কোনটা শক্তিশালী- তেজাস না জেএফ-১৭


  • মেহেদী হাসান
  • ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৩৭

ভারতের গণমাধ্যমের দাবি, তাদের নিজস্ব তৈরি ফোর্থ জেনারেশন তেজাস যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের জেএফ-১৭ থান্ডারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। অপরদিকে, পাকিস্তানের দাবি, শুধু তেজাস নয়, ভারতের রেফালেও হার মানবে জেএফ-১৭ থান্ডারের নতুন ভার্সনের কাছে।

পাকিস্তান তৈরি করতে যাচ্ছে জেএফ-১৭ এর নতুন ভার্সন জেএফ-১৭ বি থান্ডার ব্লক-৩। এটি হবে ফোর প্লাস তথা চার দশমিক ৫ জেনারেশন যুদ্ধবিমান। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান এয়ারফোর্স জেএফ-১৭-এর নতুন অ্যাডভান্সড ভার্সন নির্মাণের ঘোষণা দেয়। তাদের দাবি, জেএফ-১৭-এর নতুন ভার্সনের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কাছে হার মানবে ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা ভারতের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান রেফালে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রধান আনোয়ার খান জেএফ-১৭ সংস্কার করে চার দশমিক ৫ জেনারেশনের উন্নীত করাকে মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এ দাবির পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুরু হয় তেজাস, রেফালে এবং জেএফ ১৭ থান্ডারের শক্তি নিয়ে আলোচনা আর বিতর্ক। তেজাস ভারতের নিজস্ব তৈরি প্রথম সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান। অপর দিকে জেএফ ১৭ থান্ডার পাকিস্তান যৌথভাবে নির্মান করছে চীনের সাথে। পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স এবং চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন এ বিমান নির্মান করছে। জে এফ মানে জয়েন্ট ফাইটার। তবে যৌথভাবে নির্মান শুরুর পর এর বিভিন্ন আপডেট ভার্সন পাকিস্তান নিজে উদ্ভাবন করেছে।

ভারতের তেজাস একটি ফোর্থ জেনারেশন বহুমুখী হালকা যুদ্ধবিমান। ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং নেভির জন্য নির্মান করা হয়েছে এ বিমান। এর নির্মাতা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্যালস লিমিটেড। ভারত তাদের পুরনো মিগ-২১ এর স্থলে ব্যবহার করবে এ বিমান।

অপরদিকে পাকিস্তানের জেএফ ১৭ থান্ডারও একটি ফোর্থ জেনারেশন বহুমুখী যুদ্ধবিমান। পাকিস্তান তাদের বিমান বাহিনী এবং রপ্তানির জন্য হাতে নিয়েছে এ বিমান নির্মান প্রকল্প। তবে পাকিস্তান দাবি করেছে একে তারা সংস্কার করে ফোর প্লাস জেনারেশনে উন্নীত করেছে। অপর দিকে চীন দাবি করেছে তারা এতে যুক্ত করেছে ফিফথ জেনারেশন চেংদু জে ২০ এর অনেক আধুনিক প্রযুক্তি।

তেজাস প্রথম আকাশে ওড়ে ২০০১ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে। এখন পর্যন্ত ৩৪টি এ বিমান নির্মান করেছে ভারত। জেএফ ১৭ থান্ডার প্রথম আকাশে ওড়ে ২০০৩ সালে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ২০০৭ সালে। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ১৫৬টি এ বিমান তৈরি করেছে। আসুন জেনে নেই দুদেশের এই যুদ্ধবিমান সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে বর্তমানে মোট ১৩৮টি জেএফ ১৭ বিমান রয়েছে। আরো ৫০টি যোগ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অপরদিকে ভারত তাদের বিমান এবং নৌ বাহিনীর জন্য চার শতাধিক তেজাস ফাইটার জেট সংগ্রহ করতে চায়। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত ৮৩টি তেজাস বিমান কেনার জন্য সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। ভারতের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় দেশীয় অস্ত্র ক্রয় চুক্তি।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় ১৪টি জেএফ-১৭ বি ব্লক ২ ফাইটার জেট। জেএফ ১৭ থান্ডার বি এর পাইলট সংখ্যা দুই জন। নতুন এ ভার্সন উদ্ভাবন করেছে পাকিস্তান। সর্বশেষ উন্নত ভার্সন জেএফ ১৭ ব্লক -৩ নির্মানাধীন রয়েছে। তেজাসের ইঞ্জিন সংখ্যা ১টি এবং তা জেনারেল ইলেকট্রিক এর। জেএফ ১৭ এরও ইঞ্জিন সংখ্যা একটি। তাদের ইঞ্জিন রাশিয়ার তৈরি। তেজাস ও জেএফ ১৭ উভয়ের এক ও দুই আসনের বিমান রয়েছে।

ভারতের তেজাস একটি সুপারসনিক কমব্যাট এয়াক্রাফট । এর গতি শব্দের চেয়ে ১ দশমিক ৬ গুন বেশি বা ম্যাক ১ দশমিক ৬। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ৩৮০ মাইল। পাকিস্তানের জেএফ ১৭ থান্ডারও একটি সুপারসনিক কমব্যাট এয়ারক্রাফট। এর গতি শব্দের চেয়ে ১ দশমিক ৬ গুন বেশি বা ম্যাক ১ দশমিক ৬ । সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ১৯০ মাইল।

ভারতের তেজাসে রয়েছে আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সমুদ্রে মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। ১২ ধরনের মিসাইল ছোড়ার ব্যবস্থা রয়েছে তেজাস ফাইটার জেটে। প্রিসিশন গাইডেড বোমা, আন গাইডেড বোমা, ক্লাস্টার বোমা, লেজার গাইডেড বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত বোমা ছুড়তে সক্ষম তেজাস। তেজাসে রয়েছে মাল্টিমোড রাডার, ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল এভয়নিক্স সিস্টেম এবং ডুয়াল ক্যানন । ডুয়াল ক্যানন প্রতি সেকেন্ডে ৫০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে সক্ষম।

পাকিস্তানের জেএফ-১৭ আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সমুদ্রে মিসাইল ছুড়তে সক্ষম। পাকিস্তানের শক্তিশালী রাদ ক্রুজ মিসাইলসহ ১৪ ধরনের শক্তিশালী স্বল্প ও দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল বহন করতে পারে জেএফ ১৭। অপর দিকে গাইডেড ও আনগাইডেড মিলিয়ে ২০ ধরনের শক্তিশালী বোমা বহন করতে পারে জেএফ১৭। স্যাটেলাইট গাইডেড বোমা, গ্রাভিটি বোমা, রকেট লঞ্চার এবং লেজার ডেজিনগেশন পড় রয়েছে এতে। এ ছাড়া রয়েছে ২৩ এমএম ডয়াল ব্যারেল অটো ক্যানন।

তেজাসে অস্ত্র বহনের জন্য রয়েছে ৮টি হার্ড পয়েন্ট। জেএফ-১৭ এ অস্ত্র বহনের জন্য রয়েছে ৭টি হার্ড পয়েন্ট।

তেজাস যদিও এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট হালকা যুদ্ধবিমান কিন্তু এতে রয়েছে অনেক এডভান্সড বৈশিষ্ট্য। এয়ার টু এয়ার রিফুয়েলিং ক্ষমতা, বিয়ন্ড ভিজুয়াল রেঞ্জ মিসাইল ক্যাপাবিলিটি। এয়ার টু গ্রাউন্ড উইপন। এ ছাড়া রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, টার্গেটিং, সার্ভিল্যান্স, রিকনিস্যান্স ক্ষমতা।

পাকিস্তানের জেএফ ১৭ থান্ডার ইন্টারসেপ্টর এবং রিকনিস্যান্স হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। জেএফ ১৭ এর রয়েছে শক্তিশালী কাউন্টার মিজার বা আত্মরক্ষার সিস্টেম। এগুলো হলো রাডার ওয়ার্নিং সিস্টেম, মিসাইল এপ্রোচ এন্ড ওয়ার্নিং সিস্টেম, কাউন্টার মিজার ডিসপেনসিং সিস্টেম, সেলফ প্রটেকশন রাডার জ্যামিং পড।

তেজাস ফাইটার জেটের দৈর্ঘ্য ৪৩ ফিট ৪ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ২৬ ফিট ১১ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৪ ফিট ৫ ইঞ্চি। বিমানটির ওজন ৬ হাজার ৫৬০ কেজি। ম্যা´িমাম টেক অফ ক্ষমতা ১৩ হাজার ৫০০ কেজি। ফুয়েল ক্যাপাসিটি ২ হাজার ৪৫৮ কেজি। তেজাসে রয়েছে নাইট ভিশন কমপ্যাটিবল গ্লাস ককপিট।

জেএফ ১৭ এর দৈর্ঘ্য ৪৯ ফিট। উচ্চতা ১৫ ফিট ৮ ইঞ্চি। বিমানটির ওজন ৬ হাজার ৫৮৬ কেজি। মেক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ১৩ হাজার ৫শ কেজি। জ্বালানি ধারণ ক্ষমতা ২ হাজর ৩৩০ কেজি। অস্ত্র বহন ক্ষমতা ৪ হাজার ২৩৫ কেজি। ৫৪ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম এটি। জেএফ ১৭ এর গ্লাস ককপিটের কারনে পাইলট সহজে বিভিন্ন দিকে দেখতে পায়।

পাকিস্তানের জেএফ ১৭ এর নির্মান এবং পরিচালনা খরচ খুবই কম। এর রক্ষানবেক্ষন ও সহজ। ধরন অনুযায়ী প্রতিটি বিমানের দাম ১৬ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ ভার্সন জেএফ ১৭ থান্ডার ব্লক -৩ এর দাম ৩০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্থ জেনারেশন এফ ১৬ জঙ্গি বিমানের দাম ৩০ মিলিয়ন ডলার। অপর দিকে ভারত ৮৩টি তেজাস বিমান কেনার জন্য যে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে তাতে প্রতিটি বিমানের দাম ভারতীয় গণমাধ্যমে ৭৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি উল্লেখ করেছে।

জেএফ ১৭ এর দাম কম হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ বিমান কেনার বিষয়ে আগ্রহী। ২০১৫ সালে মিয়ানমার ১৬টি বিমান কেনার অর্ডার দেয়। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তারা এ বিমান সংগ্রহ করে।

২০১৪ সালে নাইজেরিয়া এ বিমান কেনার জন্য পাকিস্তানের সাথে ২৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে নাইজেরিয়ার মাকুরদি বিমান ঘাটিতে পৌছায় পাকিস্তানের তিনটি জেএফ ১৭ ফাইটার জেট। নাইজেরিয়া আরো ৪০টি এ বিমান কেনার অর্ডার দিতে পারে মর্মে খবরে বলা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা, আজারাবাইজান, কাতার, মরক্কো, সৌদি আরব, সুদান, আর্জেনটিনা প্রভৃতি দেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে এ বিমান ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উইকিপিডিয়ায় তথ্যে বলা হয়েছে বাংলাদেশ, মিশর, বুলগেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, জর্ডান, কুয়েত, মালয়েশিয়া, পেরু, দক্ষিন আফ্রিকা, উরুগুয়ে এবং ভেনিজুয়েলা এ বিমানের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।