লিবিয়া জ্বলছে এক সেবাদাসের প্রতিহিংসায়

খলিফা হাফতার - টিআরটি ওয়ার্ল্ড

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৭:১৪

এক দেশের বিরুদ্ধে অপর এক বা একাধিক দেশকে লেলিয়ে দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের নোংরা খেলা বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রায়ই দেখা যায়। আর এ কাজে খেলোয়াড়দের লাগে একজন 'ফ্রাইডে ম্যান' বা সেবাদাস।

না-বললেও যে-কেউ বুঝতে পারেন, একদা সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় আজ চলছে ক্ষমতার রাজনীতির সেই নোংরা খেলা আর তাতে সেবাদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন জেনারেল খলিফা হাফতার। প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই খলিফা হাফতার?

হাফতারের জন্ম ১৯৪৩ সালে। ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে লিবিয়ার তৎকালীন রাজা ইদ্রিসকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল গাদ্দাফী। ওই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন হাফতার। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে যান গাদ্দাফীর শীর্ষ মিলিটারি অফিসার। ১৯৮০র দশকে গাদ্দাফী তাকে দায়িত্ব দেন শাদ নামের প্রতিবেশী দেশটি দখলের। ওই অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৯৮৭ সালে কয়েক শ' লিবিয়ান সৈন্যের সাথে শাদে বন্দী হন হাফতারও। বিস্ময়করভাবে গাদ্দাফী এ সময় হাফতার ও তার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে বলেন, এ অঞ্চলের কোথাও লিবিয়া কোনো সৈন্য পাঠায়নি। পরে মার্কিন হস্তক্ষেপে মুক্তি পান হাফতার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দেয়। পরবর্তী ২০ বছর তিনি ভার্জিনিয়ায় সিআইএ সদর দফতরের কাছাকাছি এক জায়গায় বসবাস করে কাটান।

এ-ই হলেন হাফতার, এ-ই হলো তার জীবন-ইতিহাস। গত পাঁচ বছর ধরে এই যুদ্ধবাজ নেতা লড়ে যাচ্ছেন সেসব দেশের হয়ে, লিবিয়ায় যুদ্ধ না-থামলেই যাদের লাভ। এ কাজে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদি আরব, ফ্রান্স, রাশিয়া ও মিশরকে এক ছাতার নিচে আনতে অর্থাৎ বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে ওদের আর তার পররাষ্ট্রনীতির অভীষ্ট লক্ষ্য একই।

হাফতারের তোষামোদি কাজে লেগেছে। উপরে উল্লেখিত সব দেশ তাকে অকাতরে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে চলেছে আর এর সাহায্যে সংঘাতক্ষুব্ধ দেশটির নানামুখী বিরোধ ও সহিংসতায় ইন্ধন যুগিয়ে চলছেন হাফতার।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হাফতারের জড়িয়ে পড়া ২০১৫ সালে। সেই তখন থেকেই দেশটির জাতিসংঘ-স্বীকৃত জাতীয় চুক্তি সরকার বা জিএনএ-র নেয়া সকল শান্তি উদ্যোগ পণ্ড করে দিয়ে হাফতার লিবিয়াকে ঠেলে দিয়েছেন গোত্রীয় সংঘাতের আরেক দুষ্টচক্রে।

আগেই বলা হয়েছে, হাফতার সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদি আরব, ফ্রান্স, রাশিয়া ও মিশরকে তার পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না, যখন তারা দেখেন, ইরানও হাফতারের পক্ষ নিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সউদি আরবের মতো দেশগুলোর সাথে ইরানের দীর্ঘ দিনের বৈরিতা। ওসব দেশ যেদিকে যায়, ইরান চলে তার উল্টোপথে। অথচ কী আশ্চর্য, হাফতারের বেলায় সবাই কিনা এক!

সম্প্রতি বিভিন্ন সূত্রের খবরে বলা হয়েছে, হাফতারকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে ইরান। এর মধ্যে আছে 'দেহলভিয়েহ' নামের অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল সিস্টেম। হাফতারের বাহিনীর মিলিশিয়ারা ইতিমধ্যে সেগুলো ব্যবহার করতেও শুরু করেছে।

কোনো-কোনো খবরে বলা হয়, সাঙ্গপাঙ্গরা যখন ইরানের মদদ লুটছে, হাফতার তখন বিনা দ্বিধায় গোপন বৈঠক করে চলেছেন ইসরাইলী কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ইরান ও ইসরাইল তো পরস্পরের ঘোষিত শত্রু, তারপরও ইরান মনে হয় আপাতত ওদিকে নজর না-দিয়ে চুপচাপ হাফতারকে সমর্থন দিয়ে যাবে বলেই স্থির করেছে।

এবার দেখা যাক, এই জঙ্গি নেতা এসব দেশের কাছ থেকে কী ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন।

প্রথমে আসা যাক ইসরাইল প্রসঙ্গে। হাফতার সম্প্রতি তার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক নিয়ে একটি সতর্ক বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না-করেই মিডিয়া বলছে, ইসরাইল সরকার ও তার গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনেকবার ব্যাকডোর মিটিং বা গোপন বৈঠক করেছেন হাফতার।

মিডিয়ার খবরে বলা হয়, ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে আমিরাতের মধ্যস্থতায় এ রকম এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে-সময় হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ-কে অস্ত্র যোগান দিতে রাজি হয় ইসরাইল। স্থির হয়, অন্যান্যের মাঝে এ চালানে থাকবে স্নাইপার রাইফেল এবং নাইট ভিশন ইকুইপমেন্ট।

অনেকে বলে থাকেন, হাফতারকে ইসরাইলের সমর্থনের কারণ হচ্ছে, হাফতার লড়ছেন তথাকথিত ইসলামী চরমপন্থা এবং দায়েশ বা আইএস-এর বিরুদ্ধে। কিন্তু মার্কিন সাংবাদিক রিচার্ড সিলভারস্টেইনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার চাইতেও হাফতারের 'রাজনীতির' বড় লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। সিলভারস্টেইন তাঁর প্রতিবেদনে ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি সূত্রের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সূত্রটি বলে, ''আমাদের বন্ধুর বন্ধু এবং শত্রুর শত্রু হচ্ছে আমাদের বন্ধু। হাফতার হচ্ছেন মিশর, জর্দান ও আমিরাতের বন্ধু এবং দায়েশের শত্রু। অতএব তিনি আমাদের বন্ধু।''

ইসরাইলের কাছে লিবিয়ার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। হাফতারকে ইসরাইলের সমর্থন দেয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের নৌপথগুলো ধরে রাখা। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য ওখানকার সম্পদশালী দ্বীপাঞ্চলে পাইপলাইন বসিয়েছে ইসরাইল। এছাড়াও তেলসমৃদ্ধ বিভিন্ন অঞ্চল এখনও হাফতারের দখলে। কাজেই হাফতারকে সমর্থন দিলেই ইসরাইলের লাভ।

রাশিয়ার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে বেশ গোলমেলে। দেশটি একদিকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টায় খোলাখুলি সমর্থন দিচ্ছে, অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদের এক বিবৃতির বিরোধিতা করেছে, যে বিবৃতিতে ত্রিপলি অভিমুখে অগ্রসর হতে হাফতারকে বারণ করা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রাশিয়ার কুখ্যাত ওয়াগনার গ্রুপের দুই হাজারের বেশি ভাড়াটে যোদ্ধা লিবিয়ায় লড়াই করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট।

লিবিয়ায় রয়েছে জ্বালানি তেলের বিশাল মজুদ। আফ্রিকা মহাদেশের চতুর্থ-বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদও রয়েছে ওই দেশেই। রাশিয়া চাচ্ছে লিবিয়ার সাথে তেল উত্তোলন ও বিভিন্ন নির্মাণকাজের চুক্তি করতে। এ কারণেই তারা হাফতারের পক্ষে লড়াই করতে এক ডজনেরও বেশি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে বলে নানা সময়ে প্রমাণ মিলেছে। অবশ্য এ অভিযোগ একেবারেই স্বীকার করে না রাশিয়া।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের ভূমিকাও দ্বিমুখী। দেশটি সরকারিভাবে লিবিয়াসঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। কিন্তু ফরাশি পত্রিকা 'লা মঁদ'-এর এক খবরে বলা হয়, জঙ্গি নেতাকে পুরোপুরি অস্ত্রসজ্জিত করতে ফ্রান্স কাজ করছে। এমনকি হাফতারের মিলিশিয়া বাহিনীকে ট্রেইনিং দিতে স্পেশ্যাল ফোর্স পর্যন্ত মোতায়েন করেছে ফ্রান্স।

ফ্রান্স এসব বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও ২০১৯ সালের জুলাইয়ে পেন্টাগনের এক তদন্তে প্রকাশ পায়, হাফতার বাহিনীকে আমেরিকায় তৈরী অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল সরবরাহ করেছে ফ্রান্স। এসব মিসাইলের প্রতিটির দাম এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র এসব মিসাইল ফ্রান্সের মতো ''অতি কাছের বন্ধু দেশ'' ছাড়া কারো কাছে বিক্রি করে না।
হাফতার ও তার মিলিশিয়াদের আরেক কট্টর মদদদাতা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমীরাত। হাফতার বাহিনী আকাশযুদ্ধে আমীরাতের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আমীরাতও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই হাফতার বাহিনীকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যোগান দিয়ে চলেছে। জাতিসংঘের একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তার সত্যতা মিলেছে। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আমিরাতের বিভিন্ন কোম্পানি হাফতার বাহিনীকে ১১ হাজার টন জেট ফুয়েল সরবরাহ দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। এসব জেট ফুয়েলের বাজারমূল্য ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।

জঙ্গি নেতা হাফতারকে মদদ যোগানোর কাজে আমীরাতের পাশেই আছে সউদি আরব। 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ত্রিপলি সরকারকে উৎখাতের জন্য হাফতারকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিচ্ছে সউদি আরব। ওই টাকায় উপজাতীয়দের আনুগত্য কিনছেন, যোদ্ধাদের বেতন দিচ্ছেন এবং অন্যান্য সামরিক ব্যয় নির্বাহ করছেন হাফতার।

আমিরাত ও সউদি আরবকে অনুসরণ করে হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছে মিশরও। মিশরের সাথে লিবিয়ার রয়েছে দীর্ঘ স্থল সীমান্ত। এ সীমান্তপথ ব্যবহার করে তারা হাফতারের কাছে সব রকম সাহায্য পাঠাতে পারে এবং পাঠাচ্ছেও। সম্প্রতি মিশরের স্বৈরশাসক আল সিসি দাবি করেছেন, লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং হাফতারের মিলিশিয়াদের সাহায্য করার বৈধ অধিকার মিশরের আছে।

আর ইরানের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। একদিকে তারা ত্রিপলি সরকারকে সমর্থনের প্রকাশ্য ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে তলে তলে হাফতারকে সহায়তা দিচ্ছে বলেও খবর মিলছে।

হয়তো এর নামই রাজনীতি। এই অপরাজনীতির আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে লিবিয়া।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে