জেলেদের দেশ ওমানকে যেভাবে আধুনিক ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করেন সুলতান কাবুস

ওমানের শাসক সুলতান কাবুস -সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ১২:৪২

ওমানের শাসক সুলতান কাবুস বিন সাইদ মারা গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি ছিলো কাবুসের। যিনি একই সাথে সৌদি আরব, ইরান ও ইসরাইলের সাথে এক ধরনের ভারসাম্যমুলক সর্ম্পক বজায় রেখে চলেছেন।


সুলতান কাবুস ১৯৭০ সালে যখন ওমানের সিংহাসনে আরোহন করেন তখন দেশটিতে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা আর তিনটি স্কুল ছিল। কৃষক আর জেলেদের দেশ হিসেবে পরিচিত ওমানে তখন অবকাঠামো বলতে তেমন কিছু ছিল না। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ওমান তখন দারিদ্র্য পীড়িত একটি দেশ। কিন্তু সেই গরিব ওমান আজ আরব বিশ্বের একটি আধুনিক ধনি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। উন্নত অবকাঠামো আর নাগরিকদের স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য ওমান অন্যতম সুখী আর শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। ওমানের আজকের যত পরিচিতি তার মুলে রয়েছেন সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ।


সুলতান কাবুসের শিক্ষা জীবন কাটে বৃটেনে । তিনি বিটিশ সেনাবাহিনীরও একজন সদস্য ছিলেন। বৃটেন থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে একজন আধুনিক উদারমনা যুবক হিসেবে ফিরে আসেন রক্ষনশীল ওমানে। দেশ গঠনে তিনি কাজে লাগান তার শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তা চেতনা। ক্ষমতা আরোহনের পরপরই কাবুস মনোনিবেশ করেন ওমানের তেল সম্পদ ব্যবহারের দিকে। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যেগ নেন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ওমানকে টেনে বের করে আনলেন বিশ্ব দরবারে।


অশিক্ষিত জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি মনোযোগ দিলেন শিক্ষায়। গড়ে তুলতে লাগলেন দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের অবকাঠামো। তেলের আয় দিয়ে গড়তে লাগলেন রাস্তা ঘাট, নদী বন্দর, বিমান বন্দর, হাসপাতালসহ নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশনসহ সব দিক দিয়ে দেশকে একটি শক্ত অবকাঠামো ও ভিত্তির ওপর দাড় করালেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও তিনি উৎসাহিত করলেন । ফলে গড়ে উঠতে লাগল ব্যাংক, হোটেল, ইনস্যুরেন্স, পর্যটন অবকাঠামোসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান।
ওমান আজ পর্যটকদেও অন্যতম একটি ঠিকানা। ক্ষমতায় বসেই প্রথমে কাবুস উচ্ছেদ করলেন বিদ্যমান দাস প্রথা। রচনা করলেন সংবিধান। প্রিন্ট মিডিয়াকেও তিনি তখন একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌছার সুযোগ দিলেন। দ্রুত পাল্টে গেল দেশের অথনৈতিক চেহারা।


ওমানকে আজকের একটি উদার, আধুনিক আর ধনি রাষ্ট্রের কাতারে পৌছানোর জন্য অনেক সুবিধাও পেয়েছেন কাবুস। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে একটানা দেশ শাসনের সুযোগ। এ ক্ষেত্রে তিনি উপভোগ করেছেন একচ্ছত্র আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা। আর একটানা দীর্ঘ ৫০ বছর দেশ শাসনের রেকর্ড গড়ে তিনি আরব বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি গোটা বিশ্বেও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসকে পরিণত হন। ৭৯ বছর বয়সে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর আলোচনায় এসেছেন আরব বিশ্বের নিভৃতে থাকা এ শাসক।


ওমান একটি বিশাল আয়তনের দেশ হলেও জনসংখ্যা মাত্র ৪৬ লাখ। আর এর মধ্যে ৪৩ ভাগ হলো বিদেশী নাগরিক। ওমানের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগনেরও বেশি তথা এক লাখ ১৯ হাজার ৫শ বর্গমাইল। ফলে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদকে তিনি দেশটির এ সীমিত জনসংখ্যার ভাগ্য উন্নয়নে কাজে লাগাতে পেরেছেন।


১৯৭০ সালে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত কনে সিংহাসনে বসেন কাবুস। তখন কাবুসের বয়স ২৯ বছর। কাবুসের পিতা সাঈদ বিন তাইমুরের বিরুদ্ধে অবুভ্যুত্থানে মূল ভূমিকা পালন করে বৃটেন। কাবুসের পিতা ছিলেন অতিমাত্রায় রক্ষনশীল । বৃটেন থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে ১৯৬৬ সালে দেশে আসার পর তার পিতা তাকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখেন। কাবুসের পিতার রক্ষনশীলতার বিবরণ দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে তিনি রেডিও শোনা ও সানগ্লাস পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এমনকি কে বিয়ে করবে, কে লেখাপড়া করতে পারবে আর কে বিদেশে যেতে পারবে তাও নির্ভর করত তার অনুমতির ওপর। এমনি প্রেক্ষিতে পিতার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পথ রচিত হয় কাবুসের জন্য।
কাবুস ওমানে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও তিনি ছিলেন একজন একচ্ছত্র সুলতান। দেশের সমস্ত ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল তারই হাতে। আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে সুলতান কাবুসের বিরুদ্ধে। যেকোনো ভিন্ন মত আর বিরোধীতা তিনি কঠোর হস্তে দমন করতেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদারতার পরিচয় দিলেও শেষ দিকে এসে তিনি অনেক ক্ষেত্রে দমনমূলক নীতি অবলম্বন করেন। গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা তিনি সহ্য করতেন না এবং তিনি এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন আরোপ করেছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার বিরুদ্ধে সমালোচনার কারনে অনেককে তিনি বিচারের মুখোমুখি করেছেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় প্রথম দিকে তিনি রাজপথে মিটিং মিছিলের অনুমতি দিলেও পরে তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেন এবং পুলিশের গুলি চালানোর মত ঘটনাও ঘটে।

সুলতান কাবুসের দীর্ঘস্থায়ী শাসনের শেষ দিকে দেশটিতে বেকার সমস্যা, দুর্ণীতিসহ বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় অন্যান্য আরব দেশের মত ওমানেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তবে সে বিক্ষোভ সরকার পতনের বিক্ষোভ ছিল না। ছিল অধিকতর সংস্কার, দুর্ণীতি দূর করা, কর্মসংস্থান ও বেতন বৃদ্ধিও দাবিতে। বিক্ষোভকারীদের অনেক দাবি মেনে নেন কাবুস। নিজ থেকে বরখাস্ত করেন দীর্ঘদিন ধরে পদে থাকা এবং দুণীতির অভিযোগ ওঠা অনেক মন্ত্রীকে।

আরব বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতেন কাবুস। এর কারণ বিভিন্ন সংঘাত সঙ্কটে তিনি গোপনে মধ্যস্থাতাকারীর ভূমিকা পালন করে অনেক সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এক ধরনের কূটনৈতিক দক্ষতা ছিলো যা সবার কাছে তাকে গ্রহনযোগ্য করে তুলেছিলো।
ইরান-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোপন আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যস্থতা করেছিলেন সুলতান কাবুস। এর ফলে ২০১৬ সালে পারমানবিক চুক্তি সম্পন্ন হয় ইরান ও বিশ্বের শক্তিধর ছয়টি দেশের সাথে। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া সর্বশেষ ইয়েমেন কেন্দ্রিক ইরান-সৌদি সংঘাত থামাতেও তিনি চেষ্টা চালিয়েছেন। বর্তমানে আবার ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে অনেকে কাবুসের শূণ্যতা অনুভব করছেন।


২০১৮ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ওমান সফরের আমন্ত্রন জানিয়ে অনেককে তাক লাগিয়ে দেন কাবুস। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনারও শিকার হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিকৃয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। নেতানিয়াহু ওমান সফর শেষে দেশে ফেরার এক দিন পর ওমানের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় ইসরাইল বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর আগে ওমান ভ্রমন করেছিলেন আরেক ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ ১৯৯৬ সালে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেন কাবুস।
কাবুসের দীর্ঘ শাসন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু রহস্য। ২৯ বছর বয়সে ক্ষমতা আরোহনের পর ৩৫ বছর বয়সে তিনি তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের মধ্যে। এরপর কাবুস আরো কখনো বিয়ে করেননি। নেই তার কোনো সন্তানাদি। তিনি সরাসরি ওমানের ৪শ বছরের পুরনো রাজ বংশের বংশধর হলেও নিজের বংশধারা রক্ষার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হলেন তার ভাইয়ের ছেলে । বিয়ের পর কেন দ্রুত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল এবং কেনই বা আর বিয়ে করলেন না এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের কথা চালু রয়েছে।


একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসতেন প্রায়ই এবং সাধারান মানুষের সাথে কথা বলতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই নিজের গাড়ি চালাতেন। ক্ষমতায় বসে ওমানকে একটি আধুনিক উদার আর ধনি রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন কাবুস। অনেকে একে রেনেসার সাথে তুলনা করে থাকেন।