চীনের হাইপারসনিক অস্ত্রের মোকাবিলায় অসহায় যুক্তরাষ্ট্র?


  • মোতালেব জামালী
  • ২৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫১

যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালের বিমান, মহাকাশ ও সাইবার কনফারেন্সে বক্তারা তাগাদা দিয়েছেন, চীনকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির দ্রুত আধুনিকায়ন প্রয়োজন। মার্কিন বিমান বাহিনীর সেক্রেটারি ফ্রাঙ্ক কেন্ডাল কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে বলেন, তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে চীন, চীন এবং একমাত্র চীন। চীনকে নিয়ে তার এই উদ্বেগের যথার্থ কারণও রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, চীনা বিমান বাহিনী এরইমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।

সামরিক ক্ষেত্রে চীনের দ্রুত অগ্রগতি অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বেড়ে যায়, যখন চীন তার রফতানিমুখী নতুন অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। সম্প্রতি দেশটি তার লেইহুয়া ইলেকট্রনিক রিসার্চ ইন্সটিটউটের তৈরি করা পিলি নামের ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। জুহাই নামক স্থানে চীনা বিমান বাহিনীর সামরিক সরঞ্জামের এই প্রদর্শনী হয়েছে। পিএল-১৫ই নামে পরিচিত আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার অত্যাধুনিক এই ক্ষেপণাস্ত্রটি দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে চলতে সক্ষম।

এই ক্ষেপণাস্ত্রটি পিএল-১২-এর উন্নত সংস্করণ। চীনা লিবারেশন আর্মির বিমান বাহিনী বর্তমানে এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ব্যবহার করছে। এর ফলে চীনা বিমান বাহিনী আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। রাশিয়ার আর-৭৭ ক্ষেপণাস্ত্রের আদলে তৈরি করা চীনের পি-১২ ক্ষেপণাস্ত্রটির উন্নত সংস্করণ বানানো হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের এআইএম-১২০ ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করার জন্য। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর এজিএটি রিসার্চ ইন্সটিটিউট এতে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, গত আগস্টে চীন তাদের পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণকারী একটি মহাকাশযান থেকে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল ব্যবহার করে। এটি দিয়ে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। ফ্র্যাকশনাল অরবিট বম্বার্ডমেন্ট সিস্টেমের অংশ হিসেবে এই পরীক্ষা চালানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি মহাকাশে চীনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি চীনের এই কাজকে খুবই উদ্বেগজনক পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন।

ফ্র্যাকশনাল অরবিট বম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম নতুন কিছ নয়। কিন্তু চীনের এই সিস্টেমের কিছু পার্থক্য রয়েছে। চীন দেখিয়েছে, মহাকাশে ছোট একটি রকেট থেকে মাটিতে থাকা কোনো টার্গেট লক্ষ্য করে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পরিবর্তে এই প্ল্যটফর্মের সহায়তায় মহাকাশেই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম।

রাশিয়ারও একটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল রয়েছে। তারা এটির নাম দিয়েছে অ্যাভাঙ্গার্ড। বর্তমানে এটি মোতায়েন করা হয়েছে। চীনের এফওবি থেকে এটি ভিন্ন ধরনের। ভূগর্ভস্থ একটি সাইলো থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর বসানো থাকে অ্যাভাঙ্গার্ড। ক্ষেপণাস্ত্রটি যখন তার টার্গেটের আওতার মধ্যে চলে আসে, তখন এটি অ্যাভাঙ্গার্ড হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলটিকে মুক্ত করে দেয়। বর্তমানে এটি কারিগরিভাবে কক্ষপথের কোনো যান নয়। এটি দুই মেগাটন ওজনের ছোট পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম।

অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাশিয়া ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে তিনটি ভিন্ন ধরনের এফওবি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এগুলোরই একটির নাম আর-৩৬০। ১৯৬৫ সালে এটির প্রথম পরীক্ষা চালানো হয়। পরে অন্তত ২০ টি পরীক্ষা চালানো হয়। এ সময় এতে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে অবশেষে ১৯৭১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার অংশ হিসেবে কাজাখস্তানে এটি মোতায়েন করা হয়। পরের বছর এতে পরমাণু অস্ত্র সংযোজন করা হয়।

আর-৩৬০ ছিল ফ্র্যাকশনাল অরবিট সিস্টেম বা ভগ্নাংশ কক্ষপথ পরিভ্রমণ ব্যবস্থা। পুরো পৃথিবীকে নিজের আক্রমণের আওতার আনার কোনো ব্যবস্থা এতে ছিল না। এটি উৎক্ষেপণের পর কক্ষপথে পৌঁছে উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরুর যে কোনো একটি অংশে পরমাণু অস্ত্রবাহী ছোট আকারের রকেট ছুড়তে পারে।

প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার এফওবি সিস্টেম তৈরির লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম মোকাবিলা করা। এবিএমএস সিস্টেম তৈরির সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ ধরনের মাত্র একটি সিস্টেমই ছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল সেন্টিনেল। পরে নাম পরিবর্তন করে সেফগার্ড রাখা হয়।

১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ মেরু অভিমুখে মোতায়েন করা কোনো রাডার ছিল না। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল চুক্তি করে। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে দুই পক্ষেরই দুটি স্থান নিরাপদ রাখা। একটি হলো উভয়পক্ষের রাজধানী ও অপরটি হলো পরস্পরের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার স্থান। ১৯৭৪ সালে এই চুক্তি কিছুটা সংশোধন করা হয়। ওই সময় কেবলমাত্র পরস্পরের এবিএম সিস্টেম রক্ষার বিষয়টি চুক্তিতে রাখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৬ সালে তার সেন্টিনেল সিস্টেম বন্ধ করে দেয়। এরপর দেশটি তার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি রক্ষার জন্য আর কখনও অ্যান্টি ব্যালিস্টিক সিস্টেম নির্মাণ করেনি। তবে রাশিয়া ঠিকই তার রাজধানী মস্কো রক্ষার জন্য এবিএম সিস্টেম মোতায়েন করে। এজন্য ১৯৭১ সালে প্রাথমিকভাবে এ-৩৫ ও পরে তা পরিবর্তন করে এ-১৩৫ মোতায়েন করা হয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবিএম চুক্তি থেকে সরে আসে। বর্তমানে আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় এ ধরনের ৪৪টি ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে।

১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সবগুলো এফওবি সিস্টেম প্রত্যাহার করে। ওই সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ ভিত্তিক রাডার মোতায়েন শুরু করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলভিত্তিক রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার যে বড় সুযোগ এতদিন রাশিয়ার এফওবি সিস্টেমের ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটভিত্তিক সেন্সরগুলোও যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্র স্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলে তা শনাক্ত করতে সক্ষম।

চীন কখনও অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল বা এবিএম চুক্তির কোনো পক্ষ ছিল না। এমনকি দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় কোনো অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির অংশও ছিল না। তবে দেশটি ১৯৬৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’তে স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তিতে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়, ‘এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথে পরমাণু অস্ত্র বা ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র বহনকারী কোনো বস্তু স্থাপন করতে পারবে না।’

কিন্তু চীনের সর্বশেষ পদক্ষেপ এই চুক্তির শর্তের সরাসরি লঙ্ঘন। কেননা চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে ঘুরেছে। কিন্তু ওই চুক্তির নজরদারি কর্তৃপক্ষ হিসেবে জাতিসংঘ মহাকাশে চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। চুপ করে রয়েছে। চীন দাবি করছে, তারা হাইপারসনিক ভেহিকলযুক্ত কোনো এফওবি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেনি। বরং তারা পুনঃব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ করেছে। এটাই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠেছে চীন এই উৎক্ষেপণ নিয়ে কেন এতো লুকোচুরি করেছে? কেন গোপন রেখেছে?

চীনের এই উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করায় এটি স্পষ্ট যে, তারা চীনের ওপর সব সময়ই নজর রাখছিল। এ কারণেই তারা চীনের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল এফওবি উৎক্ষেপণ পরীক্ষা শনাক্ত করতে পেরেছে। তবে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে সেটি হচ্ছে, ওয়াশিংটন কেন সময়মতো চীনের এই পরীক্ষার কথা প্রকাশ করেনি? ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার আগে তিন মাস সময় চলে গেছে। কিন্তু এতদিনেও যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে, চীনের সাথে দ্বন্দ্ব এড়াতেই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি চেপে গেছে?

চীনের এই ভেহিকল পরীক্ষা থেকে দেশটির সব প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পরীক্ষায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। এজন্য আরও অনেকবার পরীক্ষা চালাতে হবে। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, চীনের এই হাইপারসনিক গ্লাইডার তার নির্ধারিত টার্গেট থেকে ২০ মাইল দূরে গিয়ে আঘাত হেনেছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, নিপুণভাবে লক্ষ্য ভেদ করা ও ভেহিকেল নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেহেতু এই ভেহিকল ছোট ধরনের পরমাণু অস্ত্র বহন করে, সে কারণে একটি নির্ভরযোগ্য অস্ত্র হিসেবে এর কার্যকারিতা সঠিকভাবে প্রমাণ করতে হবে।

চীনের এই পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্রের সামনে যে প্রশ্নটি চলে এসেছে তা হলো- প্রতিপক্ষের হাইপারসনিক হুমকির মোকাবিলায় কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেবে কিনা। চীন জল, স্থল বা আকাশ যেখান থেকেই এই অস্ত্রের পরীক্ষা করুক না কেন, তা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের আছে কিনা? এ নিয়ে পেন্টাগণের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। কীভাবে চীনের চ্যলেঞ্জের মোকাবিলা করা যায়, সেটাই এখন তাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।