লিবিয়ায় কোন্ দেশ কী ভুমিকা পালন করছে

লিবিয়ার পতাকা- সংগৃহীত -

  • আলফাজ আনাম
  • ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:০১

উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধ দেশ ছিলে লিবিয়া। গাদ্দাফির পতন আর আরব বসন্তের ব্যর্থতার কারনে দেশটি এখন বিভিন্ন বিদেশি শক্তির ছায়া যুদ্ধের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। লিবিয়ায় কোন দেশ কী ভুমিকা পালন করছে তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। প্রথমে আমরা জেনে নেই লিবিয়া কারা নিয়ন্ত্রন করছে।  লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত একটি সরকার আছে। গর্ভনমেন্ট অব ন্যাশনাল আর্কড বা জিএনএন। এই সরকারে লিবিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি রয়েছে। যার মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডও রয়েছে। ২০১৫ সালে ত্রিপোলি কেন্দ্রিক এই সরকার কার্যক্রম শুরু করে। এই সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক ও কাতারের মতো কয়েকটি দেশ।


এ সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে ফিল্ড মার্শাল খলিফা বিল কাশিম হাফতার। যিনি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রধান। খলিফা হাফতার গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর একজন প্রভবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮৭ সালে গাদ্দাফিকে উৎখাতের চেষ্টার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৯০ সালে কারামুক্ত হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে নাগরিকত্ব গ্রহন করেন। গাদ্দাফির পতনের পর দেশে ফিরে এসে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করেন। এখন তিনি ত্রিপোলির নিয়ন্ত্রন নিত চাইছেন। খলিফা হাফতারকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর সমর্থন দিচ্ছে। পেছন থেকে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করছে ফ্রান্স ও রাশিয়া। জিএনএ সরকার জাতিসংঘ সমর্থন জানানোর কারনে এই সরকারের সরাসরি বিরোধিতা করতে পারছেনা পশ্চিমা দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ নির্লিপ্ত ভুমিকা পালন করছে।


জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের পরিবর্তে হাফতারকে সমর্থন দেয়ার পেছনে রয়েছে লিবিয়ায় বিভিন্ন দেশের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। লিবিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টা করতে পারলে, শুধু দেশটির তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রন থাকবে না, পুরো উত্তর আফ্রিকার ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে। খলিফা হাফতারের প্রধান সমর্থক হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। হাফতারকে সর্বাধুনকি অস্ত্র সরবরাহ করছে আরব আমিরাত। ২০১১ সালে লিবিয়ার ওপর জাতিসংঘ যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। আরব আমিরাতের কাছ থেকে বিমান বাহিনীর সাপোর্ট পাচ্ছে হাফতার। এরমধ্যে হাফতার বাহিনী চীনে তৈরি উইং লং ড্রোন ব্যবহার করা হয়। গত নভেম্বরে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাশিয়ার তৈরি এডভান্স এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আল জুফরা ঘাটিতে মোতায়েন করা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে ব্যয়বহুল এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হাফতার পেয়েছেন আরব আমিরাতের মাধ্যমে। পশ্চিম লিবিয়াতে একটি বিমান ঘাটি নির্মান করেছে আরব আমিরাত । এই ঘাটি থেকে হাফতারকে যুদ্ধ বিমান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আরব আমিরাত। রাজনৈতিক ইসলাম বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডকে মোকাবিলায় হাফতারকে একজন বিশ্বস্ত মিত্র মনে করে থাকে আমিরাত। লিবিয়াতে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব ঠেকানো আরব আমিরাতের আরেকটি লক্ষ্য।


আবুধাবির মতো কায়রো হাফতারের একজন জোরালো সমর্থক। এর কারন মুসলিম ব্রাদারহুডকে যে কোনো ভাবেই হোক মোকাবিলা করতে চায় মিশর। ২০১৩ সালে মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহন করেন জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি। লিবিয়ার জিএনএ সরকারে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপস্থিতিকে নানা ভাবে বাধগ্রস্থ করছে মিশর।


খলিফা হাফতার তার সামরিক অতীতের কারনে মধ্যপ্রাচ্যর ধনী দেশগুলোর সমর্থন পাচ্ছেন। এসব দেশের ধারনা পূর্ব লিবিয়ায় বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন হাফতার। আল জাজিরা মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন গোপন নথিতে দেখতে পেয়েছে, মিশর হাফতারকে নানা ধরনের অস্ত্র ও যোগাযোগ সামগ্রী সরবারহ করেছে। হাফতার এক সময় মিশরে সামরিক প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। ফলে মিশরের অনেক সেনা কর্মকর্তার সাথে তার রয়েছে পুরানো যোগাযোগ। কিছুদিন আগে তিনি মিশর সফরের সময় বলেছিলেন, দেশটি যদি লিবিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠায়, তাহলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ত্রিপোলি দখল করে নিতে পারবেন।


খলিফা হাফতার ২০১৯ সালের মার্চ মাসে রিয়াদ সফর করেন। ওয়াল্ড স্ট্রিট জার্নালের খবরে বলা হয় , এ সময় সৌদি আরব হাফতারকে ত্রিপোলি দখলের জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার সাহায্যর প্রতিশ্রুতি দেন। এই অর্থ উপজাতি নেতাদের পেছনে ব্যয় করা , নতুন সৈন্য নিয়োগ সহ সামরিক খাতে ব্যয় করার জন্য দেয়া হয়। সৌদি আরবের এই অর্থ দেয়ার পেছনে মুসলিম ব্রাদারহুডকে মোকাবিলা করা প্রধান উদ্দেশ্য।  লিবিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায়আরব আমিরাত ও মিশরের বিপরীত মুখী অবস্থানে আছে তুরস্ক ও কাতার। এই দেশটি জোরালো ভাবে সমর্থন দিচ্ছে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে।


লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের প্রধান সমর্থক হচ্ছে তুরস্ক। হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে এই সরকারকে সামরিক সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। জিএএন সরকারের সমর্থনে বেশ কিছু আমার্ড ভেহিক্যাল ও ড্রোন পাঠিয়েছে । লিবিয়ায় সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে তুরস্কের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সীমিত আকারে সৈন্য পাঠানো শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি মস্কোতে শান্তি আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন হাফতার বাহিনীকে একটি উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। লিবিয়ায় আরো বেশি সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে পারে তুরস্ক। ফলে হাফতার বাহিনীকে আগামিতে তুরস্কের সৈন্যদের মোকাবিলা করতে হতে পারে।


এর মধ্যে গত নভেম্বরে লিবিয়ার জাতিংঘ নিয়ন্ত্রিত সরকারের সাথে তুরস্ক সমুদ্রসীমা নির্ধারন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এতে গ্রিস, মিশর ও ইসরাইল ক্ষুদ্ধ হয়েছে। আরব আমিরাত এসব দেশকে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক গুরুত্বপূর্ন দেশ কাতার মুলত তুরস্কের নীতিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। জাতিংঘ নিয়ন্ত্রিত সরকারকে আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে কাতার। ২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারের পতনে কাতারের গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা ছিলো।
লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারের উৎখাতে প্রধান ভুমিকা পালন করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এসব দেশ হাতগুটিয়ে বসে নেই। লিবিয়ার তেল সম্পদের ওপর তাদের আগ্রহ রয়েছে। 


সরকারি ভাবে ফ্রান্স বলে আসছে দেশটি লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্টার পক্ষে। কিন্তু খলিফা হাফতারের পক্ষে নানা ভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে ফ্রান্স। জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের প্রধান ফায়াজ আল সারাজ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হাফতারকে সামরিক সাহায্য দেয়ার অভিযোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি জাভেলিন মিসাইল হাফতার বাহিনী ব্যবহার করেছে। ফ্রান্স এই মিসাইল হাফতারকে সরবারহ করছে বলে মনে করা হয়। ২০১৬ সালে বেনগাজিতে একটি হেলিকপ্টার বিধ্স্ত হয়ে ৩ জন সৈন্য মারা যায়। এ ঘটনার পর তৎকালীন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয় ওলাদ জানান একটি বিপজ্জনক গোয়েন্দা কার্যক্রমে অংশ নিতে এই সৈন্যরা লিবিয়া গিয়েছিলো। জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার এ ঘটনাকে দেশটির সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত বলে বর্ননা করেছিলো।


রাশিয়ার অবস্থান অনেকটা ফ্রান্সের মতো। মস্কো প্রকাশ্য জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিলেও হাফতারের সাথে আছে নিবিড় যোগযোগ। হাফতারের ত্রিপোলি দখলের বিরুদ্ধে গত এপ্রিলে জাতিসংঘের নেয়া একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে রাশিয়া। রাশিয়ার একটি বেসরকারি ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার হাফতারের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন শক্তি হিসাবে আর্বিভুত হয়েছে তার অংশ হিসাবে লিবিয়াতেও ভুমিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার গঠনে অত্যন্ত তৎপর ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীতে এই অবস্থানে আর অনঢ় থাকতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত হাফতারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিবিয়ার তেল সম্পদ রক্ষা ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য হাফতারের প্রশংসা করেছেন।


ভূমধ্যসাগরের অপর পারের দেশ ইতালি। লিবিয়ার সাবেক ওপনিবেশ দেশটি এক ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এর আগে লিবিয়ায় ফ্রান্সের অতিআগ্রহী ভুমিকার কারনে দেশটিকে সর্তক করেছে ইতালি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন লিবিয়ার যেসব তেল ক্ষেত্র ইতালির কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রনে আছে সে স্থানগুলো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে ফ্রান্স।


এসব প্রভাবশালী দেশ ছাড়াও লিবিয়াতে আফ্রিকার আরেকটি দেশ সক্রিয় রয়েছে। এই দেশটি হচ্ছে সুদান। জাতিসংঘের লিবিয়া অবরোধ বিষয়ক কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লিবিয়ায় প্রায় ১ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে সুদান। গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে সুদানের একজন কামান্ডারর উদ্ধতি দিয়ে এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় তিন হাজার সুদানি সৈন্য হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করছে।