মিন অং হ্লাইং : ক্ষমতালোভী এক জেনারেল


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:২২

আবার দৃশ্যপটে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। দেশটির নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে এবার তারা ক্ষমতা দখল করেছে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বে। সেনা কর্মকর্তা হওয়ার পরও অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে। অবশেষে সেটিই বাস্তব হলো।

১৯৫৬ সালে দক্ষিণ মিয়ানমারে তাভোয় এলাকায় জন্ম মিন অংয়ের। এলাকাটির নতুন নাম দাবেই। বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করতেন মিয়ানমারের অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। ইয়াঙ্গুনের একটি নামকরা স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করার পর ইয়াঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন আইন বিষয়ে। সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার ঝোঁক ছিল তার স্কুলজীবন থেকেই। যে কারণে দুইবার ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েননি। তিনবারের চেষ্টায় অবশেষে ১৯৭৪ সালে সুযোগ পান মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে।

ছাত্র হিসেবে খুব বেশি মেধাবী ছিলেন না বলে তার সহপাঠীরা বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। মাঝারি মানের ফলাফল নিয়ে ডিফেন্স একাডেমি থেকে পাস করে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। তবে এক পর্যায়ে ঠিকই পৌঁছে গেছেন পেশা জীবনের সর্বোচ্চ ধাপে।

সেনাবাহিনীতে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। ওই বছর মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে স্থানীয়রা বিক্ষোভ শুরু করে। ওই বিক্ষোভ দমাতে সেনাবাহিনী পাঠায় সরকার। সে সময় ওই অঞ্চলের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মিন অং। তার নেতৃত্বে কঠোর হাতে দমন করা হয় ওই বিক্ষোভ। বহু মানুষ হতাহত হয় সে সময়।

এর এক বছর পরপূর্বাঞ্চলীয় একটি বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ২০ বছরের অস্ত্র বিরতি লঙ্ঘন করে তারা সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা করতে শুরু করে। ওই সঙ্ঘাতে প্রায় ৪০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়ে চীনে আশ্রয় নেয়। এই বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দেয়া হয় মিন অংয়ের ওপর। এবং সেখানেও তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহীদের দমন করেন।সামরিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, এই দুটি সাফল্য মিন অংকে সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি পেতে সাহায্য করে। ২০১১ সালে যখন মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আলোচনা শুরু হয় সে সময়ই সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই জেনারেল।

২০১৫ সালে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরলেও সেটি পুরোপুরি সামরিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। দীর্ঘ সামরিক শাসনে চলা দেশটির গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর থাকে সামরিক ছায়া। এবং সেটি এই জেনারেলের ইচ্ছাতেই। সেনাপ্রধান হলেও তিনি সব সময়ই রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে চাইতেন। ২০১৬ সালে মিন অং এক বক্তৃতায় বলেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব স্থানীয় ভুমিকা রাখতে হবে। তার হতে সেই সুযোগটাও ছিলো।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকার কারণে সেনাপ্রধান যে কোন বিল বা সংবিধানের সংশোধনীতে ভেটো দিতে পারতেন। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ৩জন মন্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া হতো সেনাবাহিনীর পছন্দ অনুযায়ী। সেটিও ছিলো রাজনীতির ওপর এই জেনাারেলের আরেকটি প্রভাবের জায়গা। হয়তো রাজনীতির ওপর এত প্রভাব খাটাতে খাটাতেই এক সময় তার মনেও ইচ্ছে জাগে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার।

সামরিক উর্দি গায়ে থাকলেও এই জেনারেলের মনে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস যে ছিলো সেটি অনেকেরই জানা। রাষ্ট্রপ্রধানের পদটির দিকে তার অনেক দিন ধরেই লোভ। ২০১৫ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, জনগণ চাইলে আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি।

২০২১ সালের জুলাই মাসেই জেনারেল মিন অংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা। অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী তার অবসরের সময় হয়ে গেছে ৫ বছর আগেই; কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে ৫ বছরের জন্য নিজের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ২০১৬ সালে। চলতি বছর সেই বর্ধিত মেয়াদও শেষ হওয়ার কথা।

গত নভেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপি বড় ব্যবধানে হেরে যায়।এই জেনারেলের ইচ্ছে ছিলো সেনা সমর্থিত দলটি নির্বাচনে জিতলে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের পদে বসবেন; কিন্তু ভোটের মাঠে জিতে যায় অং সান সু চির দল। ফলে তার রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা নেয়ার সম্ভাবনার কবর রচিত হয়।তাইতো শেষ মূহুর্তে এসে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে জেনারেল মিন অং বেছে নিলেন ক্ষমতা দখলের পথ।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের আইন বিভাগের প্রফেসর মেলিস ক্রাউচের মতে, অনেক দিন ধরেই জেনারেল মিন অংয়ের চোখ প্রেসিডেন্টের চেয়ারের দিকে;কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেটি সম্ভব নয় বুঝতে পেরেই তিনি ক্ষমতা দখলের পথ বেছে নিয়েছেন।

২০০৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যে সংবিধান প্রণয়ন করেছে তাতে পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ সিট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল সেনাবাহিনীর জন্য। তাই সরকার গঠনের জন্য ইউএসডিপির দরকার ছিলো ১৬৭টি আসনে জেতার; কিন্তু ৪৯৮টি আসনের মধ্যে তারা জিতেছে মাত্র ৩৩টিকে। অন্য দিকে অং সান সু চির লিগ ফর ডেমেক্রেসি জিতেছে ৩৯৬টিতে। এরপর পহেলা ফেব্রুয়ারি যখন নতুন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিলো, সেদিনই ঘটলো রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান।

২০১১ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার সময় জেনারেল মিন অংয়ের বাইরের জগতে কোন পরিচিতি ছিলো না। ২০১৬ সালে ক্ষমতার মেয়াদ ৫ বছর বাড়িয়ে নেয়ার পর থেকেই তার মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ভর করতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশায় ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেন। এসময় তিনি ক্রমান্বয়ে সামরিক পরিচয়ের ব্যারিকেড ভেঙে নিজেকে পাবলিক ফিগারে পরিণত করতে কাজ শুরু করেন। এর প্রথম পদক্ষেপটি ছিলো সোস্যাল মিডিয়ায় নিজেকে তুলে ধরা।

সামরিক কর্মকর্তাদের সামাজিক কাজ কর্মে জড়িত হওয়ার নজির না থাকলেও এই জেনারেল সেটিই শুরু করেন জোরেসোরে এবং সেগুলো সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারও করতে থাকেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দির সফর এবং সেখানে অনুদান দেয়া, কিংবা সুশীল সমাজের সাথে বৈঠক করতে থাকেন নিয়মিত।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি ফেসবুক পেজ ছিলো, যার একটিতে লাইকের সংখ্যা ছিলো ১৩ লাখের বেশি। এই পেজ দুটির মাধ্যমে চলতো জেনারেল মিন অংয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রচারণা। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা গোপন করতে পেজ দুটি থেকে বিভিন্ন মিথ্যা প্রচারণা চালানোর পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ পেজ দুটি বন্ধ করে দেয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর মাস্টার মাইন্ড যে এই সেনাপ্রধান সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।যে কারণে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ক সব মামলায় তিনিই প্রধান আসামী। তার বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নাম করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে নামে ২০১৬ সালে। নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় সেনা সদস্যরা। গুলি, আগুনে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা, আর প্রাণ বাচাতে ৭ লাখের বেশি মানুষ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।

বিশ^ সম্প্রদায়ের নিন্দা, প্রতিবাদ সত্ত্বেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই গণহত্যাকে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিনিয়ত বক্তৃতা দিয়ে গেছে। বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে জেনারেল মিন এই গণহত্যাকে বৈধতা দিতে চেষ্টা করে গেছেন অবিরত।
যে কারণ ইয়াঙ্গুন ভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার নামের একটি ম্যাগাজিন এই সেনা কর্মকর্তাকে আখ্যা দিয়েছে বিশে^র সবচেয়ে বড় ফেরারি হিসেবে। রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছে জেনারেল মিন ও তার সংশ্লিষ্টতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিতে।

রোহিঙ্গাদের সব সময় অবৈধ বাঙ্গালি হিসেবে আখ্যায়িত করতো মিয়ানমার। রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর আগে সেনাপ্রধান মিন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাঙ্গালি সমস্যা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা এবং সেটির মীমাংসা হয়নি আজো।

এখানে মীমাংসা বলতে যে তিনি রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করাকে বুঝিয়েছেন সেটি পরবর্তীতে বুঝেছে বিশ^, যখন তার বাহিনীর হাতে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।

রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের বাইরে জেনারেল মিন অংয়ের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষাও একটি বড় কারণ তার ক্ষমতা দখলের পেছনে। অনেক দিন ধরেই তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগ আছে। এমন কিছু লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত আছে যেটি আইনত বৈধ নয়।

সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিডেট নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় একটি শেয়ার তার নামে। ২০১০-১১ অর্থ বছরে এ বাবদ তিনি আড়াই লাখ মার্কিন ডলার লভ্যাংশ বাবদ নিয়েছেন বলে উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া তিনিজড়িত আছেন মিয়ানমার ইকোনমিক কোঅপারেশন নামের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথেও। জেমস, কপার, টেলিযোগাযোগ ও বস্ত্রখাতে বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠান দুটি।