মানসিক চাপে ভারতের সেনারা, বাড়ছে আত্মহত্যা


  • মোতালেব জামালী
  • ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১২

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী বা গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান- এই দুটি কঠিন লড়াইয়ে জড়িত থাকার ফলে দেশটির সেনাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও অবসাদ তৈরি হয়েছে। মানসিক চাপ তৈরির ক্ষেত্রে নানা কারণের মধ্যে এ দুটি কারণই প্রধান বলে ভারতেরই একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে।

ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া (ইউএসআই)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কর্নেল এ কে মুর ২০১৯-২০২০ সালে এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছেন। গত মাসে ইউএসআই-এর ওয়েবসাইটে এই সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ভারতের তিন বাহিনী প্রধান জেনারেল এমএম নারাভানে, অ্যাডমিরাল করম বীর সিং ও এয়ার চীফ মার্শাল আর কে এস ভাদুরিয়া এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ভাইস অ্যাডমিরাল আর হরি কুমার।

সমীক্ষায় কর্নেল এ কে মুর বলেছেন, প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকা এসব সেনাসদস্য চাপ সামলাতে না পেরে অনেক সময় আত্মহত্যা করছেন, আবার কখনও ভাইবোন বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে হত্যা করছেন। আবার কখনও অন্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। প্রতি বছর শত্রুর হামলায় যত না সেনা সদস্য মারা যাচ্ছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মারা যাচ্ছেন মানসিক চাপে ভোগার কারণে। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতি বছর তার অনেক সদস্যকে হারাচ্ছে। এটা দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত প্রায় দুই দশকে ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরির এই হারটা অনেক বেড়ে গেছে। যারা বিভিন্ন ধরনের অভিযানে অংশ নিয়েছে শুধু তারাই নয়, যারা অভিযানে অংশ নেননি তাদেরও অনেকে এই সমস্যায় ভুগছেন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর মোট সদস্যের অর্ধেকেরও বেশি প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভুগছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে। সেনা সদস্যদের এই মানসিক সমস্যা দূর করতে গত ১৫ বছরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাতে কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর যেসব ইউনিট ও উপ-ইউনিটের সদস্যরা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে, সেখানে শৃঙ্খলা না মানার প্রবণতা, চলা, প্রশিক্ষণ নিয়ে অসন্তোষ, সরঞ্জামের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও মনোবল কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ ও অভিযানে অংশগ্রহণকালের পারফরমেন্সে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সমীক্ষায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টির নানা কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারণের মধ্যে উর্ধতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বের মানের ঘাটতি, অঙ্গিকারের ভারী বোঝা, সম্পদের অপর্যাপ্ততা, যখন-তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, পদোন্নতি ও পোস্টিং দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যথার্থতার অভাব, বাসস্থানের সংকট ও ছুটি মঞ্জুর না করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোগত কারণে প্রধান প্রধান যে সমস্যাগুলোর জন্য জুনিয়র কমিশনড অফিসার জেসিও) ও অন্যান্য র‌্যাঙ্কের কর্মকর্তারা মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন সেগুলোর কথাও কথাও সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ছুটি না দেয়া বা ছুটি মঞ্জুরে অহেতুক বিলম্ব কর্,া মাত্রাতিরিক্ত প্রশিক্ষণ বা অন্য কাজে জড়িত করে রাখা, বাস¯’ানের সমস্যা, উর্ধতন কর্মকর্তাদের হয়রানি ও নির্যাতনের স্বীকার হওয়া, মর্যাদার অভাব, মোবাইল ফোন ব্যবহারে মাত্রাতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপ, বিনোদন সুবিধার অভাব এবং ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও অধস্তনদের সাথে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।

আত্মহত্যাসহ উল্লেখিত কারণে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রতি বছর যে সৈন্য মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি সৈন্য মারা যাচ্ছে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা ও এ ধরনের অন্যান্য ঘটনায়। এর বাইরেও হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, মনোবৈকল্য, স্নায়ুবৈকল্য ও এ ধরনের অন্যান্য রোগে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা সদস্য মারা যাচ্ছে ভারতে।

চীন ভারতের সাথে লাদাখ সীমান্তে আরো ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। চীনের অনেক ভিতরে থাকা এসব সৈণ্যকে পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে নিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও সেখনে সেনাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য ভারী অস্ত্রও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে সীমান্তের একেবারে সামনের সারিতে মোতায়েন করে রাখা সৈন্যদের অবস্থানের কোন পরিবর্তন করা হয়নি । প্রচণ্ড শীতের কারণে চীনের ‘অনের গভীর এলাকা’ থেকে সরিয়ে এন এসব সৈন্যকে লাদাখ সীমন্তে মোতায়েন করা হয়েছে।

ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের এসব সৈন্য লাদাখ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে ঠিক ১৫০ কিলোমিটার পূবর্ দিকে অবস্থিত একটি প্রশিক্ষণ এলাকা ও এর আশেপাশের স্থান থেকে আনা হয়েছে।

লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি এই সীমান্তে টহলরত এক চীনা সৈন্য ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। পরে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ৮ জানুয়ারি ভারতের সীমান্তে ঢুকে পড়া চীনা সেনাকে সম্প্রতি চুশুল মল্ডোতে বেইজিংয়ের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এর আগে চীনের সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, আটক সেনা ভুল করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। রাতের অন্ধকারে ভৌগলিক অব¯’ান সে বুঝতে পারেনি। এ কারণেই তার ভুল হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা আশা করছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই জওয়ানকে খুঁজতে সাহায্য করবে। পরে তারা জানতে পারে সে ভারতীয় সেনাদের হাতেই আটক হয়েছে ।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, প্রায় ২ ঘণ্টা পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আটকের খবর নিশ্চিত করা হয়। এরপরই চীনের পক্ষ থেকে ভারতকে দ্বিপাক্ষীয় বৈঠকের সমঝোতা অনুযায়ী কাজ করতে ও আটক সেনা সদস্যকে দ্রুত ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচচারণ করা হয় চীনের পক্ষ থেকে।

এর আগে গত বছর ১৯ অক্টোবর এক চীনা সেনাকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরে চশুল সীমান্তে প্রোটোকল মেনে তাকে চীনের হাতে ফিরিয়ে দেয় ভারত। গত বছর মে মাসে ভারত অভিযোগ করে যে, চীনা সেনারা লাদাখ সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। এর পরই এই সীমান্তে ভারত হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করে। পরে চীনও তার সামরিক শক্তি বাড়ায় সেখানে। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পরও সেই উত্তেজনা কমেনি।

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের এক প্রতিবেদণে বলা হয়েছে, চলমান উত্তেজনার মধ্যে এই সীমান্তে চীন ভারতের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপ্রচলিত ও অভিনব’ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। চীন লাদাখ সীমান্তের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ ভারতের।

কয়েক মাসের উত্তেজনার এক পর্যায়ে গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি লাদাখের প্যানগং সো ও গালওয়ান উপত্যকায় চীনা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হাতাহাতি এই যুদ্ধে ধারালো পাথর, লোহার রড, ও পেরেক বসানো মুগুর ব্যবহার করে চীনা বাহিনী।

এই যুদ্ধে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। এ ঘটনার পর দুই দেশই লাদাখ সীমান্ত ও উত্তর-পূর্বের অরুনাচল পর্যন্ত ভারী অস্ত্র ও বিপুল সেনা মোতায়েন করেছে। এনিয়ে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা দক্ষিন এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

গত ১১ জানুয়ারি চীনের প্রেসিডেন্ট তার দেশের সেনাবাহিনীকে যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধে সাড়া দিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন।

চীনা সামরিক বাহিনীর বাৎসরিক সামরিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া উদ্বোধনকালে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে সার্বক্ষণিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে যাতে সেকেন্ডের মধ্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। এজন্য সৈন্যদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। লাদাখ সীমান্তে ভারতের সাথে চলমান উত্তেজনার মধ্যে তার এই আহ্বান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।