ভারতের সাবমেরিন শক্তি আসলে কতটুকু?


  • হায়দার সাইফ
  • ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৮

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা বা সিবিআই সম্প্রতি কিছু নৌ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান নৌ কর্মকর্তা ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তি আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ভারতের সাবমেরিন আধুনিকায়ন প্রকল্পের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে এক দশক পিছিয়ে পড়েছে ভারত। অন্যদিকে বহু এগিয়ে গেছে চীন।

ভারতের বহরে কতগুলো সাবমেরিন আছে? এই মুহূর্তে তাদের কনভেনশনাল ডিজেল-চালিত সাবমেরিন রয়েছে ১৫টি। এগুলো এসএসকে নামে পরিচিত। আর পারমাণবিক ব্যালিস্টিক সাবমেরিন রয়েছে একটি। এটা পরিচিত এসএসবিএন হিসেবে।

এসএসকে সাবমেরিনগুলোর মধ্যে চারটি হলো শিশুমার শ্রেণির। এগুলো কেনা হয়েছে জার্মানির কাছ থেকে। জার্মান সহায়তা নিয়ে ভারতেই এগুলো নির্মিত হয়েছে। নির্মাণ শুরু হয়েছিল আশির দশকে। শিশুমারের বাইরে আটটি সাবমেরিন হলো কিলো শ্রেণির বা সিন্ধুঘোষ শ্রেণির। এগুলো কেনা হয়েছে রাশিয়া আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে এগুলো কেনা হয়। এগুলোর বাইরে তিনটি হলো কালভেরি শ্রেণির স্করপিয়ন সাবমেরিন। এগুলো ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপের সহায়তা নিয়ে ভারতের মাজাগন ডকে নির্মিত হয়েছে।

এসএসবিএন সাবমেরিনটির নাম আইএনএস অরিহন্ত। পারমাণবিক চালিত ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন এটা। ভারতেই তৈরি করা হয়েছে। অরিহন্ত মডেলকে আপগ্রেড করে আরেকটি এসএসবিএন তৈরি করা হয়েছে। সেটার নাম দেয়া হয়েছে আইএনএস অরিঘাত। কয়েক মাসের মধ্যে এটা বহরে যোগ করা হতে পারে।

ভারতের অধিকাংশ সাবমেরিন ২৫ বছরের বেশি পুরনো। অনেকগুলোকেই ঘসামাজা করে চালানো হচ্ছে।

১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রথম সাবমেরিন কেনে ভারত। সেটা ছিল ফক্সট্রট শ্রেণির সাবমেরিন- আইএনএস কালভেরি। ১৯৬৯ সালের মধ্যে আরও তিনটি একই শ্রেণির সাবমেরিন কেনে ভারত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাবমেরিনগুলো ব্যবহার করেছিল তারা। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ এর মধ্যে আরও চারটি ফক্সট্রট শ্রেণির সাবমেরিন কেনে ভারত।

অবসরপ্রাপ্ত কমোডর অনিল জয় সিং চারটি সাবমেরিনকে কমান্ড করেছেন। নৌ সদরদপ্তরে ডিরেক্টরেটস অব নেভাল প্ল্যানস অ্যান্ড সাবমেরিন অ্যাকুইজিশান বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ভারতীয় নৌবাহিনীর ৩০ বছরের সাবমেরিন ক্রয় পরিকল্পনার সাথেও যুক্ত ছিলেন অনিল জয় সিং। তিনি মনে করেন, সেই সময়টাতে আটটি সাবমেরিন ছিল ভারতের জন্য যথেষ্ট। তখনকার হিসেবে সাবমেরিনগুলোও ছিল সমসাময়িক।

১৯৭৪ সালের পর এক দশকে আর কোন সাবমেরিন কেনেনি ভারত। ১৯৮১ সালে দুটো টু জিরো নাইন শ্রেণির সাবমেরিন কেনার জন্য পশ্চিম জার্মানির সাথে চুক্তি করে তারা। আরও দুটি সাবমেরিন ভারতের মাজগাঁও ডকে তৈরির চুক্তি হয়। এগুলো নিয়ে শিশুমার শ্রেণির বহর গঠিত হয়। চারটির মধ্যে প্রথমটি বহরে যুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে।

একই সাথে, ভারতকে কিলো শ্রেণির সাবমেরিন বিক্রির প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। প্রথম কিলো শ্রেণির সাবমেরিনটি ভারত হাতে পায় ১৯৮৬ সালে। সেটার নাম ছিল আইএনএস সিন্ধুঘোষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরে ভারতই প্রথম সেই সাবমেরিন ব্যবহার করে।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আটটি সাবমেরিন হাতে পায়। আর জার্মানির কাছ থেকে পায় দুটি। ১৯৯২ আর ১৯৯৪ সালে ভারতে নির্মিত বাকি দুটো জার্মান সাবমেরিনও বহরে যুক্ত হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে আট বছরের মধ্যে ১২টি নতুন সাবমেরিন হাতে পায় ভারত। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত, ভারতের সাবমেরিন বহর বিশ্বের আধুনিকতম বহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।

১৯৯৯ আর ২০০০ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আরও দুটো কিলো শ্রেণির সাবমেরিন কেনে ভারত। সব মিলিয়ে তাদের বহরে সাবমেরিনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০-এ।

এর পরপরই পুরনো ফক্সট্রট সাবমেরিনগুলোকে বহর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। ১০টি কিলো শ্রেণির সাবমেরিনের মধ্যে আইএনএস সিন্ধুরক্ষক মুম্বাই উপকূলের কাছে ডুবে যায়। আগুন থেকে সাবমেরিনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। অন্যদিকে, গত বছর আইএনএস সিন্ধুবীর সাবমেরিটি মিয়ানমারকে উপহার দিয়েছে ভারত।

সাবমেরিন আধুনিকায়নে পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে ভারতের। নিজস্ব সাবমেরিন তৈরির জন্য ৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। ১৯৯৯ সালে এই পরিকল্পনার অনুমোদন দেয় ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী আলাদা দুটি প্রকল্পে সাবমেরিন নির্মাণ করা হবে। প্রত্যেক প্রকল্পের অধীনে সাবমেরিন নির্মিত হবে ছয়টি। বিদেশি অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার বা ওইএমের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। প্রকল্প দুটোর নাম দেয়া হয় পি-৭৫ আর পি-৭৫আই।

৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় অনুমান করা হয়েছিল, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১২টি নতুন সাবমেরিন বহরে যুক্ত হবে। পরে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত নিজেই আরও ১২টি সাবমেরিন বানাবে। সব মিলিয়ে বহরে থাকবে ২৪টি সাবমেরিন। আর পুরনো সাবমেরিনগুলোকে বহর থেকে একে একে সরিয়ে ফেলা হবে। যে কোন সময় যাতে বহরে ১৮ থেকে ২০টি সাবমেরিন থাকে, সেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু পি-৭৫ প্রকল্পটি স্বাক্ষর হতেই ২০০৫ সাল লেগে যায়। ফ্রান্সের ডিসিএনএসের সাথে এটা স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি এখন ন্যাভাল গ্রুপ নামে পরিচিত। যে সময়ে দ্বিতীয় প্রকল্পটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা, সেই সময়ে এসে স্বাক্ষরিত হয় প্রথম প্রকল্প।

পি-৭৫ প্রকল্পের অধীনে ছয়টি সাব নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এখন পর্যন্ত তিনটি কালভেরি শ্রেণির স্করপিয়ন সাবমেরিন সরবরাহ করেছে তারা। আর পি-৭৫আই প্রকল্পের কাজই এখনও শুরু হয়নি। তিন ধাপে সাবমেরিন তৈরির প্রস্তাব চুড়ান্ত হয়। ২০০৮ সালে প্রথম রিকোয়েস্ট ফর ইনফরমেশান বা আরএফআই ইস্যু করা হয়। ২০১০ সালে আবার ইস্যু করা হয় আরএফআই। সবশেষে চলতি বছরে এসে রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল ইস্যু করা হয়েছে।

স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ মডেলের অধীনে এটা হবে ভারতের প্রথম প্রকল্প। এই ধারণা প্রথম নেয়া হয় ২০১৫ সালে। সরকার ভারতের নিজস্ব কোন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা এসপিকে কাজ দেবে। ওই কোম্পানি পরে বিদেশি ওইএম বাছাই করে একসাথে কাজ করবে।

এই কাজের জন্য দুটো এসপিকে বাছাই করা হয়েছে। একটি হলো এমডিএল। অন্যটি লার্সেন অ্যান্ড টুবরো। বিদেশি ওইএম বাছাই করা হয়েছে পাঁচটি। তবে, দরপত্রের প্রক্রিয়া এখনও চুড়ান্ত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম সাবমেরিনটি হাতে পেতে ২০৩২ সাল লেগে যাবে। পি-৩৫ প্রকল্পের কাজেও দেরি হচ্ছে। প্রথম সাবমেরিনটি বহরে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালে। সেটি হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে।

অনিল জয় সিং মনে করেন, দুটো কারণে ভারতের আরও সাবমেরিন দরকার। প্রথম কারন দেশের নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় কারণটি হলো চীন। আগামী বছরগুলোতে চীন ভারত মহাসাগরে বহু জাহাজ আর সাবমেরিন মোতায়েন করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চীন পাকিস্তানকে আটটি সাবমেরিন আর চারটি ডেস্ট্রয়ার জাহাজ দিচ্ছে। এগুলোকে প্রয়োজনে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করবে তারা। সিং মনে করেন, ভারতকে এই শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। অতি দ্রুত পি-৭৫আই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে।

পেন্টাগন ২০২০ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে । এতে বলা হয়েছে , চীন বর্তমানে চারটি এসএসবিএন পরিচালনা করছে। আরও দুটি তৈরির কাজ চলছে। তাদের এসএসএন রয়েছে ছয়টি। আর ডিজেল-চালিত অ্যাটাক সাবমেরিন বা এসএস রয়েছে ৫০টি। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, চীনা নৌবাহিনী ২০২০ দশকের মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০টি সাবমেরিন পরিচালনা করবে। একটি একটি করে তারা পুরনো সাবমেরিনগুলোও বদলে ফেলবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর ১২টি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করেছে চীন। ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের কাছে এসএসবিএন থাকবে আটটি।

পারমাণবিক শক্তি চালিত বা এসএসএন সাবমেরিন ইচ্ছে মতো দীর্ঘ সময় ডুবে থাকতে পারে। কারণ, এগুলোর ব্যাটারি লাগেনা। ডিজেল ইঞ্জিনের মতো উপরে এসে এগুলোকে জ্বালানিও নিতে হয় না। এগুলো চলে পারমাণবিক শক্তি দ্বারা। শুধুমাত্র ক্রুদের খাবার-পানি নেয়ার জন্য এগুলোকে উপরে আসতে হয়।

তাছাড়া, পানির নিচে এসএসএনের গতিও কনভেনশনাল সাবমেরিনের চেয়ে বেশি। এই সব সুবিধার কারণে, নৌবাহিনী দূর দূরান্তে এই সাবমেরিন মোতায়েন করতে পারে। দ্রুত পরিচালনা করতে পারে। এগুলো মহাসাগরের তলদেশের জঙ্গি বিমানের মতো।

বিশ্বের যে ছয়টি দেশের এসএসএন রয়েছে, এর মধ্যে ভারতও রয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স আর চীন। ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত নৌবাহিনীর কাছ থেকে প্রথম এসএসএন পায় ভারত। এটার নাম দেয়া হয় আইএনএস চক্র। ১৯৯১ সালে এটাকে বহর থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। ২০১২ সালে ১০ বছরের জন্য আরেকটি রাশিয়ান এসএসএন ধার নেয় ভারত। এটার নাম দেয়া হয় আইএনএস চক্র ২। সেটিরও মেয়াদ শেষের দিকে।

ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পি-৭৫ আর পি-৭৫আই প্রকল্পে যে ১২টি সাবমেরিন তৈরি করা হবে, এর মধ্যে ছয়টি থাকবে এসএসএন। তবে, কাজ কত দ্রুত হবে, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সবকিছু ঠিক মতো এগুলেও ২০৩৫ বা ২০৪০ সালের আগে প্রথম এসএসএন হাতে পাবে না ভারত।

এই অবস্থায় রাশিয়ার কাছ থেকে আরও দুটো এসএসএন ধার নিতে যাচ্ছে ভারত। তবে এই দুটোরও প্রথমটা হাতে পাবে তারা ২০২৫ সালে।