স্কুইড গেম : জীবন-মৃত্যুর খেলা


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:০৬

ঝড় তুলেছে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্মিত টেলিভিশন সিরিজ স্কুইড গেম। নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া এই সিরিজটি গড়েছে একের পর এক রেকর্ড। শিশুদের একটি খেলার আদলে এই সিরিজে জীবন-মৃত্যুর খেলায় অংশ নেয় অনেক প্রতিযোগী। জিতলে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে, আর হারলেই মৃত্যু। এমনই এক টানটান উত্তেজনার জীবনধর্মী গল্প নিয়ে লেখা হয়েছে সিরিজটির স্ক্রিপ্ট। মুক্তির পরই যা সারা বিশে^ আলোড়ন তুলেছে।

শীর্ষস্থানীয় ওটিপি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে ২০২১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয় স্কুইড গেম সিরিজটি। নয় পর্বের সিরিজটি মুক্তির পরই দর্শকদের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নেয়। দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষস্থানীয় পরিচালক হোয়াং ডং-হাইয়ুক গল্প চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় এই সিরিজটি জয় কয়েছে বিশে^র কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়।

সিরিজটি থেকে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে নেটফ্লিক্স। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিষয়ক মার্কিন ওয়েবসাইট রটেন টমেটোর তথ্যমতে এই সিরিজটি সমালোচকদের কাছ থেকে ১০০ শতাংশ অ্যাপ্রুভাল রেটিং অর্জন করেছে। ভারত থেকে ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ট্রেলিয়া- বিশে^র সর্বত্র সিরিজটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন অনলাইন ব্যবহারকারীরা। মাত্র ১০ দিনের মাথায় ৯০টি দেশে সিরিজ র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে আসে ‘স্কুইড গেম’, যার মধ্যে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, এবং হংকং অন্যতম।

১৯ সেপ্টেম্বর যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে র‌্যাঙ্কিংয়ে সিরিজটির অবস্থান ছিল ৮ নাম্বারে, এরপরের দিন তা এক লাফে উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে। ২১ সেপ্টেম্বর তা সিরিজ র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করে ফেলে, যা এর আগে কোনো কোরীয় সিরিজ করতে পারেনি। প্রচার হওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে মোট ৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেখেছিল এটি। সিরিজের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে নেটফ্লিক্স মোট ৩৪টি ভিন্ন ভাষায় ডাবিংয়ের পাশাপাশি আরো ৩১টি ভাষার সাবটাইটেল সাথে দিয়ে দেয়।

স্কুইড গেম’-এর নির্মাতা হোয়াং ডং-হিউক ২০০৯ সালে সিরিজটির গল্প লিখেছিলেন; কিন্তু ১০ বছর ধরে কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সেই গল্প পছন্দ করেনি। কারণ সেই সময়ে হানাহানির এই গল্প দর্শকরা নিতে পারবে না বলেই তাদের ধারণা ছিলো। এত বছর পর সেটি নির্মিত হলেও কতটা লাভজনক হবে তা নিয়ে সন্দেহ ছিলো তাদের। যে কারণে শেষ পর্যন্ত সেটি সিনেমা হিসেবে তৈরি হলেও পরে সিরিজ আকারে নেটফ্লিক্সে এসেছে।

এই সিরিজের ঘটনা একটি খেলাকে কেন্দ্র করে। ছোটদের খেলা; কিন্তু বড়রা সেই খেলায় অংশ নেয় বিপুল অর্থ উপার্জন আর প্রাণহাণীর ঝুকি মেনে নিয়ে। যার রয়েছে ৪৫৬ জন প্রতিযোগী। গেমের শর্ত ৬টা ধাপ পার করতে হবে এবং জিতে গেলেই পাবে বিপুল পরিমাণ টাকা। তবে এই খেলায় যখন কেউ এলিমিনেট হবে, সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাণ হারাবে।

প্রতিযোগীরা কোনোভাবেই খেলা বন্ধ করতে পারবে না। কেউ খেলা বন্ধ করলে তাকে হত্যা করা হবে। আর সঠিক সময়ে যারা খেলা শেষ করতে পারবে না, তাদের ভাগ্যেও রয়েছে মৃত্যু। মাত্র ৯টা এপিসোডে অনেক কিছু তুলে ধরা হয়েছে সিরিজে। হতাশাগ্রস্ত মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে জীবন-মৃত্যুর খেলায় নামানো কিছু ধনী লোকের চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে এর মাধ্যমে।

গল্পের শুরুটা হয় এক জুয়ারির সংসার থেকে। গি-হান নামের এই জুয়ারিই গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার ৪৮ বছর বয়সী অভিনেতা লি জাং-জায়ে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে অর্ধশতাধিক অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন এই অভিনেতা। স্কুইড গেমে গি-হান রূপী জাং-জায়ের শিশুকন্যার প্রতি ভালোবাসা আর আর্থিক টানাপোড়েন দর্শককে টেনে নিয়ে যায় গল্পের মূল প্লটে।

জুয়ার নেশা থাকলেও শিশুকন্যার প্রতি ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই গি-হানের; কিন্তু অর্থের অভাবে মেয়েকে জন্মদিনে ভালো উপহার দেওয়া কিংবা ভালো রেস্ট্রুরেন্টে খাওয়ানোর সাধ্য নেই তার। এই হতাশা থেকেই সে টাকা উপার্জনের লোভে নাম লেখায় স্কুইড গেমে। যেখানে তার মতো আরো অনেক ঋণগ্রস্থ মানুষ টাকার লোভে নামে জীবন মৃত্যুর খেলায়। খেলার প্রতিটি ধাপে কিছু মানুষ প্রাণ হারায়। আর যারা জিতে যায়, তারা নামের পরের ধাপের লড়াইয়ে।

স্কুইড গেম সিরিজের নির্মাতা হোয়াং ডং দ্য কোরিয়া টাইমসকে বলেন, ‘আমি এমন একটা গল্প সাজাতে চাইছিলাম, যা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের চালচিত্র রূপক অর্থে ফুটিয়ে তুলবে। যা বর্ণনা করবে জীবনের চরম প্রতিযোগিতার ধারাকে। সেখানে আমি এমন সব চরিত্রকে দেখাতে চেয়েছিলাম, যাদের আমরা বাস্তবে হরহামেশাই দেখি।’

কোরীয় ভাষায় নির্মিত এমন একটি শো- কী কারণে বিশ^ব্যাপী আলোড়ন তুলেছে তা নিয়ে মত দিয়েছেন চলচ্চিত্র সমালোচকরা। তাদের বেশির ভাগেরই মত, স্কুইড গেমের সফলতার প্রধান কারণ এর গল্প। জীবন ঘনিষ্ঠ এমন এক গল্প এতে সাজানো হয়েছে যা, বেশির ভাগ দর্শক নিজের মাঝে দেখতে পান। অভাব, ঋণ, স্বল্প আয়ের সংসারের টানাপোড়েন আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টাই এই সিরিজের গল্পের ভিত্তি। যেটি পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি ঘরে দেখা যায়। এর পাশাপাশি এই গল্পের গাথুনি এত চমৎকার ছিলো যে, দর্শকটে শেষ পর্যন্ত টেনে রেখেছে কম্পিউটারের পর্দায়। পড়তে পড়তে উত্তেজনা- এরপর কী ঘটবে সেটা জানার আগ্রহ।

গালফ নিউজের ওপিনিয়ন এডিটর সাদিক সোবহান তার এক কলামে লিখেছেন, স্কুইড গেম সিরিজে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটি মেসেজ দেওয়া হয়েছে, সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য শিক্ষণীয়। পুজিবাদের যে চক্করের মধ্যে আমাদের সমাজটা আটকে আছে সেটি অত্যন্ত সুক্ষভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। সেই সাথে ছিলো অভিনেতাদের দুর্দান্ত অভিনয়। যা দর্শকদের উত্তেজনা, আনন্দ, বেদনা, হতাশাসহ সব রকম অনুভূতিমরই জোগান দিয়েছে। সেট নির্মাণ, কস্টিউম ডিজাইন আর প্রোফসের ব্যবহারগুলোও ছিলো নিখুঁত।

এই সিরিজটি এমন একটি সময়ে মুক্তি পেয়েছে যখন- করোনা মহামারীর ধকলে বিশে^র অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছে, অনেক উদ্যোক্তা পথে বসেছে আর বহু মানুষ সংসার চালাতে দিয়ে দেনায় জর্জরিত হয়েছে। দর্শকদের আবেগ অনুভূতির এই জায়গাটিতেই আঘাত করেছে স্কুইড গেম।

নাটকে দেখা যায় খেলোয়াড়রা তাদের অর্থের চাহিদা পূরণের জন্য জীবন-মরণের এই খেলায় মেতে ওঠে। শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়, সারা বিশে^রই বেশিরভাগ মানুষ ঋণে জর্জরিত। এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশে^র গরিব ৩৭০ কোটি মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে মাত্র ৪০ জন ধনী ব্যক্তির হাতে। আর ধনীরা চাইলেই গরিবদের নানাভাবে ব্যবহার করতে পারেন।

নাটকে ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের এভাবে মৃত্যুর খেলায় নামিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মূলত এই দিকটির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ধনীদের খেয়াল খুশির কাছে গরীবদের জীবন যে কত মূল্যহীন তা আরো একবার মনে করিয়ে দিয়েছে স্কুইড গেম। তুলে ধরেছে, ধনী-গরিবের ব্যবধান।

মুক্তির পর নেফ্লিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টেড স্যাারান্ডোস জানিয়েছেন, ইংরেজী ভাষার বাইরে নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজে পরিণত হয়েছে স্কুইড গেম। তবে তিনি জানান, এই সিরিজটি নেটফ্লিক্সের সর্বকালের সেরা সিরিয়াল হিসেবে জায়গা করে নেবে।

ওটিপি স্ট্রিমিং নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান ফ্লিক্স পেট্রোলের তথ্য মতে, বিশে^র অনেকগুলো দেশে এই সিরিজটি ১ নম্বর অনুষ্ঠান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন।

টুইটার, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাগোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে এই সিরিজ নিয়ে আলোচনায়। টিকটকে কোটি কোটি দর্শক স্কুইড গেম নিয়ে ফানি ক্লিপিংস তৈরি করেছেন। যেগুলো কোটি কোটি ভিউ হয়েছে। ইউটিউবে স্কুইড গেমের রিভিউসহ এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কত যে কন্টেন্ট নির্মিত হয়েছে তার হিসাব নেই।

এই শোয়ের প্রভাব পড়েছে ফ্যাশন জগতেও। মার্চেন্ডাইজাররা স্কুইড গেমের খেলোয়াড়দের গাঢ় সবুজ রংয়ের ট্র্যাকস্যুট বাজারে ছেড়েঠেছ। দেদারসে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো। আয়োজকদের অদ্ভুত ধরনের মুখোশও বাজারে এসেছে।