ইয়েমেন যুদ্ধের ৬ বছর : এমবিএসের পরাজয়

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ৩০ মার্চ ২০২১, ০৯:০৪

ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন ফোর্সের যুদ্ধের ৬ বছর পার হয়েছে। ঠিক যেদিন ৬ বছর পালিত হলো, হুথি যোদ্ধারা সেদিনও সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। হুথির সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, তাদের ওপর অন্যায্যভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিন সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু হামলা হয়েছে। এ হামলায় ১৮টি ড্রোন এবং ৮টি ব্যালিস্টিক মিসাইলও ব্যবহার করা হয়। যদিও হুথি জোটের অপর একটি অংশ এখন জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং রিয়াদের সাথে ওমানের মধ্যস্থতায় সংলাপও চালিয়ে যাচ্ছে।

ইয়েমেন যুদ্ধের বর্ষপূতিতে হুথি যোদ্ধারা সৌদি আরামকোতে ১২টি ড্রোন এবং ৮টি মিসাইল দিয়ে হামলা চালায়। আর বাকি ৬টি ড্রোন দিয়ে সৌদি সামরিক বাহিনীর নানা স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে দাম্মামে কিং আব্দুল আজিজ এয়ার বেইসও রয়েছে। সৌদি আরবের বন্দরনগরী জাজানের একটি তেল স্থাপনাতেও হামলা চালানো হয়েছে। হুথিরা দাবি করছেন, সৌদি আরবে ভবিষ্যতেও এই ধরনের হামলা চলমান থাকবে। তারা সৌদি সামরিক আক্রমণ বন্ধ এবং ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবি জানান।

হুথির আরেকজন মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন যে, তারা ৬ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য আন্তর্জাতিক সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘের ইয়েমেন বিষয়ক বিশেষ দূত এবং সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথেও ওমানের মধ্যস্থতায় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

সৌদি আরব সম্প্রতি জাতিসংঘের তত্বাবধানে ইয়েমেনে একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। সৌদি আরব জানিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে হুথি যোদ্ধাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। যদিও হুথি যোদ্ধাদের প্রধান সংগঠন আনসার আল্লাহ সৌদিআরবের এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে।

হুথিরা মনে করছে, সৌদি আরবের এ প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির ইংগিত থাকলেও ইয়েমেনের ওপর অবরোধ প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো আশ্বাস নেই। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনের প্রধান বিমানবন্দর সানা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এবং দেশটির প্রধান দুই নৌ বন্দর হোদেইদাহ এবং সালিফ বন্দর অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই তিনটি স্থাপনা দিয়েই ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় খাবার, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও তেল আমদানি হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ ও মানবিক সংকটের মুখে থেকে হুথিরা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি আগ্রাসী ও বেপরোয়া অবস্থানে রয়েছে। তাদের মধ্যে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়ার বা আত্মসমর্পণ করার ন্যুনতম মানসিকতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং আগামী দিনগুলোতে তারা মারিব ও অন্যান্য অঞ্চলে মারাত্মক আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে। এই অঞ্চলগুলোতে এখনও রিয়াদ সমর্থিত নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বুহ মানসুর হাদির কিছুটা নিয়ন্ত্রন আছে। এরমধ্যে হুথির প্রধান পৃষ্টপোষক ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, ইরান এমন একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে যা কার্যকর হলে ইয়েমেন যুদ্ধ যেমন বন্ধ হবে। তেমনি ইয়েমেনের ওপর অবরোধেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে।

বিশ্লেষকরা সৌদি আরবের এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাববকে দেশটির দুর্বলতা হিসেবেই দেখছেন। তারা মনে করছেন, সৌদি জোটে আস্থার সংকট এবং ক্রমাগত ভাঙ্গনের সুর ওঠায় এবং এই যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন কমে যাওয়ায় সৌদি আরব দুর্বল হয়েছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হুথি সেনারা ইয়েমেনের রাজধানী দখল করে নেয়। পরবর্তীতে তারা দেশটির অধিকাংশ স্থানেই নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে।

২০১৫ সালে সৌদি আরব যখন ইয়েমেনে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সৌদি আরবকে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছিলেন। আরব উপদ্বীপে ইরানের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বিস্তারের অজুহাতে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ সৌদি আরব প্রথমবারের মতো ইয়েমেনে হামলা চালায়।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকে সমর্থন করেন। তিনি সৌদি আরবকে কুটনৈতিক কোনো সমাধানে যেতেও উদ্বুদ্ধ করেননি। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক পরিসরে সৌদি আরব কোনঠাসা অবস্থায় পড়ে যায়। বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন পরিস্কারভাবেই সৌদিকে জানিয়ে দেয় তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন আনতে চান। এরই অংশ হিসেবে ইয়েমেনে অবিলম্বে যুদ্ধপরিস্থিতির অবসান দেখতে চায়। পাশাপাশি, ইরানের সাথেও দেশটির পারমানবিক প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা শুরুর আগ্রহ প্রকাশ করে।

ইতোমধ্যে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠমিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যদিও আফ্রিকার উপকণ্ঠে আমিরাত আধিপত্য বিস্তারে অন্য সব পদক্ষেপ আগের মতোই সক্রিয় রেখেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত দক্ষিন ইয়েমেনীদেরকেও নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। মূলত আরব আমিরাত বৃহত্তর ইয়েমেনকে দুইভাগে ভাগ করার টার্গেট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

সৌদি আরব মিশর ও পাকিস্তানের ওপর ভর করে ইয়েমেন যুদ্ধের ছক সাজায়। কিন্তু এ দুটো দেশই সৌদি আরবকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতে অস্বকৃতি জানালে সৌদি আরব একা হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সমর্থন কম পাওয়ায় সৌদি আরব তার সকল শক্তিকে প্রয়োগ করার মতো সাহস দেখাতে পারছে না। তারপরও গত ৬ টি বছর সৌদি আরব এ যুদ্ধ চালিয়ে আসতে পেরেছে কারণ তাদের পাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের মতো দুই পরাশক্তি সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে।

সৌদি আরবের দুর্বল অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন ওয়াশিংটন হুথিদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সৌদি আরবের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হুথিরা সৌদি আরবের অর্থনৈতিক নানা স্থাপনায় আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে সৌদি আরবের তেলস্থাপনা এবং বিমানবন্দরগুলো হুথিদের আক্রমণের টার্গেটে পরিনত হয়। সৌদি আরব দক্ষিনাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত এবং এ অঞ্চলে ইরানের আধিপত্যকে কমিয়ে আনার জন্য এ যুদ্ধ শুরু করলেও দীর্ঘ ৬ বছরে সেই লক্ষ্যের খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে।

২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধ শুর হয়েছিল তথাকথিত সালমান ডকট্রিনের দোহাই দিয়ে। সৌদি প্রশাসনে তখন থেকে বর্তমান বাদশাহ সালমানের পুত্র মুহাম্মাদ বিন সালমানের প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করে। ধারনা করা হয়, মুহাম্মাদ বিন সালমান বা এমবিএসের পরামর্শেই ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব। যে উদ্দেশ্য এমবিএস যুদ্ধ শুরু করেন, তা আজও পূরণ হয়নি। বরং ইয়েমেনে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। বন্ধুহীন হয়ে সৌদি আরবকে ৬ বছর পরে এসে স্বেচ্ছায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিতে হয়েছে। পাশাপাশি, বিগত কয়েক বছর ধরে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধও চলমান রয়েছে।

সৌদি মিত্র আরব আমিরাত গোপনে ইয়েমেনের দক্ষিনাঞ্চলীয় শক্তিগুলোকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় কার্যত দেশটিতে কোনো শান্তিপূর্ন ও গনতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার মতো অবকাশ পাওয়া যায়নি। বিগত কয়েক বছরের যুদ্ধে অসংখ্য বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। ইয়েমেনের ভূখন্ডে এখন বিদেশী শক্তির পদধ্বনি আর আকাশ জুড়ে নানা দেশের বিমানের সতর্ক মহড়া। দেশটিতে নতুন নতুন মিলিশিয়ার উত্থান হয়েছে যারা দেশটির বড়ো অংশজুড়েই নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে। এ অবস্থায় একীভূত একটি ইয়েমেন প্রতিষ্ঠা করা রীতিমতো অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। গনতান্ত্রিক কোনো সরকারও সেখানে কার্যকর হবে- এমন সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

সৌদি আরব দীর্ঘ দিন থেকে উত্তর ইয়েমেনীয় গোত্রগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে এসেছিল। ইয়েমেনের এসব গোত্রপতি এবং শায়খরা সৌদি রাজবংশের প্রতি অনুগতও ছিল। সৌদি আরব একইসঙ্গে ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহকেও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে এসেছিল। কিন্তু সালেহ এক সময় সৌদি আরবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে হুথিদের সাথে হাত মিলান।

মোহাম্মাদ বিন সালমান সৌদি আরবের প্রভাব বিস্তার করার পর তিনি ইয়েমেনের গোত্রপতিদেরকে আর্থিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দেন। ইয়েমেনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হওয়ার স্বপ্নে তিনি ইয়েমেনে যুদ্ধও শুরু করেন। কিন্তু কোনো কিছু করেই কোনো লাভ হয়নি। শুধু সালেহ নন, উত্তর ইয়েমেনের অধিকাংশ গোত্রই এ যুদ্ধে হুথিদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে।

বর্তমানে ইয়েমেন ইতিহাসের সবচেয়ে দু:সহ মানবিক ও আর্থিক সংকট মোকাবেলা করছে। জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ ইয়েমেনি নাগরিক বর্তমানে দুর্ভিক্ষের শিকার। প্রায় ২৫ লাখ শিশু অনাহারে অপুষ্টিতে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে। ইয়েমেনের অবকাঠামো আগেও খুব একটা ভালো অবস্থানে ছিল না। তবে এবারের যুদ্ধ দেশটির অবকাঠামোকে ধ্বংস করে এমন জায়গায় নামিয়েছে যা পুনরুদ্ধার করতে বা বিপুল অর্থের প্রয়োজন। যা ইয়েমেনের পক্ষে এককভাবে আর করা আর সম্ভবও হবে না।