বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবহন বিমান

এনটোনভ এন-১২৪ বিমানের রয়েছে ব্যতিক্রমী পরিবহন ক্ষমতা - ডিফেন্স ওয়াল্র্ড ডটনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ১২ জুন ২০২০, ০০:৩১

বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় আর ভারী কৌশলগত সামরিক পরিবহন বিমান এনটোনভ ১২৪। পুরো নাম এনটোনভ এন- ১২৪ রাসলান। অপর দিকে সামরিক এবং বেসামরিক উভয় দিক বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর ভারী পরিবহন বিমান এনটোনভ ২২৫।

সামরিক ও বেসামরিক উভয় দিকে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ দুই বিমান নির্মান করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। উভয় বিমানের নকশা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হলো এনটোনভ ডিজাইন ব্যুরো । এনটোনভ ডিজাইন ব্যুরো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ইউক্রেনভিত্তিক একটি সংস্থা।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন আলাদা রাষ্ট্র হয়। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান এনটোনভ ২২৫ এর মালিক এখন ইউক্রেন। অপর দিকে বিশ্বের সবেচেয়ে বড় কৌশলগত সামরিক পরিবহন বিমান এনটোনভ -১২৪ এর মালিক রাশিয়া এবং ইউক্রেন। রাশিয়া এবং ইউক্রেন ছাড়া লিবিয়া ২টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে একটি এনটোনভ -১২৪ বিমান রয়েছে। তবে লিবিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে থাকা এনটোনভ -১২৪ বেসামরিক বিমান।

রাশিয়ার এয়ারফোর্স ছাড়া বর্তমানে অন্য কোনো দেশের এয়ার ফোর্সের কাছে এ বিমান নেই। সে হিসেবে রাশিয়ান এয়ারফোর্স বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সামরিক পরিবহন বিমানের অধিকারী। বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ কৌশলগত সামরিক পরিবহন হলো যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন নির্মিত সি-৫ এম সুপার গ্যালাক্সি।

এনটোনভ এন-১২৪ বিমানের রয়েছে ব্যতিক্রমী পরিবহন ক্ষমতা । সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো লিজ নিয়ে এ বিমান দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার করে আসছে । এ ছাড়া বিশ্বের আরো অনেক দেশ ও সংস্থা নিয়মিত ব্যবহার করে এ বিমান। দীর্ঘ দূরত্বে সমরাস্ত্র, সৈন্য এবং ভারী ও বড় যন্ত্রপাতি পৌছানোর লক্ষ্যে সোভিয়েত রাশিয়া তৈরি করে এ বিমান। ভারী রেল ইঞ্জিন, ক্রেন থেকে শুরু করে ২৫ মিটার লম্বা ইয়ট পর্যন্ত বহন করে এ বিমান। বিমানটির আপার ডেকে রয়েছে ৮৫ সিটের যাত্রী কেবিন। আসুন আমরা জেনে নেই এই বিমান সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

ভারী ও বড় আকারের সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের পন্য আকাশ পথে পরিবহনের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে সুপরিচিত এনটোনভ-১২৪। এনটোনভ -১২৪ এর ঝুলিতে রয়েছে ৩০টি বিশ্ব রেকর্ড। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৮৭ সালের মে মাসে পুন জ্বালানি সংগ্রহ ছাড়া টানা ২০ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার রেকর্ড । এতে মোট সময় লাগে ২৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট।

১৯৮৫ সালে ১৭১ টন ওজনের পন্য নিয়ে ৩৫ হাজার ফিট উচুতে ওড়ার ক্ষমতা অর্জন করে এনটোনভ-১২৪। এ ছাড়া ১৯৯০ সালে ঘন্টায় ৬৮৯ কিলোমিটার গতিতে উত্তর ও দক্ষিন মেরুর ওপর দিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমন করে এ বিমান। বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত বিমান নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আর ভারী বিমান হলো এনটোনভ ২২৫ মৃয়া। রাশিয়ার মহাকাশ কর্মসূচীর জন্য এ বিমান নির্মিত হলেও এটি বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে বেসামরিক পরিবহন পরিবহন বিমান হিসেবে।

এনটোনভ -২২৫ মৃয়া প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮৮ সালে। এর বেশ আগে নির্মিত হয় সবচেয়ে বড় সামরিক পরিবহন বিমান এনটোনভ ১২৪।

এনটোনভ ১২৪ প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৮২ সালের ২৪ ডিসেম্বর। সোভিয়েত বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে। রাশিয়ান এয়ার ফোর্স, এনটোনভ এয়ারলাইনস, ভোলগা ডিনেপার এয়ারলাইনস ব্যবহার করে এ বিমান। এখন পর্যন্ত ৫৫টি নির্মিত হয়েছে এনটোনভ -১২৪ বিমান।

এনটোনভ এন-১২৪ বিমান প্রথমে নির্মিত হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয় দেশে। কিন্তু বর্তমানে কেবল মাত্র রাশিয়ার উলয়নোভস্কে অবস্থিত এভিস্টার এসপি কারখানায় এ বিমান নির্মিত হয়। তবে অনেক দিন ধরে এ বিমানের নির্মান বন্ধ রয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে রাজনৈতিক দ্ব›েদ্বর কারনে।

২০০৪ সালে পর অনেক বার এ বিমান নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে রাশিয়া এবং ইউক্রেন এ বিমান নির্মানের চুক্তি করে। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতার কারনে ২০১৪ সালে এ প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৯ সালে এনটোনভ ঘোষণা দেয় রাশিয়ার সমর্থন ছাড়াই তারা আবার এ বিমান নির্মান শুরু করবে। কারন আকাশপথে পরিবহনে এ বিমানের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এই বিমানের আরো কিছু তথ্য আমরা জেনে আসি

৩০ বছর ধরে এটি বিশ্বের হেভিয়েস্ট গ্রস ওয়েট প্রডাকশন কার্গো বিমান হিসেবে স্থান দখল করে রাখে। ২০১১ সালে এর স্থান দখল করে বোয়িং-৭৪৭ -৮এফ। এনটোনভ ২২৫ নির্মানের আগে এনটোনভ -১২৪ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবহন বিমান। তবে এনটোনভ- ২২৫ মৃয়া এখন পর্যন্ত একটির বেশি নির্মান করা সম্ভব হয়নি।

এনটোনভ ১২৪ এবং এনটোনভ ২২৫ উভয় বিমানের নকশা তৈরি করেন ভিক্টর টলমাচেভ। এনটোনভ -১২৪ বিমানটির দৈর্ঘ্য ২২৬ ফিট ৮ ইঞ্চি। উইংস্প্যান বা দুই ডানার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব ২৪০ ফিট। উচ্চতা ৬৯ ফিট। শুধু বিমানটির ওজন ১৮১ টন। মেক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ৪শ ২ টন। বিমানটি চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট।

ইউক্রেন এবং রাশিয়ার ১০০ প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সামরিক পরিবহন নির্মাণের জন্য।

বিশাল আকৃতি আর আকর্ষনীয় ডিজাইনের কারনে এ বিমানের উডডয়ন এবং অবতরণ উভয়ই অতিশয় মোহনীয়। বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ৮০০ বিমান বন্দরে এখন পর্যন্ত অবতরণ করেছে এনটোনভ -১২৪।

রাশিয়ার দুটি এয়ার লাইনসের কাছে ১৮টি এবং রাশিয়ান এয়ার ফোর্সের কাছে ২৬টি এনটোনভ ১২৪ বিমান রয়েছে। এনটোনভ এয়ার লাইনসের মালিক বর্তমানে ইউক্রেন। ইউক্রেনের এনটোনভ এয়ার লাইনসের কাছে ৭টি এনটোনভ-১২৪ বিমান রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এনটোনভ এয়ারলাইনস্রে কাছ থেকে এ বিমান ভাড়া ও লিজ নিয়ে পরিবহন কাজে ব্যবহার করে।

এনটোনভ ১২৪ এর রয়েছে বিভিন্ন ভার্সন। এনটোনভ-১২৪-১০০, এনটোনভ ১০০এম-১৫০ থেকে শুরু করে মোট ১১টি ভার্সন রয়েছে। রাশিয়ান এয়ারফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এনটোনভ -১২৪ বিমান। এনটোনভ -১২৪ নির্মানের পর তৎকালীন সোভিয়েত উনিয়ন উদ্যোগ নেয় এনটোনভ -২২৫ নির্মানের। এনটোনভ -২২৫ মৃয়া এভিয়েশন ইতিহাসে তৈরি করে নতুন এক ইতিহাস যা আজ অবধি কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।

সোভিয়েত স্পেস প্রোগাম বা মহাকাশ অভিযান কর্মসূচীর জন্য তৈরি করা হয় এন-২৫৫ বা মৃয়া বিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম স্পেস প্লেন ‘বুরান’, এনারজিয়া রকেটসহ মহাকাশগামী অন্যান্য রকেট ও নভোযান বহনের জন্য নির্মান করা হয় এনটোনভ-২২৫। ১৯৮৯ সালে এ বিমানের পিঠে বহন করা হয় স্পেসপ্লেন ‘বুরান’।

তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ বিমান নির্মান করলেও এর বর্তমান মালিক রাশিয়া নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর ইউক্রেনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনটোনভ কিনে নেয় বিমনাটি। এখন অবধি সার্ভিসে নিযুক্ত যত বিমান রয়েছে তার সব দিক দিয়ে এ বিমান বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ।

মহাকাশ মিশন সমাপ্তির পর এনটোনভ এয়ারলাইনস ব্যবহার করে এনটোনভ ২২৫। এটি মূলত ছিল একটি সামরিক বিমান। ২০০১ সাল থেকে বানিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে বিমানটি।

এনটোনভ -১২৪ এর চেয়ে এনটোনভ ২২৫ এর দৈর্ঘ্য ৫০ ফিট বেশি। আকাশের দানব নামে পরিচিত এন-২২৫। আকাশ পথে বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত ভারী আর বড় পন্য বহন করা হয়েছে তার সমস্ত রেকর্ড এ বিমানের ঝুলিতে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার কারনে একটির বেশি নির্মান করা সম্ভব হয়নি এন-১২৫ মৃয়া। বর্তমানে ইউক্রেনের গৌরব হিসাবে পরিচিত এন-২২৫ মৃয়া।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে