বিশ্বের সেরা পাঁচ ট্যাঙ্ক


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১১:৪৩

স্থলযুদ্ধের প্রধান উপকরণ বলা হয় ব্যাটল ট্যাঙ্ককে। দুর্গম পথ কিংবা যে কোনো বাধা টপকে এটি প্রবেশ করতে পারে শত্রুর ভূখণ্ডে। কামানের গোলা ছুড়ে ধ্বংস করতে পারে অনেক দূরের টার্গেটকেও। সবচেয়ে সুরক্ষিত এই সামরিক যানকে যুদ্ধক্ষেত্রের রাজাও বলা হয়।

ট্যাঙ্কের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর পুরো অত্যন্ত পুরু বর্ম দ্বারা আবৃত থাকে। আর ক্যাটারপিলার ট্র্যাক থাকায় ট্যাঙ্ক দুর্গম জায়গাতেও সহজে চলতে পারে। এর থাকে শক্তিশালী একটি কামান। যা যে কোনো দিকে ঘুড়িয়ে ফায়ার করা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে ট্যাঙ্কের ব্যবহার শুরু করে সামরিক বাহিনীগুলো। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ফরাসি এবং ইংরেজরা। ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডের লিঙ্কনে অবস্থিত উইলিয়াম ফস্টার অ্যান্ড কোম্পানি প্রথম ট্যাঙ্কের প্রোটোটাইপ বানায়, যার নাম রাখা হয়েছিল ‘লিটল উইলি’। এই প্রোটোটাইপ থেকে ১৯১৬ সালে বানানো হয়েছিল প্রথম ট্যাঙ্ক, যার নাম ‘ব্রিটিশ মার্ক ১’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্যাঙ্কের আরও অগ্রগতি সাধিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে সামরিক বাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় ট্যাঙ্ক।

সব সামরিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতেই বিশ্বের সেরা মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের তালিকার এক নম্বর জায়গাটিতে রয়েছে জার্মানির লিওপার্ড টু-এ সেভেন প্লাস। আগামী প্রজন্মের ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত লিওপার্ডের উদ্ভাবক জার্মান সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্রাস-মাফেই ওয়েগমান বা কেএমডব্লিউ। ২০১০ সালে উদ্ভাবিত এই ট্যাঙ্কটি মূলত স্নায়ুযুদ্ধ যুগের লিওপার্ড টু ট্যাঙ্কের আধুনিক সংস্করণ। যা যুদ্ধক্ষেত্রে খুবই সফল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আধুনিক এই সংস্করণে যুক্ত করা হয়েছে বাড়তি কিছু অস্ত্র এবং উন্নত করা হয়েছে ইলেকট্রনিক সিস্টেম। যা এই ট্যাঙ্কটিকে দিয়েছে টার্গেটে নির্ভুলভাবে হামলা করার ক্ষমতা।

সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত এই ট্যাঙ্কটি সব ধরনের ভৌগলিক পরিবেশে কাজ করতে সক্ষম। ট্যাঙ্কটি এমন ধাতুতে তৈরি যা সব ধরনের অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল, মাইন কিংবা যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক হামলা প্রতিহত করে টিকে থাকতে পারবে। এছাড়া প্রয়োজনে এটির সাথে মাইন অপসারণ ডিভাইস ও যুক্ত করা যায়। এতে আছে ১২০ মিলিমিটার এল ফিফটি ফাইভ কামান। এছাড়া আছে ৪০ মিলিমিটার গ্রেনেড লঞ্চার। বর্তমান সময়ের যে কোনো ট্যাঙ্কের তুলনায় এর কামানের শক্তি অনেক বেশি। আর আছে অ্যাডভান্সড ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম।

৪৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত এটি কন্ট্রোলরুমের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। দেড় হাজার হর্সপাওয়ারের ডিজেল ইঞ্জিনের শক্তিতে ট্যাঙ্কটি চলতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার গতিতে। দুর্গম পথে ছুটতেও এটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

এখন পর্যন্ত এই মডেলের ২০টি ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে জার্মান আর্মির জন্য। এই সংখ্যা দেড়শোতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।

তালিকার দুই নম্বর স্থানটি দক্ষিণ কোরিয়ার কে টু ব্ল্যাক প্যান্থার ট্যাঙ্কের দখলে। এটিও বর্তমান সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর ট্যাঙ্কগুলোর একটি।

কে টু ব্ল্যাক প্যান্থার বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামী ট্যাঙ্কও। ২০১৬ সালে ট্যাঙ্কটি দক্ষিণ কোরীয় সেনাবাহিনীর সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। প্রথম লটে এর ১০০টি ট্যাঙ্ক সরবরাহ করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রটেম। দ্বিতীয় লটের আরও ১০৬টি ট্যাঙ্কের নির্মাণ কাজ চলছে। এই মডেলের মোট ৩০০টি ট্যাঙ্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার। বর্তমানে ব্যবহৃত কে ওয়ান ট্যাঙ্কের জায়গা নেবে অত্যাধুনিক এই সামরিক যান।

ব্ল্যাক প্যান্থারের এল ফিফটি ফাইভ কামান ছুড়তে পারে ১২০ মিলিমিটার ট্যাঙ্কের গোলা। এর ট্র্যাকিং, টার্গেটি ও ফায়ারিং সিস্টেম সম্পূর্ণ অটোমেটিক, যা ট্যাঙ্কটিকে করেছে আরও কার্যকর। চলন্ত টার্গেট, এমনকি নিচু দিয়ে চলা হেলিকপ্টারকেও নিশানা বানাতে পারে এটি। এছাড়া আছে দুটি হেভি মেশিন গান। শত্রুর মিসাইল হামলা সহ্য করে এর টিকে থাকার ক্ষমতাও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের আব্রামস ট্যাঙ্কের বডি যে ধাতুতে তৈরি হয়েছে, ব্ল্যাক প্যান্থারেও একই ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য ট্যাঙ্কের তুলনায় ওজন অনেক কম হওয়ায় এটির দুর্গম পথে চলার ক্ষমতা বেশি।

ডিজেল ইঞ্জিনের এই ট্যাঙ্কটিতে একজন ড্রাইভার, একজন কমান্ডার ও একজন গানার নিয়ে চলে। ১০.৮ মিটার লম্বা ব্ল্যাক প্যান্থারের ওজন ৫৪ টন। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। এই মডেলের প্রতিটি ট্যাঙ্কের নির্মাণ খরচ সাড়ে ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আব্রামস এমওয়ান এ টু এসইপি আরেকটি বিধ্বংসী সামরিক যান। মিশিগান ভিত্তিক মার্কিন প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল ডায়নামিকসের ১৯৮০ সালে তৈরি এমওয়ান আব্রামস ট্যাঙ্কের আধুনিক ভার্সন এই এম ওয়ান এ টু এসইপি।

আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত ফায়ার পাওয়ার আর দুর্দান্ত গতিশীলতা ট্যাঙ্কটিকে স্থান দিয়েছে সেরার তালিকায়। এর কামান থেকে চলন্ত গাড়ি, এমনকি নিচু দিয়ে চলা এয়ারক্রাফটকেও লক্ষ্য বানানো যায়। মূল কামানটি ছাড়াও এতে রয়েছে দুটি মেশিন গান। এছাড়া আছে একটি গ্রেনেড লঞ্চার। এই ট্যাঙ্কটির গোলাবারুদ বহনের ক্ষমতা অন্যান্য ট্যাঙ্কের চেয়ে বেশি।

ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬৮ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে সক্ষম ট্যাঙ্কটিতে ক্রুদের সুরক্ষার জন্য রয়েছে ইস্পাত ও ইউরেনিয়াম লেয়ার যুক্ত বর্ম। অনেকে শুধু এই কারণেই এই ট্যাঙ্কটিকে বিশ্বের সেরা ট্যাঙ্ক বলে মনে করেন। তবে এই ট্যাঙ্কটির একটি খারাপ দিক হচ্ছে এটির অপারেশন কিছুটা জটিল এবং জ্বালানী খরচও হয় বেশি। এছাড়া এই ট্যাঙ্কটির কামানে গোলা লোড কারার জন্য বাড়তি একজন লোডার দরকার। যার কারণে এর ক্রু সংখ্যা দাড়িয়েছে চার জনে। ২৬ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট চওড়া ট্যাঙ্কটি আকারেও স্বাভাবিকের চেয়ে বড়।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে এই মডেলের ট্যাঙ্ক রয়েছে ৯০০টির বেশি। যুক্তরাষ্ট্র আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই ট্যাঙ্কটিকে তাদের সম্মুখ সমরের প্রধান অবলম্বন হিসেবে রাখতে চাচ্ছে। এর সর্বশেষ এসইপি সংস্করণটি এখনো রফতানি করেনি ওয়াশিংটন, তবে এর পূর্ববর্তী সংস্করণ এমওয়ান এটু’র ৩৭৩টি সৌদি আরব ও ২১৮টি ট্যাঙ্ক কুয়েতের কাছে বিক্রি করেছে তারা।

তালিকার চার নম্বরে আছে ব্রিটেনের চ্যালেঞ্জার টু, যেটি সক্ষেপে সিআর টু নামেই পরিচিত। ব্রিটিশ আর্মির এই ট্যাঙ্কটি স্থলযুদ্ধে শত্রুর বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই।

ব্রিটেনের ভিকার্স ডিফেন্স সিস্টেমের তৈরি চ্যালেঞ্জার ওয়ান ট্যাঙ্কের আধুনিক এই সংস্করণটি বসনিয়া, কসভো আর ইরাক যুদ্ধে তার দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। আসলে বিশ্বের সেরা ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যেই এটিই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধক্ষেত্রে সার্ভিস দিয়েছে। অন্য ট্যাঙ্কগুলোর দক্ষতার কথা আমরা নির্মাতাদের মুখে শুনেই বিশ্বাস করে যাচ্ছি; কিন্তু চ্যালেঞ্জার টু তার দক্ষতা দেখিয়েছে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে। এর রয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের কোবহাম বর্ম, যা শত্রুর গোলা থেকে ট্যাঙ্কটিকে সুরক্ষা দিতে পারে। যে কারণে এর ক্রুরা নির্ভয়ে ঢুকে পড়তে পারে শত্রুর ভূখণ্ডে।

এই ট্যাঙ্কের প্রধান কামান ছাড়াও রয়েছে দুটি মেশিন গান। ড্রাইভার, কমান্ডার, গানার ও লোডার মিলে চারজন ক্রু ট্যাঙ্কটিকে পরিচালনা করেন। প্রযুক্তির ব্যবহারে এটি এই সময়ের অনান্য সেরা ট্যাঙ্কগুলোর চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এর দুর্গম পথে চলার ক্ষমতা দুর্দান্ত। টার্গেটিংয়েও এটি অন্য অনেকের চেয়ে নিখুত। সবচেয়ে বেশি দূরত্ব থেকে শত্রুর ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার বর্তমান বিশ্ব রেকর্ড এই ট্যাঙ্কের দখলে।

১৯৯৮ সাল থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত আছে ট্যাঙ্কটি। তাদের কাছে এই ট্যাঙ্ক আছে তিনশোর বেশি। এছাড়া ওমানের কাছেও এই ট্যাঙ্ক রফতানি করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

ডিজেল ইঞ্জিন চালিত ট্যাঙ্কটির প্রতিটির দাম ৪ লাখ ১২ হাজার ইউরো। ২৭ ফুট লম্বা ও সাড়ে ১১ ফুট চওড়া ট্যাঙ্কটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৫৯ কিলোমিটার।

তালিকার ৫ নম্বরে রাখা হয়েছে রাশিয়ার টি-ফোরটিন আরমাটা মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ককে। রুশ সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউরারভাগোনজাভোদ এটি তৈরি করেছে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য।

২০১৫ সালে ট্যাঙ্কটির উতপাদন শুরু করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত এর ২০টি ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা দ্রুত ১০০ তে উন্নীত করবে রাশিয়া।

আগামী প্রজন্মের ট্যাঙ্ক আরমাটার রয়েছে অটোমেটিক লোডিং সিস্টেম। মূল কামান ছাড়াও এর রয়েছে দুটি মেশিন গান, গ্রেনেড লঞ্জার ও স্মোক বোম ছোড়ার প্রযুক্তি। আর সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছে এটি লেসার গাইডেড মিসাইল ছুড়তে পারে।

ছুটে আসা যে কোনো ধরনের ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলা সনাক্ত করতে পারে এটি। যা ট্যাঙ্কটিকে দিতে পারে সুরক্ষা। এছাড়া এতে আছে লেভেল ফাইভ প্রোটেকশন সিস্টেম।

অনেক সমর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রাশিয়ার এই ট্যাঙ্কটি আসলে পশ্চিমাদের যে কোনো ব্যাটল ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক দিক থেকেই এগিয়ে আছে। যদিও পশ্চিমা ওয়েবসাইটগুলো র‌্যাঙ্কিয়ে এটিকে নিচের দিকেই স্থান দিয়েছে।

এর অত্যন্ত শক্তিশালী ইঞ্জিন গতি তুলতে পারে ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ২৯ ফুট লম্বা ও ১১ ফুট চওড়া ট্যাঙ্কটির ক্রু তিনজন।