কিশোরীর ডাকে সাড়া দিয়ে গল্পকেও হার মানিয়েছে তুরস্ক

লেয়লা বলেছেন, আমি আমাদের দেশ নিয়ে গর্বিত - আনাদুলো

  • সাইমা আকন্দ
  • ০৮ মে ২০২০, ০৮:৩০

ঘটনাটা অনেকটা সিনেমার মতো। প্রবাসে এক রোগি বেঁচে থাকার আকুতি জানালেন। সেই আকুতি চোখে পড়লো নিজের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। তারপর যা ঘটতে থাকলো সবই চোখের পলকে। সিনেমার নায়িকাকে বাঁচাতে যেমন তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তেমন পদক্ষেপই নিয়েছে তুরস্ক।

সুইডেনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন তুরস্কের নাগরিক এমরুল্লাহ গলুসকেন। তার কন্যা লেয়লা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহ হলে চিকিৎসককে খবর দেওয়া হয়। বাড়িতে একজন চিকিৎসক আসেন। বাবাকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

হাসপাতালে নেওয়ার পর লেয়লার বাবার শরীরে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। ভালো চিকিৎসা করাতে মরিয়া হয়ে যায় পরিবার। কিন্তু লেয়লাদের মনে হতে থাকে সুইডেনের ওই হাসপাতালে তার বাবাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ঠিকভাবে চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না।

লেয়লা তুর্কি কন্যা। নিজের দেশের প্রতি আস্থা প্রবল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই কঠিন সময়ে দেশের কাছে কিছু চাইবেন। দেশটির নেতা রজব তাইয়েব এরদোগানের সরকারের প্রতি তার বিশ্বাস গাঢ়। তিনি প্রবাসে থেকেই বাবার স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করলেন টুইটারে। এতে জানিয়েছেন, তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সুইডেনে ঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এমন কঠিন বিষয়ে নিজের দেশকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

লেয়লার এই আ্বান নজরে আসে তুরস্কের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. ফাহরেদ্দিন খোজার। তিনি তার ভেরিফাইড আইডি থেকে সাড়া দিয়ে লিখেন, ‘হ্যালো লেয়লা। আমরা আপনাকে শুনতে পেয়েছি। আমরা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সুইডেনে আসছি। আমাদের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বিমানটি ভোর ছয়টায় রওনা হচ্ছে। তুরস্কের হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা আপনার বাবার চিকিৎসা করতে প্রস্তুত। আমাদের প্রেসিডেন্টের শুভেচ্ছা নেবেন।’

এর পর সুইডেনের মালমো বিমানবন্দরে পৌঁছায় জিএমটি ০৭০০ বিমান। সুইডেন থেকে করোনায় আক্রান্ত ৪৭ বছর বয়সি এমরুল্লাহ গরূসকেন এবং তার তিন কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয় মাত্র সাত থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধানে।

সুইডেন থেকে করোনায় আক্রান্ত ৪৭ বছর বয়সি এমরুল্লাহ গরূসকেন এবং তার তিন কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয় মাত্র সাত থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধানে। ছবি : টিআরটি ওয়ার্ল্ড
সুইডেন থেকে করোনায় আক্রান্ত ৪৭ বছর বয়সি এমরুল্লাহ গরূসকেন এবং তার তিন কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয় মাত্র সাত থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধানে। ছবি : টিআরটি ওয়ার্ল্ড

 

পরে শুরু হয় চিকিৎসা তৎপরতা। রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পর এমরুল্লাহ গুলসকেন এবং তার তিন কন্যাকে আনকারর ইহির হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

তুরস্কের এমন পদক্ষেপে মুগ্ধ হন লেয়লা। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ঘটনাটি ফলাও করে প্রচার হওয়ায় প্রশংসার জুয়ারে ভাসতে থাকে দেশটি। এর বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকে সুইডেন সরকারের।

দেশে ফেরার পর লেয়লা টুইটে লিখেন, ‘আমি জানতাম আমার দেশ আমাকে সমর্থন করবে। এই কঠিন সময়ে দেশ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রেসিডেন্ট রজব হাইয়্যেব এরদোগান ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী খোজাকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।’

লেয়লা আরো লিখেন, ‘তুরস্কের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন আমার টুইটের জবাব দিয়েছেন, এর পর থেকে তুর্কি কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ করে গেছেন। আল্লাহ আমাদের দেশকে রক্ষা করুন।’

গলুসকেন ও তার পরিবারকে বহনকারী এই বিশেষ ফ্লাইট দেশে ফেরার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী খোজা লেইলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ওই কন্যা যা করেছে, সেটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার আহ্বানে আমরাও দ্রুত সাড়া দিয়েছিলাম।’

তুরস্কের যোগাযোগ পরিচালক ফাহেরেদ্দিন আলতুন এক টুইটে বলেন, ‘তুরস্কের নাগরিক এমরুল্লাহ গলুসকেন সুইডেনে ভাইরাসে পজিটিভ ধরা পড়লেও তার চিকিৎসা হয়নি। আমরা তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তুরস্কে নিয়ে এসেছি।’

টুইটারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পোস্ট
টুইটারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পোস্ট

 

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত এমরুল্লাহ গলুসকেন এর নিবিড় চিকিৎসা চলছে। স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম জানায়, চিকিৎসার নিয়মিত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট স্বয়ং।

হেবারলার ডটকম নামের ওই সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, দেশে ফেরার পর লেয়লার সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন এরদোগান। ২৬ এপ্রিল তিনি একটি টুইটবার্তায় জানান, ‘আজ আমি আমার বোন লেয়লার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছি। লেয়লা এমরুল্লাহর মেয়ে। তাকে আমরা সুইডেন থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে নিয়ে এসেছি।’ ওই পোস্টেই ফোনকলটিও প্রকাশ করা হয়।

যেখানে শুনা যায় এরদোগান বলছেন, ‘আপনার বাবা তুরস্কে পৌঁছেছেন। আমি আশা করি আমাদের সহকর্মীরা তাকে সুস্থ্য করে তুলবেন। আল্লাহ তাকে নিরাময় দেবেন। আপনি চিন্তা করবেন না।’

জবাবে লেয়লা বলেছেন, ‘আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুশি। আমি আমাদের দেশ এবং আপনাকে নিয়ে গর্বিত। আমার বাবাকে দেশ নিয়ে আসায় কৃতজ্ঞ। যারা এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। আমরা বেঁচে আছি বলে আনন্দিত।’

করোনা মোকাবেলায় তুরস্ক কেবল নিজেদের দেশের নাগরিকদের বেলায়ই তৎপর নয়। বরং বিশ্বের বেশ কিছু দেশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে দেশটি। মূলত ঘরে-বাইরে লড়াই করছে তুরস্ক। প্রথম দিকে করোনা মোকাবেলা যতটা সহজ হবে বলে ভাবা হচ্ছিলো, বাস্তবতা ততটা সহজ না হওয়ায় এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। এখন তিনি নিজের দেশে লড়ছেন, অন্য দেশকেও সহযোগিতা করছেন।

তুরস্কে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ১১ই মার্চ। কিন্তু এরও বহু আগে জানুয়রি মাসেই মোকাবেলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। চীন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা শনাক্তর ঘোষণা আসে ৭ জানুয়ারি। এর ঠিক তিনদিন পর অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি তুরস্ক সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় করোনা প্রতিরোধে একটি কমিটি গঠন করে। এতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন এবং স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের রাখা হয়। এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় দেশটির সকল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এই কমিটিই।

করোনা প্রতিরোধ কমিটির প্রতিটি পদক্ষেপই সাড়া ফেলে বিশ্বে। ১১ মার্চ দেশটিতে প্রথম আক্রান্ত পাওয়া যায়। ১৪ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। প্রতিদন আপডেট দিতে থাকেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কোনো কোনো দিন স্বয়ং প্রেসিডেন্টও পরিস্থিতি ব্রিফ করেন।

করোনা রোগীর চিকিৎসায় কিছু আলাদা হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। টেস্ট করা হয় বিনাখরচায়। চিকিৎসায় নিয়োজিতদের কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

একদিকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। অন্যদিকে চলতে থাকে আর্থিক চাকা সচল রাখার কৌশল। তাই তুরস্ক নেয় মধ্যমপন্থা। কিছু কিছু নাগরিকদের ঘরের বাইরে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। নিষেধ না মানলে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ হাজারের মতো জরিমানা করা হয়। যারা ঘরে আছেন, তাদের বাজার করার দায়িত্ব নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল ফোন করলেই ঘরে বাজার পৌঁছে দেওয়া হয়। করোনার সময়ে কাজ হারানো ২৩ লাখ নাগরিককে এক হাজার লিরা করে দিয়েছে সরকার। যা বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ১২ হাজার।

সরকার নাগরিকদের জন্য ফ্রি করে দেয় মাস্ক। নির্দিষ্ট নিয়মে আবেদন করলেই ডাক বিভাগের মাধ্যমে সরকার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সপ্তাহে ৫টি মাস্ক বাসায় পৌছে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতাও রক্ষা করা হচ্ছে। প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত নম্বরের মাধ্যমে তা যাচাই-বাচাই করার পরই পাঠানো হচ্ছে মাস্ক গুলো।
এদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোগান করোনা প্যান্ডামিকে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করতে অনলাইনে ‘ন্যাশনাল সলিডেটরি ক্যাম্পেইন’ নামে একটি তহবিল গঠন করেছেন। নিজের সাত মাসের বেতন এই তহবিলে দান করে তা উদ্বোধন করেন তিনি। এছাড়া তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের ধনাট্য ব্যক্তিরাও অসহায়দের নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। সাপ্তাহিক হাটগুলোতে একটি বুথ খোলা হয়েছে। সামর্থবানরা এইসব বুথে প্রয়োজনীয় পণ্য রেখে যান। আর যাদের দরকার তারা এখান থেকে নিয়ে যান।

করেনা সংকট মোকাবিলায় তুরস্কের মসজিদগুলোও ভুমিকা রাখছে। ইস্তানবুলের সারিয়ে এলাকার একটি মসজিদের জুতা রাখার র‌্যাককে তৈরি করা হয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মতো করে। এখানে থরে থরে সাজানো আছে নিত্যপণ্য। অনেক ধনকুবের এগিয়ে আসছেন সাহায্যর হাত নিয়ে। তারা নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে মধ্যবিত্তদের দোকানের বকেয়া পরিশোধ করে দিচ্ছেন বলেও খবর প্রকাশ করছে গণমাধ্যম।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন