৪০০ কোটি যাত্রী বহন করেছে যে বিস্ময়কর বিমান


  • মেহেদী হাসান
  • ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:১৩

অ্যাভিয়েশন ইতিহাসে বিস্ময়কর এক বিমানের নাম বোয়িং ৭৪৭। ১৯৭০ সালে চালু হওয়ার পর থেকে বোয়িং ৭৪৭ সারা বিশ্বে ৪০০ কোটিরও বেশি যাত্রী বহন করেছে। বোয়িং ৭৪৭ যখন নির্মিত হয় তখন এর সাথে তুলনা করার মতো কোনো বিমান ছিল না বিশ্বে। এ বিমান যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায় তখন।

সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিমান সংস্থার কাছে বোয়িং ৭৪৭ কুইন অব দি স্কাইস বা আকাশের রানি হিসেবে পরিচিতি। বোয়িং ৭৪৭ যখন চালু হয় তখন এটিই ছিল বিশ্বের দ্রুততম আর সবচেয়ে বড় যাত্রবাহী ও পণ্যবাহী বিমান। দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ রেকর্ড ধরে রাখতে সক্ষম হয় বোয়িং ৭৪৭।

বোয়িং ৭৪৭ শুধু যাত্রীবাহী বিমান নয়; বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনতে রয়েছে এর অসংখ্য সংস্করণ। বোয়িং ৭৪৭ এর রয়েছে সামরিক, বেসামরিক কার্গো সংস্করণ এবং এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত রেখেছে বোয়িং ৭৪৭। এমনকি নাসা এ বিমান ব্যবহার করে স্পেস শাটল ক্যারিয়ার হিসেবে। বোয়িং কেসি ৭৪৭ সংস্করণ আজ অবধি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার হিসেবে বিরাজমান বিশ্বে।

বোয়িং ৭৪৭ প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি । ১৯৭০ সালে সার্ভিসে যুক্ত হয় এ বিমান। বোয়িং ৭৪৭ প্রথম ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্যান এ্যাম ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ ।

১৯৭০ সালের ২২ জানুয়ারি বোয়িং ৭৪৭ প্রথম যাত্রা করে নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডন। এর যাত্রী সংখ্যা ছিল তখন ৩৫০ জন। গতি ঘন্টায় ৯০০ কিলোমিটার। যাত্রীধারণ ক্ষমতা, গতি এবং বিমানের আয়তন সবই ছিল তখন বিশ্ব রেকর্ড। প্রথম বিমানটির আয়তন ছিল ২২৫ ফিট। তখনকার পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিমানের তুলনায় এ আয়তন দ্বিগুনেরও বেশি। এত বড় বিমান দেখে অনেক যাত্রী তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তাদের এ বিস্ময়ের কথা এবং বোয়িং ৭৪৭ এ প্রথম ভ্রমনের অভিজ্ঞতা অনেকে লিখে রেখেছেন তাদের ডায়েরিতে। বিমান ভ্রমনে এত বিশাল আর বিলাসবহুল আয়োজন এর আগে দেখেনি বিশ্ব।

৭৪৭ বিমান এত বড় ছিল যে, বিশ্বের অনেক এয়ারপোর্টে এ বিমান অবতরনের সুযোগ ছিল না। অনেক বড় বড় এয়ারপোর্টও এ বিমানের অবতরণ বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে তখন। তারপরও প্যান এ্যাম এয়ারওয়েজ এ বিমান চালুর সাথে সাথে প্রতিযোগী অন্যান্য বড় বড় এয়ারলাইনসও এ বিমান তাদর এয়ারলাইনসে অন্তর্ভুক্ত করে। এ বিমান ব্যবহার ছিল তখন বিভিন্ন এয়ারলাইনস এর জন্য গৌরবের বিষয়।

এ বিমান প্রথম জাম্বো জেট হিসেবে পরিচিতি পায়। প্যান এ্যাম ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ প্রথম যখন এ বিমান ব্যবহার করে তখন প্যান এমের চেয়ারম্যান ছিলেন নাজিব ইলিয়াস হালবে জুনিয়র। নাজিব ইলিয়াসের কন্যা নূর ছিলেন জর্ডানের রানী। ১৯৬৬ সালে প্যান এ্যম ২৫টি ৭৪৭- ১০০ বিমান নির্মানের অর্ডার দেয়। সে সময়ে একসাথে এতগুলো বিশাল আর বিলাসবহুল বিমানের অর্ডার দেয়াটাও ছিল একটি তাক লাগানো ঘটনা।

বোয়িং ৭৪৭ এর ইঞ্জিন সংখ্যা ৪টি। ৫০ বছর আগে বোয়িং ৭৪৭ যে আকর্ষণীয় ডিজাইনে তৈরি করা হয় তা আজো আধুনিক হিসেবে পরিচিত। ৫০ বছর আগের বোয়িং ৭৪৭ এর ডিজাইন আজো অনুসরণ করে চলছে বিশ্বের অনেক বিমান সংস্থা। ৭৪৭ এর অনেক ইউনিক বৈশিষ্ট্য অনেক বিমান আজো অর্জন করতে পারেনি।

এয়ার ট্রাভেলে বৈপ¦বিক পরিবর্তন আনা বিমানের নাম ৭৪৭। কয়েক দশক পর্যন্ত সারা বিশ্বের যাত্রীদের প্রথম পছন্দের বিমান ছিল ৭৪৭। ১৯৯১ সালে বোয়িং ৭৪৭ এর একটি বিমান ১০৮৭ জন যাত্রী বহনের রেকর্ড স্থাপন করেন। অপারেশন সলোমন এর অংশ হিসেবে ইথিওপিয়া থেকে ইহুদীদের উদ্ধার করে ইসরাইলে নেয়া হয় তখন।

১৯৮২ সালে এনটোনভ-১২৪ রাসলান চালুর আগ পর্যন্ত ৭৪৭ বিমান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক বিমান। ২০০০ সালে ৭৪৭-৪০০ চালুর পর আবার অতিক্রম করে এনটোনভ -১২৪ রাসলানকে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৭৪৭ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমান। ১৯৭৪ সালে আকাশে ওড়ে বোয়িং ৭৪৭ এর নতুন একটি সংস্করণ কেসি ৭৪৭ এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার। আজ অবধি এর চেয়ে বড় কোনো এয়ার ট্যাঙ্কার নির্মিত হয়নি বিশ্বে। বিশ্বে অনেক বড় বড় ট্যাঙ্কার বিমান রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ডিসি-১০, ৭৬৭ এবং রাশিয়ান আইএল-৭৬ ডিজাইন অন্যতম। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বোয়িং কেসি ৭৪৭।

যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনী যে কেসি ৭৪৭ বিমান ব্যবহার করেছে সেগুলোর জ্বালানি বহন ক্ষমতা, পে লোড ক্ষমতা এবং গতি অন্যান্য এয়ার ট্যাঙ্কারের চেয়ে অনেক বেশি। কেসি-১০ এর চেয়ে ১ লাখ পাউন্ড বেশি জ্বালানি বহন করতে পারে কেসি-৭৪৭। কেসি -৭৪৭ এর পেলোড ক্ষমতা ২ লাখ পাউন্ড, জ্বালানি তেল বহন ক্ষমতা ৪ লাখ ৫৫ হাজার পাউন্ড। কেসি -৭৪৭ এরিয়েল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কারের গতি শব্দের চেয়ে দশমিক ৯২ গুণ বেশি।

২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বে মোট ১ হাজার ৫৫৮টি বোয়িং ৭৪৭ নির্মিত হয়। আরো ১৫টি ৭৫৭-৮ ডেলিভারীর অপেক্ষায় রয়েছে।

বোয়িং ৭৪৭ এর দুুটি প্লেন নাসা ব্যবহার করেছে স্পেস প্লেন হিসেবে। এর নাম শাটল ক্যারিয়ার এয়ারক্রাফট। ১৯৭৭ সালে ৭৪৭ বিমান নাসা প্রথম ব্যবহার করে স্পেস শাটল অরবিটার মহাকাশে পাঠানোর জন্য। সর্বশেষ ২০১২ সালে নাসা স্পেশ শাটল এন্ডেভার বোয়িং ৭৪৭ এর পিঠে চড়ে তিন দিনের মহাকাশ যাত্রা করে। নাসা যে দুটি বিমান স্পেস প্লেন হিসেবে ব্যবহার করছে তার নাম বোয়িং ৭৪৭-১০০ এবং ৭৪৭-১০০এসআর।

নাসার একটি ৭৪৭ বিমানে বসানো রয়েছে বিশাল আকারের টেলিস্কোপ। অতি উচুতে উঠে নাসা এ বিমানের সাহায্যে সোলার সিস্টেম পর্যবক্ষেন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বহনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্সের কাছে রয়েছে দুটি ৭৪৭ বিমান। এর বিশেষ নাম ভিসি-২৫। সারা বিশ্বের বেসামরিক এয়ারলাইন ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানবাহনীতেও রয়েছে ৭৪৭ এর বিভিন্ন সংস্করণ। পারমাণবিক যুদ্ধের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স প্রস্তুত রেখেছে ৭৪৭ বিমান। এ সংস্করণের নাম ই-৪বি। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত বিমান বা বিজনেজ জেট হলো বোয়িং ৭৪৭-৮।

বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনস এর চাহিদা অনুযায়ী ৭৪৭ এর বিভিন্ন ধরন তৈরি করা হয়। যাত্রীবাহী এসব বিমানের মধ্যে রয়েছে কেসি ৭৪৭-১০০, কেসি ৭৪৭ এসপি, কেসি ৭৪৭- ২০০, কেসি ৭৪৭-৪০০ এবং কেসি ৭৪৭-৮। বোয়িং ৭৪৭ এর মূল যে সংস্করণ ১৯৬৯ সালে প্রথম আকাশে ওড়ে সেটি ছিল ৭৪৭-১০০। ৭৪৭-১০০ এর সর্বোচ্চ টেক অফ ক্ষমতা ছিল ৩৩৩ টন। শীঘ্রই তৈরি করা হয় ৭৪৭-২০০ সংস্করণ। ১৯৭১ সালে বোয়িং তৈরি করে ৭৪৭-২০০ সংস্করণ। এর সর্বোচ্চ টেক অফ ক্ষমতা ৩৭৮ টন।

১৯৭৬ সালে চালু করে বোয়িং ৭৪৭ এসপি। ১৯৮৩ সালে চালু হয় ৭৪৭-৩০০। এর আপার ডেকে রয়েছে ৪০০ যাত্রী আসন। ১৯৮৯ সালে চালু হয় আরো ভারী ৭৪৭-৪০০। ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর বোয়িং নির্মান করে সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী আর বিলাসবহুল সংস্করণ ৭৪৭-৮।

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বোয়িং ৭৪৭ পালন করেছে প্রথম যাত্রার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব। ৫০ বছরে ৭৪৭ অতিক্রম করেছে ৫৭ বিলিয়ন নটিক্যাল মাইল। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৭৪৭ এখন পর্যন্ত বহন করেছে ৪শ কোটি যাত্রী। অপর একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ সংখ্যা ৫শ ৯০ কোটি।

গত কযেক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারলাইনস অবসরে পাঠাতে থাকে ৭৪৭। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বোয়িং ৭৪৭ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে জাপান। ৪০ বছরে জাপান ১০৬টি বোয়িং ৭৪৭ ক্রয় করেছে। ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪৬২টি বোয়িং ৭৪৭ সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন এয়ার লাইনে।

বোয়িং ঘোষণা দিয়েছে ২০২২ সালের পর নতুন কোনো ৭৪৭ বিমান নির্মান করবে না।

১৯৫৮ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে বোয়িং ৭০৭ এয়ার ট্যাঙ্কার। প্যান এ্যাম তখন দাবি জানায় ৭০৭ এর চেয়ে আড়াই গুণ বড় আরেকটি এয়ার ট্যাঙ্কারের। প্যান এ্যামের এ চাহিদার ভিত্তিতে বোয়িং উদ্যোগ নেয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এয়ার ট্যাঙ্কার নির্মানের। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বোয়িং নির্মান শুরু করে কেসি-৭৪৭।

এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৬৬ জন। ক্রুজ স্পিড শব্দের চেয়ে দশমিক ৮৫ গুণ বেশি। ঘন্টায় ৯০০ কিলোমিটার। এটা ছিল আংশিক ডাবল ডেক প্লেন। এভাবে অ্যাভিয়েশন ইতিহাসে আবির্র্ভূত হয় বিস্ময়কর বোয়িং ৭৪৭।