সাবমেরিন কীভাবে কাজ করে?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৭ আগস্ট ২০২১, ১৪:৪৯

আধুনিক যুদ্ধের ভয়ঙ্কর এক উপকরণের নাম সাবমেরিন। অনেকে বলেন ডুবোজাহাজ। পানির নিচে নিঃশব্দে, গোপনে যে শত্রুর ওপর নজরদারি করে। পারমাণবিক মিসাইল, টর্পেডো আর শতাধিক ক্রু নিয়ে এই আন্ডারওয়াটার ভেসেলটি ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রের তলদেশে। পানির নিচ থেকেই হামলা করতে পারে জল, স্থল এমনকি আকাশেও। আবার বেসামরিক কাজেও রয়েছে সাবমেরিনের প্রচলন।

পানির নিচ দিয়ে চলা স্বয়ংক্রিয় নৌযান সাবমেরিন। বাইরের দুনিয়ার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ না রেখেও এটি অনেক দিন থাকতে পারে সাগরের তলদেশে। আজকের দিনে যে কোনো দেশের নৌ বাহিনীর শক্তিমত্তার প্রতীক এই সাবমেরিন। এর প্রযুক্তি, যুদ্ধ করার ক্ষমতা, আকার ও পানির নিচে সারভাইভ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এক সময়ের ডিজেল চালিত সাবমেরিনের জায়গা নিয়েছে এখন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। অস্ত্রভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমুদ্রসীমা পাহাড়া দেয়া, বিমানবাহী রণতরী বা নৌ বহরেরর প্রতিরক্ষার মতো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে সাবমেরিন। শত্রুর জাহাজ কিংবা প্রতিপক্ষের সাবমেরিনের ওপর হামলার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে এগুলো। এমনকি সাবমেরিন থেকে ব্যালেস্টিক মিসাইলও ছোড়া যায়। উড়ন্ত বিমান লক্ষ্য করে ক্রুজ মিসাইল ছুড়তে পারে সাবমেরিন।

সামরিক কাজ ছাড়াও সাবমেরিনের ব্যবহার হচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা, অনুসন্ধান, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র নিয়ে গবেষণা ও ভিডিও ধারণ, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনের কাজেও সাবমেরিনের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

আধুনিক সাবমেরিনের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো না হলেও ষোড়শ শতাব্দীতে এ ধরনের সমুদ্রযানের কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন ইংরেজ গনিতবিদ উইলিয়াম বর্নি। তিনি এক বইতে সমুদ্রের নিচ দিয়ে চলতে সক্ষম এমন যান তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তবে ১৬২০ সালে প্রথম পানির তলদেশ দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম যান আবিষ্কার করেন ডাচ ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্ভাবক কর্নেলিস ড্রেবল।

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের নৌ বাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বৈঠাচালিত ডুবোযানটি তৈরি করেন। কাঠের কাঠামোর ওপর চামড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছি। কয়েক মিটার গভীরে চলতে পারতো এই যানটি। এরপর এই ধারণাটি নিয়ে ব্যাপক কাজ শুরু হয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝে।

শোয়াশো বছর পর ইংল্যান্ডেই প্রথম ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক যুক্ত সাবমেরিন তৈরির ধারনা দেন এক ইঞ্জিনিয়ার। এই ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে পানি ভরে সাবমেরিনকে পানির নিচে ডুবানো হয়। আবার ট্যাঙ্ক খালি করলে সাবমেরিন ভেসে ওঠে সারফেসে। সাবমেরিনের ওজনের চেয়ে বেশি পানি ভর্তি করা হলেই সেটি ডুবে যায়। ১৮৬৪ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে কনফেডারেট নেভির সাবমেরিন এইচএল হানলি প্রথম কোনো শত্রু যান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অবশ্য সাবমেরিনটিও ডুবে গিয়েছিলে সেই কাজ করতে গিয়ে। গান পাউডার বোঝাই করে বাননো টর্পোডোর বিস্ফোরণের শকওয়েভ সামলাতে পারেনি সেটি।

সামরিক কাজে সাবমেরিনের ব্যবহার সফলভাবে করা হয় প্রথম বিশ^যুদ্ধে। জার্মানি ও মিত্র শক্তি উভয় সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারে পরস্পরকে টেক্কা দিতে চেষ্টা করে। এরপর সাবমেরিন ক্রমশ এগিয়েছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে। ১৯৫৩ সালে ডুবোজাহাজ থেকে প্রথমবারের মতো সফলভাবে ক্রুজ মিসাইল উৎক্ষেপণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস টুনি। এই সাবমেরিনটিকেই প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সাবমেরিনে রূপান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র।

৫০-এর দশকের শেষ দিকে ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের বদলে পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন সাগরে নামতে শুরু করে। একই সময়ে সমুদ্রের পানি থেকে অক্সিজেন নিঃসরণের প্রযুক্তি আবিস্কার হয়, যে কারণে সাগরের তলদেশে মাসের পর মাস থাকা সম্ভব হয় সাবমেরিনের পক্ষে।

সাবমেরিনের ক্রুদের জন্য অক্সিজেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ পানির নিচে বদ্ধ যানবাহনে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহের কোনো উপায় নেই। প্রথম দিকে সিলিন্ডার ব্যবহার করে অক্সিজেন সরবরাহ করা হতো, যে কারণে অল্প কয়েকদিন পরই সাবমেরিনকে সারফেসে উঠে আসতে হতো।

এখন সাগরের পানি থেকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন সংগ্রহ করে সাবমেরিন। তবে সেখানে কার্বন ডাই অক্সাইডকে রিসাইকেল করার কোনো প্রক্রিয়া নেই। সাবমেরিনে ইলেকট্রোলাইসিস বা তরিৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সাগরের পানি থেকে অক্সিজেনকে আলাদা করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। তবে এই প্রক্রিয়ায় যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে যাতে ক্রুরা বেঁচে ফিরতে পারে সে জন্য বড় আকারের বেশ কিচু অক্সিজেন সিলিন্ডারও রাখা হয়। সাবমেরিনের ভেতরে সাধারণত ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অক্সিজেনের পরিমান কম থাকে, যে কারণে অগ্নিকাণ্ড হলে আগুন দ্রুত ছড়াতে পারে না।

যেহেতু বেঁচে থাকার প্রশ্ন, তাই সাবমেরিনে অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টি অত্যন্ত কঠোরভাবে মনিটরিং করা হয়। প্রতি মূহুর্তে দক্ষ টেকনিশিয়ানরা বিষয়টি তদারকি করেন। ক্রুদের নিঃশ^াসে যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় সেটিও সাবমেরিন থেকে বের করে দেয়া হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিেেত। এজন্য ব্যবহার করা হয় অ্যামাইন নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিকটি কার্বনডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে বাইরে বের করে দেয়। এই রাসায়নিক থেকে হালকা একটি গন্ধ বের হয়, সেটিকে অবশ্য সহ্য করেই থাকতে হয় সাগর তলের নাবিকদের। এছাড়া সাবমেরিনে রান্না ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য সাগরের পানিকে লবনমুক্ত করে ব্যবহার করা হয়।

সিলিন্ডার আকৃতির এই ডুবোযানের মাঝ বরাবর উপরের দিকে একটি কাঠামো থাকে যেটিকে সেইল অথবা ফিন নামে ডাকা হয়। এই সেইল বা ফিনের মধ্যেই থাকে কমিউনিকেশন ও সেন্সিং ডিভাইস। সাবমেরিন থেকে পানির উপরিভাগ দেখার জন্য এখানে পেরিস্কোপও থাকে।

সাবমেরিনের কন্ট্রোল রুম থেকে বাইরে দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় সাউন্ড নেভিগেশন এন্ড রেঞ্জিং সিস্টেম বা সোনার। সোনার সিস্টেম শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে বাইরের জগতের চিত্র তুলে ধরে অপারেটরের সামনে। একই পদ্ধতিতে সাবমেরিন থেকে টার্গেট চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া পানির উপরিভাগে ভাসমান জাহাজ ও আকাশে থাকা বিমান চিহ্নিত করার জন্য সাবমেরিনে ব্যবহৃত হয় কয়েক ধরনের সেন্সর। আর কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগের জন্য থাকে ভেরি লো ফ্রিকোয়েন্সি বা এক্সট্রিমলি লো ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও। তবে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এই রেডিও ব্যবহার করা হয় না।

সাবমেরিনের ধরন ও এর আয়তন অনুযায়ী ক্রু সংখ্যা নির্ভর করে। পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিনে ৮০ থেকে ১২০ জন পর্যন্ত ক্রু থাকে। আর ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনে এই সংখ্যা থাকে ৫০ এর আশপাশে। সাবমেরিনের ক্রুদের বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় দিনের পর দিন।

নিরাপত্তার কারণে এই যানটি রেডিওর সাহায্যে কন্ট্রোলরুমের সাথেও খুব একটা যোগাযোগ করে না। সাবমেরিন চালানো সব সময়ই একটি বিপজ্জনক কাজ হিসেবে পরিচিত। কারণ কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়াও যান্ত্রিক গোলযোগের কারনে পৃথিবীতে বহু সাবমেরিন দুর্ঘটনায় প্রাণহানী হয়েছে ক্রুদের।

সাবমেরিন অত্যন্ত নিঃশব্দে চলতে সক্ষম একটি যান। এর ইঞ্জিন ও অন্যান্য সিস্টেম খুবই কম শব্দ উৎপন্ন করে। সমুদ্রের তলদেশে উৎপন্ন শব্দ ব্যবহার করে করে যাতের শত্রুযানের সোনার সাবমেরিন খুঁজে না পায় সে বিষয়টি মাথায় রেখেই সাবমেরিন তৈরি করা হয়। শুরুর দিকে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি শব্দ উৎপাদন করতো রিয়্যাকটর চালানোর জন্য। তবে সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছে দিনে দিনে।

বর্তমানে বিশে^ ৬টি দেশ পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ব্যবহার করে। আগের দিনের ডিজেল ইলেক্ট্রিক সাবমেরিনের বদলে এই সাবমেরিন একটানা ২৫ বছর চলতে পারে কোনো রিফুয়েলিং ছাড়াই। যে কারণে জ¦ালানি নেয়ার জন্য উপরে উঠে আসতে হয় না। নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটরের মাধ্যমে এই সাবমেরিনগুলোতে শক্তি জোগান দেয়া হয়। ইঞ্জিনের শক্তি ছাড়াও সাবমেরিনের ভেতরের অন্যসব কাজ যেমন অক্সিজেন জোগাড় করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও মিসাইল ছোড়ার জন্য শক্তির জোগান দেয় এই রিঅ্যাকটর। একজন ক্রুকে এই বিষয়টি তদারকি করতে হয়।

সাবধানতা হিসেবে অন্তত দশ জনের একটি দক্ষ টিম থাকে প্রতিটি সাবমেরিনে। এছাড়া ডিজেল ইলেকট্রিক সিস্টেমও রাখা হয়, যাতে কখনো নিউক্লিয়ার রিয়্যাকটর অচল হয়ে গেলে সাবমেরিনটি টিকে থাকতে পারে। ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন বলতে অবশ্য সাধারণ ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের ব্যবহার করা হয় বিষয়টি তেমন নয়। কারণ সাধারণ ডিজেল ইঞ্জিন প্রচুর ধোয়া ও শব্দ উৎপন্ন করে। এ ধরনের সাবমেরিনে মূলত ডিজেল ইঞ্জিনের সাহায্যে একটি জেনারেটরকে চালানো হয়, সেই জেনারেটরে শক্তিতে চার্জ হয় কিছু ব্যাটারি এবং সেই ব্যাটারির শক্তিতে চলে প্রপেলর, যা এগিয়ে নিয়ে যায় সাবমেরিনটিকে।

পারমাণবিক সাবমেরিনে বেশ কয়েক দফা দুর্ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬১, ১৯৬৮ ও ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পৃথক তিনটি সাবমেরিনে পারমাণবিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ২৭ জন। তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছে আরও শতাধিক ক্রু। বর্তমানে ছয়টি দেশের কাছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন রয়েছে। এদেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর রয়েছে ৭১টি সাবমেরিন, যার সবগুলোই পারমাণবিক শক্তি চালিত। রাশিয়ার এ ধরনের সাবমেরিন আছে ৩৩টি। ব্রিটেনের ১১টি, ফ্রান্সের ১০টি, চীনের ৩টি ও ভারতের দুটি।

এগুলোর মধ্যে য্ক্তুরাষ্ট্রের ওহিও ক্লাস, রাশিয়ার টাইফুন, ডেলটা ও বোরেই ক্লাস, চীনের টাইপ ০৯৪ সাবমেরিন ব্যালেস্টিক মিসাইল ছুড়তে পারে। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ভারতের সাবমেরিনও ছুড়তে পারে ব্যালেস্টিক মিসাইল। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে বর্তমানে বিশে^ ৪১টি দেশের নৌ বাহিনীর কাছে সামরিক সাবমেরিন রয়েছে। এসব সাবমেরিনের মাঝে, কোনোটি অ্যাটাক সাবমেরিন, কোনোটি বা গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী। অ্যাটাক সাবমেরিনে সাধারণ টর্পেডো ও মিসাইল ছোড়ার ব্যবস্থা থাকে।

রাশিয়ার গোয়েন্দা সাবমেরিন লোশারিক ৮ হাজার ২০০ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে পৌঁছতে পেরেছে এখন পর্যন্ত। তবে সাধারণত সাবমেরিনের পানির গভীরে পৌঁছানোর ক্ষমতা আরও কম হয়। রাশিয়ার টাইফুন ক্লাস ও যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস ক্লাস সাবমেরিন যেতে পারে ৩ হাজার ফুট গভীরে। তবে বিশে^র বেশির ভাগ সাবমেরিনের গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা এক হাজার ফুটের কাছাকাছি।