ব্যালিস্টিক মিসাইলের ভূগর্ভস্থ মজুদাগার নির্মাণে চীন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ৩১ মার্চ ২০২১, ০৯:৫৬

চীন বর্তমানে বেশ কিছু ভূগর্ভস্থ সাইলোস বা মজুদাগার নির্মাণ করছে, যেখান থেকে ভবিষ্যতে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করা যাবে। চীন দেশের একেবারে উত্তরাঞ্চলে এ সাইলোসটি তৈরি করছে, যেখান থেকে ডিএফ-ফোর্টিওয়ান এবং ডিএফ থার্টিওয়ান এজি মিসাইলগুলো নিক্ষেপ করা হবে। এই মিসাইলগুলো দূরপাল্লার। প্রতিটি মিসাইল ১০ হাজার কিলোমিটার থেকে ১৪ হাজার কিলোমিটার অবধি পথ অতিক্রম করতে পারে। অর্থাৎ, এ মিসাইলগুলো চীন থেকে যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে গিয়ে আঘাত হানতে পারে।

চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির রকেট ফোর্স মঙ্গোলিয়ার অভ্যন্তরে উহাই প্রদেশের পশ্চিমে একটি মিসাইল প্রশিক্ষণ এলাকায় ১৬টি সাইলোস নির্মাণ করছে। এমনটাই জানিয়েছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্ট বা ফাস। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি স্যাটেলাইটে তোলা নির্মাণাধীন প্রকল্পের বেশ কিছু ছবিও প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকার সাথে সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হওয়ায় চীন এখন ক্রমশ তার পারমাণবিক কার্যক্রম জোরদার করছে। মিসাইল সাইলোস নির্মাণ এই কৌশলেরইং অংশ। চীনের ডিএফ-ফোর্টি ওয়ান মিসাইলগুলো একাধিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করতে পারে। এই মিসাইলগুলোকে সাইলোভিত্তিক যেকোনো প্লাটফর্ম অথবা সড়ক বা রেলপথ-ভিত্তিক মোবাইল লঞ্চার দিয়েও নিক্ষেপ করা যায়।

নতুন এই ভূগর্ভস্থ সাইলোসগুলো জিলানটাই ট্রেনিং বেইজের কেন্দ্রে অবস্থিত। সাইলোসটি মূলত ২০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত। সাইলোস দুটো ২ দশমিক ২ কিলোমিটার থেকে ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। যাতে কোনো একটি পারমাণবিক আক্রমণ হলে দুটো সাইলোস একসাথে ধ্বংস না হয়ে যায়। বেইজিংয়ের সরকারী নীতি হলো, তারা কোনো সংঘাত বা সংঘর্ষে নিজেরা প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে না।

এরপরও বেইজিং খুব সচেতনভাবে পারমাণবিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। যাতে প্রতিপক্ষের কেউ পারমাণবিক আক্রমন করলে তার যথাযথ জবাব দিতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে চীনা সামরিক শক্তি বা সক্ষমতা সম্পর্কে জানিয়েছে , তারা চীন অতিরিক্ত আরো কিছু ডিএফ-ফোর্টিওয়ান মোবাইল ছোড়ার সক্ষমতা অর্জন করছে। আগামীতে রেল মোবাইল ও সাইলোস ব্যবহারেরও পরিকল্পনা করছে দেশটি। অন্যদিকে ২০২০ সালের প্রতিবেদনে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর জানিয়েছে , জিলানতাই ট্রেনিং বেইজটিই সম্ভবত সেই স্থান যেখান থেকে চীন সাইলোভিত্তিক ডিএফ-ফোর্টি ওয়ান মিসাইল অপারেশন পরিচালনা করার কথা ভাবছে।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্ট এর প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি চীন আগামী কয়েক বছরে তার ব্যালিস্টিক মিসাইল সাইলোসগুলো দ্বিগুন বা তিনগুন বৃদ্ধি করে তারপরও যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার পারমাণবিক আক্রমন সক্ষমতার চেয়ে চীন অনেকটা পিছিয়ে থাকবে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ৪৫০টি সাইলোস রয়েছে যার মধ্যে ৪শটিতেই মিসাইল লোড করা রয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার হাতে ১৩০টি সক্রিয় সাইলোস রয়েছে। চীনের হাতে বর্তমানে ১৮ থেকে ২০টি সাইলোস সক্রিয়ভাবে রয়েছে।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্ট এর প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের প্রশিক্ষন কেন্দ্রের যেসব স্যাটেলাইট ইমেজ পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, দুই ড্রাইভের টানেল ইতোমধ্যেই নির্মাণ করা হয়ে গেছে। এসব টানেলে মোবাইল মিসাইল নিক্ষেপ করার মতো যথেষ্ট জায়গাও রাখা হয়েছে। চীন ইচ্ছে করলে এ বিশাল জায়গায় মিসাইল লুকিয়েও রাখতে পারবে।

ম্যাকাউ ভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক এন্টনি অং টং বলেন, চীনের নতুন এই সাইলোসগুলো ইংগিত দিচ্ছে যে চীন ক্রমশ ভূমিভিত্তিক মিসাইল মোতায়েনের ক্ষেত্রে পরিমান ও গুনগত- উভয়দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সাইলোসগুলো হলো প্রতিপক্ষকে কাউন্টার আক্রমন করার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। কিন্তু সাইলোসের দুর্বলতা হলো প্রতিপক্ষ এই ধরনের স্থাপনাগুলোকে বোমা হামলার জন্য টার্গেট করে। কারন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সহজেই সাইলোসের স্থানগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।

সাইলোস থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করা হলে টার্গেটে তা আঘাত হানার সম্ভাবনা অনেক বেশি। চীন নতুন করে যে সাইলোসগুলো নির্মাণ করেছে সেগুলো ডিএফ ফোর্টিওয়ান মিসাইলের জন্য। এ প্রকল্পটি ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের আওতাধীন বিগ্রেড পরিচালনা করছে। হংকং ভিত্তিক সামরিক পর্যবেক্ষক সং ঝংপিং মনে করেন , ভূমি ভিত্তিক এই মিসাইল লঞ্চারগুলো চীনের রকেট ফোর্সের সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর পাওয়ার স্ট্রাইক।

চীন ভূমিভিত্তিক সাইলোসে আগ্রহী হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে দেশটি ভূমিভিত্তিক আইসিবিএম, সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইল এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপন যোগ্য সমরাস্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। মূলত, চীন পারমাণবিক খাতে শক্তি ও সক্ষমতা অর্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেই মনে হচ্ছে।

এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ বর্তমানে বৈশ্বিক হাইপারসনিক এবং শক্তিচালিত অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উন্নয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, চীন এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। তারা হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবহারে অনেক বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই ডিএফ-সেভেনটিন হাইপারসনিক গ্লাইড ভেইকল নির্মাণ করে চীন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

ডিএফ-সেভেনটিন হাইপারসনিক গ্লাইড ভেইকলকে চীন প্রথমবারের মতো সামনে আনে ২০১৯ সালের শেষদিকে বেইজিংয়ের সামরিক প্যারেডে। যেকোনো ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে প্রথম ধাক্কায় এই ধরনের গ্লাইড ভেহিক্যাল খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। কেননা এই একটি সমরাস্ত্র ব্যবহারে মিসাইলের গতিও প্রাথমিকভাবে অনেকটা বৃদ্ধি পায়। ফলে টার্গেটের দিকেও মিসাইলটি ঝড়ের বেগে ছুটতে পারে। ২০১৯ সালের সেই প্যারেডে ডিএফ-সেভেনটিনকে একটি পাঁচস্তরের ট্রান্সপোর্টার লঞ্চারের চাকার ওপর বসিয়ে নিয়ে আসা হয়।

তখন ডিএফ সেভেনটিনকে দেখে অনেকেই মনে করেছিল যে, পিপলস লিবারেশন আর্মির হাতে থাকা অন্যান্য রোড মোবাইলের লঞ্চারের মতো একই প্রযুক্তিতেই এটি নিক্ষেপ করা হবে। রোড মোবাইল মিসাইল লঞ্চ করার ক্ষেত্রে অনেক সময় নিক্ষেপের ঠিক আগ মুহুর্তে কিছু জটিলতাও দেখা দিতে পারে। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ডিএফ-সেভেনটিন ভিন্ন প্রযুক্তির এবং এই মিসাইলগুলো নিয়ে চীনের আলাদা ও বিশেষ ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে।

মার্কিন সরকারী সূত্রগুলো দাবি করছে, চীন এরই মাঝে বেশ কয়েকবার হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালের পর বেশ কয়েকদফায় ডিএফ-সেভেনটিন নিয়েও পরীক্ষা চালিয়েছে। ডিএফ-সেভেনটিন এ সংস্করণের প্রথম কোনো মিসাইল যা বিশ্বে প্রথমবারের মতো চীন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশ এ প্রযুক্তি নিয়ে এখনো কাজ করলেও কোনো কার্যকর আউটপুট দিতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, চীন এখন আকাশ থেকে নিক্ষেপনযোগ্য হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল নির্মাণ নিয়েও কাজ শুরু করেছে।

পেন্টাগনের কর্মকর্তারা অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন যে চীন গোপেনে এইচ-সিক্স বোমারু বিমান দিয়ে আকাশ থেকে নিক্ষেপনযোগ্য ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বা ভিডিও প্রকাশ করতে পারেননি। চীন যদি এখাতে অগ্রগতি অর্জন করতে পারে তাহলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

চীন যদি রোড মোবাইল বা আকাশ থেকে নিক্ষেপনযোগ্য হাইপারসনিক গ্লাইড ভেইকল আসলেই তৈরি করতে পারে তাহলে চীনের প্রতিপক্ষ শক্তিগুলোর স্থাপনা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। বর্তমানে চীনের হাতে যে বিপুল পরিমাণ ব্যালিস্টিক, ক্রজ, ভূমি থেকে এবং ভূমিতে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইল এবং এন্টিশিপ মিসাইল রয়েছে তা নিয়েই চীনের প্রতিপক্ষদের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। হাইপারসনিক ও শক্তিচালিত প্রযুক্তিও যদি চীনের হাতে চলে যায় তাহলে গোটা অঞ্চলের জন্যই চীন একটি মূর্তিমান আতংকে পরিণত হয়ে যাবে।

পেন্টাগন দাবি করছে চীন ইতোমধ্যে ভূমিতে বেশ কয়েকদফায় রেল অস্ত্রের পরীক্ষন চালিয়েছে। চীনারা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চ গতির অস্ত্র নিক্ষেপ করতেও সক্ষম হয়েছে। যদিও পরীক্ষার সময়ে চীন এই সমন্ত প্রোজেক্টাইলে কোনো বিস্ফোরক বহন করেনি। ভবিষ্যতে যদি তারা এর সাথে হাইপারসনিক প্রযুক্তির মিসাইল জুড়ে দেয় তাহলে যেকোনো প্রতিপক্ষ বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।

চীন শক্তিচালিত অস্ত্র উদ্ভাবনের নানা চেষ্টা করছে। চীনের সরকারী গনমাধ্যমগুলো এরই মধ্যে লেজারশক্তি চালিত বেশ কিছু অস্ত্রের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে। চীন একটি হ্যান্ড হেল্ড ধ্বংসাত্মক লেসার অস্ত্র দেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। ভীড় ও জনসমাগম এড়াতে তারা এই অস্ত্রের প্রয়োগও শুরু করেছে। এ অস্ত্রগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে, এগুলো টার্গেটের খুব কম ক্ষতি করেও কাজ হাসিল করতে পারে। আবার চাইলে কাস্টমাইজের মাধ্যমে এর শক্তিকে বাড়িয়ে মানুষের চামড়া ও টিস্যুর ভেতরেও এই রশ্মিকে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। এমনকী এই লেজার রশ্মি থেকে আলো বিচ্ছুরণ করে একজন ব্যক্তির পরিহিত পোশাকেও আগুন ধরিয়ে দেয়া যায়। চীন এই লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ভাসমান ড্রোনের তেলের ট্যাংকে আগুন ধ্বরিয়ে সহজেই ভূপাতিত করতেও সক্ষম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।