উত্তর মেরুতে জ্বালানী সম্পদ নিয়ন্ত্রনে চীন-রাশিয়া

রাশিয়া সম্প্রতি ইয়াকুতিয়া থেকে চীনে গ্যাস রফতানি করেছে - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:৫০

 

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ''কারো ঘর পুড়ে যায়, কেউ (সেই আগুনে) আলু পুড়ে খায়''। এ প্রবাদ পৃথিবীর সব দেশে সব কালের জন্যই যে সত্য, তা এখন আমরা বুঝতে পারছি। নইলে জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কায় বিশ্ববাসী যখন আতঙ্কিত, উত্তর মেরুতে যখন অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি হারে বরফ গলে চলেছে, তখন চীন ও রাশিয়া এমন কাণ্ড করবে কেন?


বিশ্বাস করুন অথবা না-ই করুন, মানবজাতির অস্তিত্বের প্রতি এই বিশাল হুমকি অর্থাৎ উত্তর মেরুর বরফ গলাটা এ দু' দেশের সামনে এনে দিয়েছে এক বিরাট সুযোগ হয়ে। তারা উত্তর মেরুর শীতল জলধারা দিয়ে নতুন একাধিক বাণিজ্যপথ চালুর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই    প্রস্তাবিত বাণিজ্যপথ দ্য নর্দার্ন সী রুট বা এনএসআর বিভিন্ন দিক থেকে এসে উত্তর মেরুকে ঘিরে ধরবে।


 চীন ও রাশিয়া এ বরফাচ্ছাদিত বিশাল অঞ্চলের মাটির নিচের অনাহরিত খনিজ সম্পদ আহরণেও ভীষণ উদ্গ্রীব। অবশ্য রাশিয়ার জন্য ব্যাপারটি একেবারে নতুন নয়। বেশ ক'বছর থেকে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন এবং মাইনিং অ্যান্ড শিপিং কম্পানিগুলো সেখানে খনিজ আহরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব রুশ কম্পানির মধ্যে আছে রসনেফত, গ্যাজপ্রম, রসহেলফ ও নোভাটেক। তবে চীনের জন্য বিষয়টি খানিকটা নতুন। এ কারণে তাদের দরকার একজন ভালো অংশীদার, যাকে নিয়ে এ অঞ্চলে কাজ করাটা সহজ হবে।


মনে করা যাক, ২০১৮ সালের কথা। ওই বছর জানুয়ারিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর সরকার তাদের উত্তর মেরু নীতি নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে ''পোলার সিল্ক রোড'' প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। অবকাঠামো উন্নয়নের নতুন এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তা ৬০টি দেশকে ছুঁয়ে যাবে। এ ঘোষণাটি দেয়ার আগে চীন বেশ ক'বছর এ নিয়ে কাজ করেছে। এ রকম অনেক কাজের একটি হলো, ২০০৪ সালে ইয়েলো নদীতে দেশের প্রথম উত্তর মেরু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা।


প্রশ্ন হলো, ঠিক কোন বিষয়টি উত্তর মেরুতে কজ করার বিষয়ে চীন ও রাশিয়াকে এক বিন্দুতে এনে মিলিত করলো? এর জবাব অনেকভাবে দেয়া যায়, যদিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কারণ একটিই। তা হলো, পোলার সিল্ক রোড শুধু রাশিয়াকেই নতুন একটি বাণিজ্যপথ খুলে দেবে তা নয়, এ সড়ক চীনকেও এনে দেবে আরো স্বাধীন একটি বাণিজ্যপথ। ভৌগোলিকভাবে দূরের বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করতে চীনকে এখন সুয়েজ খাল ও মালাক্কা প্রণালী ব্যবহার করতে হয়। নতুন সিল্ক রোড চালু হলে তার আর প্রয়োজন হবে না। আর তা হবে অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী ও সময়সাশ্রয়ী।


বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে হলে চাই চীন ও রাশিয়ার জোরালো আন্তরিক সহযোগিতা। এটি বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি ও ভূরাজনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনিবার্য। সুয়েজ খালের বাইরে এই নতুন বাণিজ্যপথ বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে এনে দেবে অন্যরকম গুরুত্ব এবং ইউরোপের বিরোধিতা করার নবতর শক্তি। অন্যদিকে চীনকে দেবে অনেক কম সময়ে ও কম খরচে ইউরোপের বাজারে প্রবেশের সুবিধা।


পৃথিবীর দক্ষিণ অংশ হিসেবে পরিচিত সাইবেরিয়ায় ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে হুমকি হিসেবে নিয়েছে রাশিয়া ও চীন। ওই অঞ্চলের উষ্ণ জলধারায় অবস্থান নিয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী। এর ফলে মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের পণ্য ও জ্বালানি আমদানি-রফতানি কঠিন হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে পেইচিং ও ওয়াশিংটনের মাঝে অনেক দিন থেকে মনকষাকষি চলছে। এ অবস্থায় রাশিয়ার মতো চীনও সাইবেরিয়ান রুটকে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার একট উপায় বলে মনে করছে। অনেকে বলছেন, নতুন নতুন রুট খোলা হলে বেরিং প্রণালীর গুরুত্বও বেড়ে যাবে। তখন তাকে নিয়েও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।


এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, রফতানির চাইতে চীনের আমদানির প্রয়োজন অনেক বেশি, বিশেষ করে হাইড্রোকার্বন। কারণ, দেশটিতে এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।


সাইবেরিয়া পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া সম্প্রতি ইয়াকুতিয়া থেকে চীনে গ্যাস রফতানি করেছে। দু'দেশ সম্প্রতি রাশিয়ার ইরকুতসে অবস্থিত ইয়ামাল এলএনজি প্ল্যান্ট থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীনে গ্যাস রফতানির বিষয়েও আলোচনা করেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে মনে করা হচ্ছে, চীনে জ্বালানি রফতানির জন্য নতুন আরো রুট খুলবে রাশিয়া। কারণ, সাইবেরিয়ার বিপুল জ্বালানিভাণ্ডার তো তার আছেই!


এদিকে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্কের পাশাপাশি নরডিক দেশগুলোর সাথেও সম্পর্ক গড়ছে চীন। চীন ইতিমধ্যে নিজেই নিজেকে ''উত্তর মেরু অঞ্চলের কাছের দেশ'' ঘোষণা করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা ইতিমধ্যে কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও আইসল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত আর্কটিক কাউন্সিলের পর্যবেক্ষক মর্যাদাও পেয়ে গেছে।


পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নরডিক দেশগুলো এক্ষেত্রে চীনকে সহযোগিতা করবে এমন সম্ভাবনা কম। কেননা, চীন ও রাশিয়ার নর্দার্ন ট্রানজিট রুটকে ''কেবলই অর্থনৈতিক'' সহযোগিতা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। অর্থনৈতিক সহযোগিতা একটা পর্যায়ে গিয়ে সামরিক সহযোগিতাকে ডেকে নিয়ে আসে।


তাহলে কী হবে? পর্যবেক্ষকদের মতে, আসলে সবাই যাতে আর্কটিক অঞ্চলের বিকল্প নৌপথ থেকে সমানভাবে লাভবান হতে পারে, সেটা দেখাই সবচাইতে বড় দরকার। এক্ষেত্রে নরডিক দেশগুলো সম্ভবত তাদের কৌশলগত অবস্থানকে গুরুত্ব দেবে এবং সমান সুবিধা পেতে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশের সাথে দরকষাকষির চেষ্টা করবে।


এখন আমরা দেখবো নর্দার্ন সিল্ক রোড বা এনএসআর থেকে বিশ্ববাণিজ্যব্যবস্থা কী সুবিধা পেতে পারে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা দেখতে পাবো, এ সড়কটি এশিয়া-ইউরোপ-এশিয়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে অর্থ ও সময় দু'টোরই বিশাল সাশ্রয় ঘটাবে। স্বাভাবিক সময়ে সুয়েজ খাল দিয়ে যাওয়ার চাইতে ১০ দিন এবং পানামা খালের চাইতে চার দিন সময় কম লাগবে। এটা বিশেষ করে তেল আমদানি ব্যয়ে বিরাট প্রভাব ফেলবে। তবে মুশকিল হলো, এনএসআর খোলা থাকবে বছরে মাত্র চার মাস - জুন থেকে সেপ্টেম্বর। বাকি সময় এটি বরফে ঢাকা থাকবে।


একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, আসলে এনএসআর এখন পর্যন্ত একটি ছোট বাজারের সম্ভাবনা তৈরি করেছে মাত্র। এজন্যেও লাগবে বিশেষ ধরনের জাহাজ। এরকম জাহাজ বানানো ব্যয়সাপেক্ষ আর চালানো কঠিন। মোটের ওপর যে বাণিজ্য সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তা খুবই সীমিত। এখানে গ্যাস আহরণ ও রফতানি শুরু হলে চীন ও রাশিয়াই মূলত লাভবান হবে। বাকি বিশ্বের তেমন বেশি লাভ হবে না।


ওই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, আমার মনে হয় না এনএসআর সারা বিশ্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ট্রান্সপোর্ট রুট হবে,অন্তত গামী কয়েক দশক পর্যন্ত তো নয়ই। কারণ, এ রুট দিয়ে মালবাহী জাহাজ চলতে পারবে না। কার্গো চলবে, তবে তাতে শুধু রাশিয়ারই লাভ। এর কোনো বৈশ্বিক তাৎপর্য নেই।


তবে বৈশ্বিক তাৎপর্য থাকুক  আর না-ই থাকুক, একট বিষয় পরিষ্কার যে, এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার বিদেশনির্ভরতা কমবে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেক বিষয়েই আর নির্ভর করতে হবে না। আর তাতে এ দু'দেশ আরো স্বাধীনভাবে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপসমূহ নিতে পারবে। এর ফলে স্বল্প মেয়াদে না-হলেও মধ্য মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হবে।


যুক্তরাষ্ট্র যে বিষয়টি জানে না, তা নয়। তারা বেশ ভালোভাবেই জানে এবং তাই চেষ্টা করছে ভারসাম্য রক্ষার। দেশটি এমন বিতর্কিত পন্থায় চীনকে ওই অঞ্চলে রাখতে চাচ্ছে, যা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আর চীন চেষ্টা করছে মার্কিন ফাঁদে কিছুতেই পা না দেয়ার।