স্বেচ্ছা অবরোধে বিশ্ব

করোনাভাইরাসের সচতেনতায় মাস্ক পরিহিত চীনের নাগরিক- সংগৃহীত

  • আলফাজ আনাম
  • ১৯ মার্চ ২০২০, ১৩:৩০

দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ এখন স্বেচ্ছা অবরুদ্ধ। চোখে না দেখা এক ভাইরাস কাপিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। পরস্পরের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরেছে। প্রত্যেক দেশ নিজেই নিজ দেশের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভাইরাস এতোটাই দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থা বেইজিং থেকে ওয়াশিংটন, রিয়াদ থেকে টোকিও পর্যন্ত।

বিভিন্ন দেশ প্রথম যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা হলো নাগরিকদের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা। এক দেশের নাগরিক যাতে আরেক দেশে যেতে না পারে। যেমন বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি সফর করে ভারতে। চিকিৎসা ও পর্যটনসহ নানা কারনে তারা ভারত যায়। আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের পর্যটক ভিসা স্থগিত করেছে ভারত সরকার। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কুটনৈতিক, জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা, চাকুরি এবং প্রজেক্ট ভিসা বাদে বিদ্যমান সব ধরনের ভিসা স্থগিত থাকবে। যদিও ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক কম। যে শতাধিক লোককে আক্রান্ত বলে চিহিৃত করা হয়েছে তার বেশিরভাগ ইতালি থেকে আসা পর্যটক। এই অবস্থা যে শুধু ভারতে তা নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ভাষণে তিনি বলেছেন, আগামী ৩০ দিনের জন্য ইউরোপ থেকে সব ধরনের ভ্রমণ স্থগিত থাকবে। কিন্তু এরপরেও যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন স্টেটে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

মার্কিন অর্থনীতির ওপর করোনা ভাইরাসের প্রভাব ঠেকাতে ছোট ছোট ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোর জন্য শত শত কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তিনি। এছাড়া কর অব্যাহতি দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্র যখন এমন ঘোষণা দিয়েছে তখন ইউরোপের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে অসুখটি ছড়িয়ে পড়ছে। এরমধ্যে সবচেযে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ইতালি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ইউরোপ এখন ভাইরাসটির কেন্দ্রবিন্দু। খারাপ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেন।
ইউরোপের সবেচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালি। যেখানে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। বলা যায় ইতালি এখন শোকে স্তবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর পর আছে স্পেন। ইতোমধ্যে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে স্পেন। স্পেনে অধিক সংক্রামিত শহর মাদ্রিদে সংক্রামিত হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজ নিজেও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
মহামারি ঠেকাতে ইতোমধ্যেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহরগুলোর সব দোকান, বার ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে সব ধরনের লোক সমাগম, জনসভা ও প্যারেড বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। স্পেনের মতো ব্যবস্থা নিয়েছে ফ্রান্স। দেশের বেশিরভাগ দোকানপাট, রেস্তোরা ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে ফ্রান্স। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী এদুয়ার্দ ফিলিপ জানিয়েছেন, ‘অপরিহার্য নয়’ এমন জনপরিসরগুলো এ ঘোষণার আওতায় পড়বে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, ১০০ এর বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মানুষকে দেওয়া হয়েছে সামাজিক জীবন-যাপন সীমিত করার পরামর্শ। তবে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ মনে করেন, এইসব ব্যবস্থাগুলো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ব্রিটেনের সরকার আগামী সপ্তাহে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগের সব খেলা আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া আয়োজকরা লন্ডন ম্যারাথনও স্থগিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মে মাসের স্থানীয় ও মেয়র নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন।

ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানীও নানা ধরনের সর্তকতামুলক ব্যবস্থা নিয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর সর্তক করেছেন দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলো বন্ধ করা হয়েছে। যদিও আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে চলছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। নেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সর্তকতামুলক ব্যবস্থা। অনেক দেশ ভিসা দেয়া বন্ধ করেছে। বিদেশি শ্রমিক নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইরান। চীনের পর ইরানে দ্রুত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কত লোক মারা গেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। অবরোধের কারনে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও সঙ্কট রয়েছে।

ভাইরাসের বিস্তার রোধে মুসলিমদের প্রথম কিবলাহ ও তৃতীয় পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেরুজালেমের ওয়াকফ কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবধানতার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে মসজিদের বাইরের অংশ ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এর আগে মুসলমানদের আরেক পবিত্র স্থান কাবা শরীফে উমরাহ পালনে বিধি নিষেধ আরোপ করে সৌদি আরব। ফলে কয়েকদিন ফাকা ছিলো কাবা চত্বর।

আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে সৌদি আরব। দেশটিতে কোনও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অবতরণ ও উড্ডয়ন করবে না। বিমান চলাচল বাতিলের কারণে যেসব নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা অন্য দেশ হতে সৌদি আরব ফিরতে পারবেন না বা কোয়ারেন্টাইনে থেকে সৌদি আরবে ফিরবেন, তাদের জন্য এই দুই সপ্তাহ বিশেষ সরকারি ছুটি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এর আগে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়া ও আফ্রিকার ১২টি দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল স্থগিত করেছিল সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদান স্থগিত রেখেছে। দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্টানও বন্ধ রেখেছে।
বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের নাগরিকদের কাতারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কাতার। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে দোহা। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সাথে কাতার এয়ার ওয়েজের বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কুয়েত।

এছাড়া আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়া, রুয়ান্ডা, সিসেলেস ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে আফ্রিকায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ২৩টিতে দাঁড়াল। মধ্যএশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বাইরে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকলেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এশিয়ার দেশ চীন থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে। এখন চীন ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রনের দাবি করেছে। নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কমে এসেছে।

ইউরোপ ও আমেরিকায় যেভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে চীনের নিকট প্রতিবেশি দেশগুলোতে সেভাবে ছড়ায়নি। যদিও ছড়াবে না এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। চীনের নিকটতম এলাকা তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুরে এটি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনের প্রতিবেশি দেশ ভারতেও আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত তুলনামুলকভাবে কম। তবে বিস্ময়কর ভাবে চীনের আরেক প্রতিবেশি মিয়ানমারে এ রোগের অবস্থা সর্ম্পকে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে কয়েকজন আক্রান্তের কথা স্বীকার করা হয়েছে। ফিলিপাইনে স্কুল, সরকারি অফিসসহ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। ম্যানিলায় কারফিউ দেয়া হয়েছে। স্থল, আকাশ ও সমুদ্র বন্দর দিয়ে রাজধানী ম্যানিলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সব যোগাযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রুদ্রাগো। নিষিদ্ধ করা হয় কনসার্ট ও সিনেমা প্রদর্শন। এছাড়া সব স্কুলের ক্লাস এক মাস পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে সর্তকতামুলক বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশটি পুরোপুরি ভাবে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ছে।