আয়া সোফিয়া কেন মসজিদে রূপান্তর করলেন এরদোয়ান

আয়াসোফিয়া - আনাদুলু

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১২ জুলাই ২০২০, ১২:৪৭

 

ইস্তাম্বুলের বিশ্বখ্যাত জাদুঘর ‘আয়া সোফিয়া’কে আবার মসজিদে রূপান্তর করেছে তুরস্ক। হাজার বছর ধরে অর্থডক্স খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় স্থাপনা ছিল এটি। এরপর প্রায় ৫০০ বছর মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গত ৮৫ বছর এটি ছিল জাদুঘর। তুরস্কের প্রধান প্রশাসনিক আদালতের রায়ের পর প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোয়ান একে মসজিদে রূপান্তরের আদেশ দিয়ে ডিক্রি জারি করেছেন। এখানে আবার ধ্বনিত হয়েছে আজানের সুর। প্রশ্ন উঠছে, তুরস্ক সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিলো? এ সিদ্ধান্ত কী ধর্মীয়, নাকি রাজনৈতিক নাকি জাতীয় গর্বের?

তুরস্কের শীর্ষ প্রশাসনিক আদালত বা দ্য কাউন্সিল অফ স্টেট আয়া সোফিয়ার জাদুঘরের মর্যাদা নাকচ করেছেন। এরপরই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ স্থাপনাকে মসজিদ হিসাবে মুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। আয়া সোফিয়াকে ফের মসজিদে রূপান্তরের ডিক্রি জারি করে টুইটারে এরদোগান লিখেছেন ‘হাইরলি ওলসান’। এর অর্থ অভিনন্দনা। তিনি তুর্কি জাতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

এরপর জাতির উদ্দেশে ভাষণে এরদোগান আয়া সোফিয়ার এই রূপান্তরকে ‘পুনরুত্থান’ বলে মন্তব্য করেছেন। এরদোয়ান বলেছেন, আয়া সোফিয়া আগের মতই সব ধর্মাবলম্বীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আগামী ২৪ জুলাই জুমার নামাজের মাধ্যমে এটি আবার মসজিদে রূপ নেবে। অমুসলিম ও ভিনদেশী নির্বিশেষে আয়া সোফিয়া আবার সবাইকে আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করবে। এখন থেকে আয়া সোফিয়া পরিদর্শনে কোনো ফি লাগবে না বলেও ঘোষণা দেন এরদোয়ান।

এরদোয়ান বলেছেন, মুসলিমরা কনন্ট্যান্টিনোপল দখলের পর থেকেই এখানে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, তুরস্ক অমুসলিমদের ধর্মীয় স্থানগুলোর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলেছে। অথচ পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলে উসমানীয় খেলাফত আমলের পুরার্কীতিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এরদোয়ান বলেছেন, আয়া সোফিয়াকে মসজিদের রূপান্তরের মাধ্যমে আল আকসা মসজিদ মুক্ত করার পথ উš§ুক্ত হলো। মুসলিমদের কাছে তৃতীয় সর্বোচ্চ পবিত্রতম এই মসজিদটি ইসরাইল অবরুব্ধ করে রেখেছে। রায় ঘোষণার পর আয়া সোফিয়া থেকে আবার আজান দেওয়া হয়েছে। তুরস্কের সব সংবাদ চ্যানেলে তা সম্প্রচারও করা হয়। এর আগে অনেক মানুষ আয়া সোফিয়ার বাইরে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেন। বহু মানুষ বাইরে সমবেত হয়ে নামাজ আদায় করে।

বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে ষষ্ঠ শতকে আয়া সোফিয়া নির্মিত হয়। এরপর থেকে প্রায় এক হাজার বছর ধরে অর্থোডক্স খ্রিস্টানাদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল এটি। অটোম্যান শাসক ফাতিহ সুলতান মেহমেত ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল দখল করে এই গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তর করেন। ৫০০ বছর ধরে এটি মসজিদ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় পাঁচশ বছর পর তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল আতার্তুক ১৯২০ সালে এটিকে জাদুঘরে পরিণত করেন।কট্টর সেক্যুলার আতাতুর্কের এই সিদ্ধান্ত ইসলামপন্থীরা কোনোদিনই মেনে নেননি।

প্রশাসনিক আদালত রায়ে বলেছে, এই স্থাপনা মসজিদ হিসেবেই বরাদ্দ ছিল। এর বাইরে অন্য কিছু হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা আইনগতভাবে সম্ভব নয়। ১৯৩৪ সালে মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার বন্ধ করে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভা নিয়েছিল তা আইনসঙ্গত নয়।

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য আয়া সোফিয়াকে গত বছরের এক নির্বাচনী সমাবেশে মসজিদে পরিণত করার তাগাদা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। সমর্থকদের দাবীর মুখে এই পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান তিনি। তুরস্কের ইসলামপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরেই স্থাপনাটিকে ফের মসজিদে রূপান্তরের দাবি জানাচ্ছেন।

এরদোয়ান বলেছেন, আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক ‘বিরাট ভুল।’ এর পর তিনি তার সহযোগীদের নির্দেশ দেন কিভাবে ভবনটিকে মসজিদে পরিণত করা যায় তা খতিয়ে দেখতে। গত মাসে ১৪৫৩ সালে অটোমানদের কন্টানটিনোপল জয়ের বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়া সোফিয়ার ভেতরে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়৷


আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরের সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বলেছে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের আদালত তাদের উদ্বেগ বিবেচনায় নেয়নি। এ সিদ্ধান্ত আরও বড় পরিসরে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। তবে একে ফের মসজিদে রূপান্তর করার পক্ষের লোকেরা বলছেন, এরফলে উসমানীয় খেলাফতের সঠিক ইতিহাস প্রতিফলিত হবে। উসমানীয় খেলাফতেরই উত্তরসূরী হচ্ছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। এর মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট হবে যে তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট্র রাষ্ট্র। তবে প্রশ্ন উঠছে, আয়া সোফিয়া মসজিদে রূপান্তরিত হওয়ার পর এতে খ্রিস্টানদের যেসব প্রতিকৃতি রয়েছে সেগুলোর কি হবে।

আয়া সোফিয়ার মধ্যে রয়েছে যিশু খ্রিস্ট ও তার মা ম্যারির প্রতিকৃতি এবং বাইজেন্টাইন শাসকদের ছবি। ইসলামে মসজিদে মানুষ বা প্রাণীর প্রতিকৃতি রাখা নিষিদ্ধ । এ সমস্যা সমাধানে তুরস্ক সরকার লাইট ম্যাপিং প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। এতে শুধু নামাজের সময় এসব প্রতিকৃতি ঢেকে যাবে। নামাজ শেষে আবার সেগুলো স্বাভাবিকরূপেই দেখা যাবে। এছাড়া এই মসজিদ সবার জন্য খোলা থাকবে।

অনেক সমালোচক বলছেন, প্রায় ১৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার এরদোয়ান জনপ্রিয়তা বাড়াতে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে দেশটির অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এর সঙ্গে রাজনীতি বা ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগ খুবই সামান্য। বরং আয়া সোফিয়াকে মসজিদের রূপান্তর তুরস্কের জাতীয় গর্বের প্রতীক। তুরস্কেও বিরোধী সেক্যুলার ও বামপন্থী দলগুলোও এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেনি।

কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জনমতকে উপেক্ষা করে একে জাদুঘর বানালেও বহু তুর্কি নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তবে তুরস্কের কট্টর সেক্যুলার শাসনে ইসলামপন্থীদের মতামতকে যুগের পর যুগ উপেক্ষা করা হয়েছে। ৫৫ বছর আগে তুরস্কের বিখ্যাত সাহিত্যিক নেসিপ ফজিল কিসাকুরেক লিখেছিলেন, ‘ অপেক্ষা কর তরুণেরা, আজ অথবা কাল আয়া সোফিয়া খুলবেই।’

তুরস্কের কলামিস্ট হুসেন গুলেরস রায়ের পর ৩০ বছর আগে তার লেখা একটি নিবন্ধ একটি দৈনিকে পুনঃপ্রকাশ করেছেন। ওই নিবন্ধে তিনি আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তকে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের কাছে নতিস্বীকার বলে মন্তব্য করেন। তিনি একে তুরস্কের স্বাধীনতার ওপর কালো ছায়া বলে উল্লেখ করেন। গুলেরস লিখেছেন, আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর বানিয়ে তুরস্ককে তার ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, জাতীয় মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বিচ্ছিন করে ফেলা হয়। তিনি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য কি ভাববে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আয়া সোফিয়াকে খুলে দিলে খুশি হবে মর্যাদাশীল তুর্কি জাতি।

বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম পাড়ে ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় গম্বুজশোভিত এই বিশাল ঐতিহাসিক ভবনটি খুব সহজেই দর্শকদের নজর কাড়ে। স¤্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে এই আয়া সোফিয়া নির্মাণ শুরু হয়েছিল ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ইস্তাম্বুল শহরের নাম তখন ছিল কনস্টান্টিনোপল। এটা ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী, যাকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যও বলা হয়। এই সুবিশাল ক্যাথেড্রাল তৈরির সময় তখনকার প্রকৌশলীরা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। আয়া সোফিয়া নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চেরপ্রধানের অবস্থান। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।

প্রায় ৯০০ বছর ধরে আয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু । অবশ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিকরা এক অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা তখন আয়া সোফিয়াকে একটি ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালে পরিণত করেছিল।

কিন্তু ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের ওসমানী সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এর নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। চিরকালের মত অবসান হয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের। আয়া সোফিয়ায় ঢুকে বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ নির্দেশ দেন এটাকে সংস্কার করে একটি মসজিদে পরিণত করতে। তিনি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্মতিতে এটি করেন। এই ভবনে প্রথম শুক্রবারের জুমা নামাজ পড়েন। পড়ে তিনি এটি ওয়াকফ করেন। ওসমানী স্থপতিরা আয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থডক্স খ্রিস্টান ধর্ম সংশিষ্ট বিভিন্ন প্রতীক-চিহ্নগুলো ঢেকে ফেলেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয়উঁচু মিনার।

ইস্তাম্বুলে ১৬১৬ সালে ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত আয়া সোফিয়াই ছিল শহরের প্রধান মসজিদ। নীল মসজিদ সহ এ শহরের এবং বিশ্বের অন্য বহু মসজিদের নির্মাতাদের অনুপ্রানিত করে এর স্থাপত্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সালে শেষ হলে ওসমানী সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো তাদের ভূখন্ডকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলে। তবে ওই সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকেই জাতীয়তাবাদী তুর্কী শক্তির উত্থান হয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক তুরস্ক।

তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এই মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করেন এবং আয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে পরিণত করার ডিক্রি জারি করেন। আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৫ সালে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এটি তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থলে পরিণত হয়। ২০১৯ সালে ৩৭ লাখ লোক এ স্থাপনাটি পরিদর্শণ করেন। এর ভেতরে গির্জা ও মসজিদ, ইউরোপীয় ও অটোমান উভয় সংস্কৃতির ছাপ দেখা যায়৷

তুরস্কের ভেতরে এবং বাইরে বহু গোষ্ঠীর জন্য আয়া সোফিয়ার ১ হাজার ৫০০ বছরের ইতিহাস ব্যাপক ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।