বেকার সমস্যা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে

ছবি - সংগৃহীত -

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২০ এপ্রিল ২০২০, ১৪:২০

রাতশেষে এক সময় ভোর হয়, সূর্য ওঠে। প্রকৃতির এ নিয়মে আশা করা যায়, করোনার এই দুঃস্বপ্নের রাতও একদিন অবসান হবে। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু করোনা দানব যে মারণকামড় বসিয়ে দিয়ে গেল পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ ও তার শরীরে, তার ব্যথা কি সহজে সারবে?

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, করোনা মহামারীর কারণে ক্রমাগত লকডাউন ও অর্থনৈতিক ধ্বসের ফলে আগামী মাসগুলোতে বেশিরভাগ উন্নত দেশেও এর ফল হবে ভয়াবহ রকমের খারাপ। যদি এখনই কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাহলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবে। দেখা যাবে বেকারত্বের দুর্বিষহ রূপ।

এমনিতে বিশ্বে বেকারের সংখ্যা ১৯০ মিলিয়ন, তার ওপর করোনার কারণে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্টান লে অফ ঘোষণা এবং কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেয়ার ফলে এ হার আরো ব্যাপকভাবে বাড়বে। বিশেষ করে দরিদ্রতম দেশগুলোতে, যেখানে বেকার ভাতার মতো সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী নেই, সেসব দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষগুলোর ওপর এর তীব্র বিরূপ প্রভাব পড়বে।

যখন থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে তখন থেকেই গাড়ি, কাপড়চোপড় ও জুতা প্রস্তুত ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে এসব খাতে কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটা নিতে পারে একটা দুষ্টচক্রের রূপ, যা প্রভাব ফেলবে মানুষের বায়িং হ্যাবিট বা কেনাকাটার অভ্যাসের ওপর। ওই মানুষটি হতে পারেন ওয়াল স্ট্রীটের একজন ধনাঢ্য ব্যাংকার, যিনি কেনাকাটা করেন অভিজাত বিপণী 'জারা' থেকে অথবা হতে পারেন একজন পোশাককর্মী, যিনি বাস করেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কোনো ঘিঞ্জি বস্তিতে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও এক প্রাথমিক হিসাবে বলেছে, করোনা মহামারীতে কর্মস্থল পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ হওয়ার কারণে প্রতি পাঁচ জন কর্মীর চারজন বা তারও বেশি কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এটা হবে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মী মানুষের ৮১ শতাংশ। বলে রাখা ভালো, মাত্র তিন সপ্তাহ আগেও এ সংখ্যা আন্দাজ করা হয়েছিল আড়াই কোটি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই করোনা ভাইরাস গ্রাস করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি এবং অন্য অনেক দেশকে, সংহার করে হাজার হাজার প্রান, বিভিন্ন দেশের সরকারকে বাধ্য করে কঠোর কারফিউ জারি এবং লোকজনের চলাফেরা সীমিত করতে।

গত তিন সপ্তাহে কেবল ধনী দেশ আমেরিকাতেই করোনার কারণে বেকার হয়ে পড়া এক কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ সরকারের সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও মনে করছে, আগামী তিন মাসে প্রায় ২০ কোটি ফুলটাইম কর্মী চাকরি হারাতে পারেন। আইএলও-র মহাপরিচালক গাই রাইডার  বলেন, ''উন্নত ও উন্নয়নশীল - উভয় বিশ্বে ব্যবসা প্রতিষ্টান ও কর্মী দু'টিই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আমাদের দ্রূত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। আমাদের সঠিক ও তৎপর সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমই স্থির করে দেবে আমরা টিকে থাকবো না তলিয়ে যাব।''

করোনার আঘাতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেসব খাত, যেখানে কর্মরতদের বেশিরভাগই কম-দক্ষ এবং তাদের বেতনও কম। যেমন, নির্মাণ খাত। এছাড়া কঠিন সমস্যায় পড়বে বিশ্বের ১২৫ কোটি বা মোট বৈশ্বিক শ্রমশক্তির ৩৮ শতাংশ, যারা কাজ করে হোটেল-রেস্তেরাঁ বা বিভিন্ন শপিং ম্যলের দোকানে।

আইএলও মনে করছে, করোনার সবচাইতে বড় শিকার হবে খুচরা ও পাইকারি পণ্য বিক্রির খাত, যেখানে সারা বিশ্বে কাজ করে ৪৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হবে মিশরের মতো দেশগুলোকে, যাদের জিডিপি-র একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে এ খাত থেকে।

শ্রমবাজারকে চাঙ্গা রাখতে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে সরকার। কিন্তু বেশিরভাগ দেশের সরকারেরই সে সামর্থ্য নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো অনেক উন্নত দেশেই সুদহার এমনিতেই কম। তার মানে ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ এবং ঋণ দেয়ার মতো প্রচুর তহবিল তাদের হাতে আছে, যদিও বর্তমান অবস্থায় তা যথেষ্ট নয়। এমনকি চলতি বছরের গোড়ার দিকে সঙ্কটের সূচনাকালে এ অর্থ যোগান দেয়া হলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেত না।

এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো নানারকম প্রণোদনামূলক প্যাকেজের মাধ্যমে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার যোগান দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এর মধ্যে আছে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি, কর হ্রাস, নগদ সাহায্য ও ঋণ প্রদান।

উন্নত দেশগুলোর স্টোর বা দোকানপাট যত বেশি দিন ধরে বন্ধ থাকবে, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর টেক্সটাইল খাতের অনিশ্চয়তাও ততোই বাড়বে এবং ঘটছেও তা-ই। বেশ ক'টি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক দেশ ইতিমধ্যে ওয়ালমার্টের মতো বড় বড় ক্রেতাদের আবেদন জানিয়েছে যেন তারা ক্রয়াদেশ ও ক্রয়মূল্য না কমায়।

পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতেও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির গার্মেন্টস খাতে কাজে কাজ করে ১০ লাখেরও বেশি কর্মী, যাদের ৮০ শতাংশই নারী।গার্মেন্টস খাতে কোনো রকম অচলাবস্থা সৃষ্টি মানেই এদের জীবনও মোটামুটি অচল হয়ে পড়া।

এদিকে সারা বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। কাগজে-কলমে এদের চাকরির কোনো প্রমাণ নেই। ফলে সঙ্কটকালে এরা পায় না কোনো সামাজিক সুরক্ষা সেবা। ভারতের গৃহকর্মী, পাকিস্তানে রাস্তার ধারে বসে জুতা বা সাইকেল মেরামত কাজে নিয়োজিত মানুষ কিংবা দুবাইয়ে কর্মরত নির্মাণশ্রমিক - সবাই এ দলেই।

আইএলও সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের প্রায় ৯০ শতাংশই এবারের সঙ্কটে আরো গভীর দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হতে পারে। এদের সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। কিছুদিন আগে চাকরিহারা একদল কর্মী ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বাস ও রেল স্টেশন ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা এ থেকেই আঁচ করা যায়।

আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম বলেছে, ধনী দেশগুলো যদি গরীব দেশগুলোর সহায়তায় এগিয়ে না আসে, তাহলে এই মহামারীতে বিশ্বের ছয় থেকে আট শতাংশ অর্থাৎ ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে যাবে।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের সহায়তাপুষ্ট আফ্রিকান দেশগুলো ইতিমধ্যেই আবেদন জানিয়েছে, যেন তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত রাখা হয়। আফ্রিকা মহাদেশের সবচাইতে বেশি ঋণগ্রস্তদেশের একটি হচ্ছে ঘানা। প্রতি বছর দেশটিকে ঋণের সুদই দিতে হয় চার হাজার চার শ' কোটি মার্কিন ডলার।

এ-ই হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা। এসব দেশের স্বাস্থ্য খাত তো এমনিতেই ভংগুর, ভেন্টিলেটর নেই, করোনাক্রান্ত মানুষকে উপযুক্ত সহায়তা দেয়ার সামর্থ্যও নেই সরকারের। এমন অবস্থায় এসব দেশের অর্থনৈতিক মন্দা হবে বহুমুখী। এ কারণেই এসব দেশের কাছ থেকে চলতি বছর ঋণের কিস্তি না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে অক্সফাম। তারা ঘানা-র উদাহরণ টেনে বলেছে, যদি এ বছর ঘানা-র কাছ থেকে ঋণের কিস্তি না নেয়া হয়, তাহলে সরকার আগামী ছয় মাস ওই দেশের এক কোটি ৬০ লাখ শিশু, প্রতিবন্ধী  ও প্রবীনের প্রত্যেককে মাসে ২০ মার্কিন ডলার করে নগদ দিতে পারবে। ঘানা স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর যা ব্যয় করে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয় তার ১১ গুণ বেশি।

করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় মার্চ মাসের শেষ দিকে মার্কিন সরকার ঘোষণা করেছে দুই দশমিক দুই ট্রিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ। মজার ব্যাপার হলো, ওই প্যাকেজে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর জন্য রাখা হয়েছে ১১০ কোটি ডলার অর্থাৎ শতকরা মাত্র ০ দশমিক ০৫ ভাগ।

মার্কিন সরকারের এমন কান্ড দেখে অক্সফামের মন্তব্য : এটা বেদনাদায়ক ও একচোখা নীতি। ধনী দেশগুলো যদি নিজেদের চিরকালের জন্য কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ রাখতে না চায়, তাহলে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক সংহতি। ওটা ছাড়া সমস্যার সমাধান নেই।