সামরিক র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা দশে পাকিস্তান

-

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:০২

সামরিক শক্তিতে আরও এগিয়ে গেল পাকিস্তান। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের র‌্যাঙ্কিংয়ে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে দেশটির। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে এখন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার উপরে পাকিস্তান। অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও সামরিক খাতে পাকিস্তানের এই উন্নতি অবাক করার মতো। ক্রমশই সমরাস্ত্র শিল্পে আমদানি নির্ভরতা কমানোর পথেও হাঁটতে শুরু করেছে দেশটি।

মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তান। এজন্য দেশটিকে বলা হয় মুসলিম বিশ্বের সুপার পাওয়ার। সামরিক শক্তির অন্যান্য মানদণ্ডেও দ্রুত উন্নতি করছে দেশটি। আর এই উন্নতির প্রভাব পড়েছে তাদের র‌্যাঙ্কিংয়ে। সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েব সাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২১ সালের জন্য প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে বড় লাফ দিয়েছে দেশটি।১৩৩টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৫ নম্বর থেকেএক লাফে দশে উঠে এসেছে পাকিস্তান।র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানের অবস্থানেরই উন্নতি হয়েছে।

সংস্থাটি ৫০টি বিষয়ের ভিত্তিতে দেশগুলোর পাওয়ার ইনডেক্স তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর পরিধি, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও দক্ষতা, সামরিক বাজেট, বিভিন্ন মিশনে সফলতার মতো বিষয়গুলো। তালিকার এক নম্বর স্থানটি যথারীতি ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরে আছে রাশিয়া ও চীন। ১৫ থেকে এক লাফে ১০- এ উঠে আসার পথে পাকিস্তান পিছনে ফেলেছে ইসরাইল, কানাডা, ইরান ও ইন্দোনেশিয়াকে।

মূলত বৈরী প্রতিবেশী ভারতকে মোকাবেলার জন্যই পাকিস্তান ক্রমশ তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধ করে চলেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও দেশটি বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় করে সামরিক খাতে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে পাকিস্তান সামরিক খাতে বরাদ্দ করেছে ৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ছিল আগের অর্থ বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি। তবে সামিরক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের প্রকৃত সামরিক বাজেট এর চেয়েও অনেক বেশি। কারণ এই বাজেটের সাথে তাদের সামরিক সেক্টরে বড় কিছু কেনা-কাটা, পারমাণবিক কর্মসূচির খরচ, আধা সামরিক বাহিনীর খরচ যোগ করা হয়নি।

এছাড়া নতুন গড়ে তোলা একটি সিকিউরিটি ডিভিশনের খরচও এই বাজেটের বাইরে রাখা হয়েছে।

লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক এসওএএস এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট আয়শা সিদ্দিকা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রশ্নের মুখে না পড়তে পাকিস্তান কিছু খরচ সামরিক বাজেটের সাথে যুক্ত করেনি।এগুলো যোগ করার হলে পাকিস্তানের সামরিক বাজেট দাড়াবে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এই সামরিক গবেষক গত বছর আলজাজিরা অনলাইনে তার এক নিবন্ধে বলেছিলেন, পাকিস্তান এমন এক সময়ে তার এই প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে চলছে যখন, দেশটি করোনা মহামারী ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যস্ত।

করোনা মহামারী নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন ও শক্তিবৃদ্ধিও ক্ষেত্রে এতটুকু ছাড় দেয়নি। অন্য সব সেক্টর থেকে এ সময় খরচ কমানো হলেও সামরিক বাহিনীর খরচ কমেনি। কাজেই সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের এই উন্নতি যে হুট করেই হয়েেেছ তেমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। দেশটির কর্মকর্তারা অনেক দিন ধরেই এই সেক্টরে উন্নতির দিকে নজর দিয়েছেন। যার কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝেও পাকিস্তান প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করে চলেছে তার সামরিক বাজেট।

বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পকে উন্নত করার দিকেও দেয়া হয়েছে মনোযোগ। এক্ষেত্রে তারা সহযোগিতা পেয়েছে চীন ও তুরস্কের মতো দুটি শক্তিশালী দেশের। প্রতিরক্ষা সেক্টরে পাকিস্তান গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীন ও তুরস্কের সহযোগিতার হাত আরো লম্বা হয়েছে পাকিস্তানের দিকে।

২০১৯ সালের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক নথিতে উঠে এসেছিল পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পর্কে।যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের ওই নথিতে উল্লেখ করেছিল- পাকিস্তান কিভাবে তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করে চলেছে। এতে বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝেও পাকিস্তান দুটি সেক্টরে বেশি মনোযোগ দিয়েছে, এক প্রচলিত সামরিক বাহিনীর পরিধি বৃদ্ধি. দুই- উন্নত যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর বিদেশী সরঞ্জাম বাদ দিয়ে নিজস্ব উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সামরিক শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়েছে পাকিস্তান। পাশাপাশি বড় প্রকল্পের জন্য ছিলো বিদেশী কারিগরি সহযোগিতা।

স্থল ও বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে পাকিস্তান বেশি জোর দিচ্ছে বলেও তথ্য উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই নথিতে। এসবের মধ্যে ছিলো আল জারার ও টি-এইটি ইউডি ট্যাঙ্কের জন্য পাওয়ার ইউনিট প্রস্তুত করা। ট্যাঙ্কের জন্য গোলা তৈরি করা। চালকদের জন্য তাপ সহনীয় ও নাইট ভিশন প্যারিস্কোপ তৈরি। আল খালিদ ও টি-এইটি ইউডি ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন তৈরি করা।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের নথিতে উল্লেখ করেছে পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা টি-এইটি ট্যাঙ্কের নিজস্ব সংস্করণ তৈরির একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, যা শেষ হছে ২০১৯ সালে। চীনের তৈরি টাইপ এইটি-ফাইভ টু এপি মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের ১৬০টি নিজস্বভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনাও নিয়েছে ইসলামাবাদ। যা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালে। সাজোয়া যানসহ আরো কিছু সামরিক সরঞ্জামও তৈরি করছে পাকিস্তান।

পাকিস্তান তার সমরাস্ত্র ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে করনেট ই এন্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল কিনছে বলেও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে রাশিয়ার তৈরি এই অস্ত্রটি সরাসরি রাশিয়া থেকে না কিনে তৃতীয় আরেকটি দেশের মাধ্যমে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা পাকিস্তানের। আর স্পেন থেকে তারা কিনেছে শোল্ডার ফায়ার এন্টি ট্যাংক রকেট।

লেখক, গবেষক ও ইসলামাবাদে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রাইন ক্লাউঘলি মনে করেন, পাকিস্তানের এসব প্রস্তুতি মূলত যে কোন যুদ্ধের নিজেদের জন্য নিজেদের প্রস্তুুত করা, আরো স্পষ্ট করে বললেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যাগত শ্রেষ্ঠত্বের মোকাবেলা করা। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পাকিস্তান শুধু পারমাণবিক শক্তি দিয়েই নয়, সব সেক্টরেরই ভারতকে মোকাবেলার সামর্থ্য ধরে রাখতে চায়।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মতে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মোট জনবল ১২ লক্ষ চার হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সদস্য ৬ লক্ষ্য ৫৪ হাজার, আর রিজার্ভ সদস্য আছে সাড়ে ৫ লক্ষ। এর বাইরেও রয়েছে ৫ লক্ষ্য সদস্যের একটি আধা সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানের স্থল বাহিনী আকারের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী ছাড়াও দেশটির রয়েছে স্ট্রাটেজিক প্লানস ডিভিশন ফোর্স নামের একটি বাহিনী। অত্যন্ত ক্ষমতাবান এই বাহিনী পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ও স্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত।১৭০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র ও এগুলো নিক্ষেপের জন্য বিভিন্ন মিসাইল ও প্রজেক্টাইলের দেখভাল করে এই এলিট ফোর্স।আর রয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর একাধিক ডিভিশন।

পাকিস্তানের স্থল বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৬৮০টি ট্যাংক, ৯ হাজার ৬৩৫টি সাজোয়া যান, ৪২৯টি সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান, টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামান সংখ্যা ১ হাজার ৬৯০টি। এছাড়া রকেট প্রজেক্টর রয়েছে ৩৩০টি।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট এয়ারক্রাফট সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৪টি। এর মধ্যে ফাইটার ৩৫৭টি, স্পেশাল মিশন এয়ারক্রাফট ২৪টি, প্রশিক্ষণ বিমান ৫১০টি এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৫৩টি। পাকিস্তানের তিনটি বাহিনীর মধ্যে তার বিমান বাহিনীকেই সবচেয়ে শক্তিশালী ও দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটির ফাইটার বহরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-সিক্সটিন ফাইটার ফ্যালকন।

বর্তমানে বিভিন্ন সংস্করণের ১৬৫টি এফ-সিক্সটিন ফাইটার সক্রিয় আছে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ডায়নামিক্সের তৈরি এক সিটের এই ফাইটারটি একটি অলওয়েদার মাল্টিরোল ফাইটার। এয়ার টু এয়ার ও এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল ছুড়তে পারে ফাইটারটি।

চীন পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি জেএফ-সেভেনটিন এয়ারক্রাফটের সংখ্যাও কম নয় পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে। বর্তমানে এর ১১২টি বিমান সার্ভিসে আছে। আরো উন্নত সংস্কারণের ৫০টি তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। এই ফাইটারটি এখন নিজেরাই বানাচ্ছে পাকিস্তান। ২০২০ সালের একেবারে শেষের দিকে জেএফ-সেভেনটিন থাণ্ডার ব্লক টু মডেলের ১৪টি ফাইটার জেট যোগ দিয়েছে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে। যেগুলো নিজেরই উৎপাদন করেছে ইসলামাবাদের কাছের একটি শিল্প এলাকায়। এই মডেলের আরো উন্নত ব্লক থ্রি ভার্সনের উৎপাদনও শুরু করেছে দেশটি।

এর পাশাপাশি ফ্রান্সের তৈরি মিরেজ থ্রি, মিরেজ ফাইভ, চীনের চেংদু এফ-সেভেন ফাইটার টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানের আকাশ সীমায়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী বেশ কয়েক ধরণের ড্রোন পরিচালনা করছে। তাছাড়া তুরস্ক থেকে দেশটি ড্রোন কেনার আলোচনা চালাচ্ছে বলেও খবর পাওয়া গেছে গত ডিসেম্বরে।

ক্ষেপণাস্ত্র সেক্টরেও পাকিস্তান প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রবহনে সক্ষম ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল রয়েছে দেশটির। যা ভারতের যে কোন স্থানে আঘাত হানতে পারবে বলে দাবি ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের।এ বছর জানুয়ারির ২০ তারিখেও তারা শাহিন থ্রি বালেস্টিক মিসাইলের ফ্লাইট টেস্ট করেছে আরব সাগরে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ২ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার। এর আগে সপ্তাহেও তারা ফাতেহ ওয়ান মাল্টিপল মিসাইল লঞ্চারেরপরীক্ষা চালায়।

সব মিলে গত কয়েক বছরে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। নিজস্ব ব্যবহারের বাইরে স্থল যুদ্ধের কিছু উপকরণ তারা রফতানিও করছে।সামরিক খাতে পাকিস্তানের এসব পদক্ষেপই তাদের সামরিক শক্তির র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা দশে জায়গা করে নিতে সহযোগিতা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।