ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের দু'বছর পরই কুয়েতে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়। সে-হিসেবে এটি উপসাগরীয় এলাকার প্রাচীনতম সংসদ। ওই এলাকার আর মাত্র একটি দেশেই সংসদ আছে। যাহোক, এ সংসদের সাথে কুয়েতের শাসক পরিবারের টানাপোড়েন প্রায়ই লেগে থাকে। আর সেই ঝামেলা মেটানোর জটিল কাজটি পড়তো আল সাবাহর কাঁধেই।

আমীরশাসিত দেশ হয়েও সংসদীয় ব্যবস্থা রাখার এ পদ্ধতি, বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ায়, 'কুয়েত মডেল' নামে পরিচিতি পায়। পাশ্চাত্য জগত মনে করে, গোত্রীয় আইনকানুনে পরিচালিত একটি ট্র্যাডিশনাল সোসাইটি কী করে গণতন্ত্রায়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় এলাকার অন্যান্য দেশের জন্য এই মডেলটি হতে পারে তার এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

কুয়েতের ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন আমীর, আর অন্য মন্ত্রীদের মনোনীত করেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচিত ডেপুটি বা সংসদ সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে যে-কোনো মন্ত্রীকে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও পদচ্যূত করার অধিকার রাখেন। উপসাগরীয় এলাকার আর কোনো দেশে এমন কিছুর কথা ভাবাই যায় না।

তবে তাই বলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কুয়েতের সংসদ সার্বভৌম - এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। বলে রাখা প্রয়োজন যে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই হবেন শাসক পরিবারের সদস্য; এর বাইরে কারো পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। আর দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীও শাসক আল সাবাহ পরিবার। তাহলে সংসদের কাজ কী - এমন প্রশ্ন কারো-না-কারো মনে জেগেই থাকে। এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন শিক্ষাবিদ মাইকেল হার্ব। তিনি কুয়েতের সংবিধান বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, যে মন্ত্রীকে পছন্দ হয় না, তাকে টেনে নামানোর নেতিবাচক ক্ষমতা রয়েছে জাতীয় সংসদের। আর এ ক্ষমতা চর্চা করতে গিয়েই তৈরি হয় যতসব ঝামেলা।

জাতীয় সংসদের এ নেতিবাচক ক্ষমতার সাথে বেশ ভালোই পরিচয় ছিল সদ্যপরলোকগত আমীর আল সাবাহর। তাই উদ্ভূত সমস্যার সমাধানও করতে পারতেন তিনি। আর পরিস্থিতি বেশি জটিল হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতেন। আর এভাবেই আল সাবাহর শাসনামলের প্রথম সাত বছরে ছয়টি সংসদ বিলুপ্ত এবং ছয়টি নতুন নির্বাচন হতে দেখা যায়।

সংসদ ভেঙে দেয়ার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ২০১৬ সালে। ওটি ছিল তাঁর আমলের সপ্তম সংসদ। ওই সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্যরা তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করার এবং সরকারের বিরুদ্ধে আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিষয়টি জানামাত্র দ্রুত পদক্ষেপ নেন আমীর। তিনি সংসদ বিলুপ্ত করে দেন এবং নতুন নির্বাচন আহবান করেন।

তারপর থেকে শুরু হয় বিরোধীদের ওপর জুলুম-নিপীড়নের এক নতুন অধ্যায়। বিরোধীদের অনেককেই জেলে পোরা হয়, কেউবা আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, আবার কারো কারো নাগরিকত্ব কেরে নেয়া হয়। সব মিলিয়ে কুয়েতের সংসদে এক ধরনের ''শান্তি'' নেমে আসে। ফলে মনে করা হচ্ছে, বহু বছরের মধ্যে কুয়েতের এবারের সংসদটি তার মেয়াদ পূরণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে আগামী নভেম্বরে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।

আল সাবাহর সবচাইতে বড় সাফল্য পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আমীর - উভয় দায়িত্বে থেকেই তিনি আঞ্চলিক কূটনীতিতে অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং সময়ে কুয়েতের জন্য একটি মধ্যপন্থা বেছে নিতে পেরেছিলেন। যেমন, ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লব, এরপর ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ১৯৯০ সালে ইরাকী একনায়ক সাদ্দামের কুয়েত আগ্রাসন, ১৯৯১ সালে কুয়েতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং শাসক পরিবারের দেশে ফিরে আসা। দেশে ফেরার পর তাদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন।

কুয়েত মুক্ত হওয়ার পর সেখান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষপাতি ছিলেন আল সাবাহ। কিন্তু উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি-র অন্য সদস্য দেশগুলো এটা চায়নি। শেখ সাবাহকে কেন ''দ্য গ্রেট ব্যালান্সার'' বা মহান ভারসাম্য রক্ষাকারী বলা হয়, এটি তার একটিমাত্র উদাহরণ। ইয়েমেন যুদ্ধেও তিনি প্রথমে সউদি-আমীরাত নেতৃত্বাধীন জোটে ছিলেন। পরে এ বিরোধে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন, যদিও তার সেই চেষ্টা ফলবতী হয়নি।

তবে বিভিন্ন সময় জিসিসি দেশগুলোর মধ্যেকার নানা বিরোধ মেটাতে তিনি সফল হন। এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের কাতার বিরোধের কথা বলা যায়। ওই সময় কাতারের সাথে সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত ও বাহরাইনের কূটনৈতিক বিরোধ চরমে ওঠে। পরে শেখ সাবাহর হস্তক্ষেপে এর সফল সমাধান হয়।

ওই বছরের মার্চ মাসে ওই তিন দেশ কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল সউদি আরবের। সউদিরা কাতারের টিভি চ্যানেল আল জাজিরার ভূমিকা এবং কাতারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামাদ বিন জসিমের উদ্যমী ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। শেখ সাবাহর দক্ষ হস্তক্ষেপে আট মাস পরে দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।

ছবিটি ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চের। দুই কুয়েতি অসহায় তাকিয়ে দেখছেন ইরাকি আগ্রাসনে নিজের দেশের একটি তেলক্ষেত্র পুড়ে যাচ্ছে। ছবি : এএফপি
ছবিটি ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চের। দুই কুয়েতি অসহায় তাকিয়ে দেখছেন ইরাকি আগ্রাসনে নিজের দেশের একটি তেলক্ষেত্র পুড়ে যাচ্ছে। ছবি : এএফপি

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উপসাগরীয় এলাকার রাজনৈতিক মঞ্চে অনেক পরিবর্তন আসে। জঙ্গিবাদী সংগঠন আইএস-এর উত্থান ঘটে। ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং দেশটির বিরুদ্ধে স্থল, আকাশ ও নৌপথে অবরোধ আরোপ করে সউদি আরব, বাহরাইন, আমীরাত ও মিশর। এর মধ্য দিয়ে মূলত ভেঙ্গে যায় জিসিসি। পরিস্থিতি এমন হয় যে, মনে করা হতে থাকে, এ চার দেশ যে-কোনো মুহূর্তে কাতারে আগ্রাসন চালাতে পারে।

কুয়েতের আমীর শেখ সাবাহ জানেন, এমন আগ্রাসনের পরিণাম কেমন ভয়াল হতে পারে। কারণ, তাঁর দেশই তো ১৯৯০ সালে ইরাকী আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল। সম্ভাব্য কাতার আগ্রাসনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সক্রিয় হয়ে ওঠেন শেখ সাবাহ। তাঁর বয়স তখন ৮৮ বছর। তখন গ্রীষ্মকাল এবং রমজান মাস। প্রচণ্ড গরম এবং রোজার ক্লান্তি - সব উপেক্ষা করে এই বয়সেই তিনি ছুটে যান দোহা, আবু ধাবী ও রিয়াদে।

এক্ষেত্রে শেখ সাবাহ যেমন সফল হননি, তেমন আবার ব্যর্থও হননি। তাঁর দূতিয়ালি সফল হয়নি এ অর্থে যে, বিরোধের অবসান ঘটেনি। আবার সফল এ অর্থে যে, বিরোধ আর বাড়েনি এবং কোনো খারাপ দিকে মোড় নেয়নি। তবে বার বার চেষ্টা করেও এ বিরোধ স্থায়ীভাবে মীমাংসা করতে না-পারার কষ্ট তিনি আজীবন বুকে পুষেছিলেন।

সেই মানুষটি আজ আর নেই। কুয়েত এখন পাবে নতুন শাসক। কিন্তু শেখ সাবাহর অভাব তাঁর দেশ তো বটেই, পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে বহু কাল অনুভূত হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে