তুরস্ক ও গ্রিসের সামরিক শক্তির তুলনা


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২১ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:১৮

তুরস্ক ও গ্রিস প্রতিবেশী দেশ হলেও এ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উষ্ণ নয়। মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্কের অবস্থান এবং বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে তুরস্কের কার্যক্রমকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না গ্রিস। আবার তুরস্কও অভ্যন্তরীণ ও নিজেদের নিয়ন্ত্রিত নানা অঞ্চলে গ্রিসের উস্কানিমূলক কার্যক্রমকে অনুমোদন করতে পারছেন না। গ্রিস খ্রিষ্টান-প্রধান দেশ হওয়ায় ইউরোপের নানা পরাশক্তি থেকেও নিয়মিত সহযোগিতা পেয়ে থাকে। যাকে তুরস্ক দেখছে সার্বভৌমত্বের হুমকি হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রিস কি সামরিক দিক দিয়ে তুরস্কের সমপর্যায়ে আসতে পারবে?

গ্রিসের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দেশটির সামরিক বাজেটের পরিমাণ ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে তুরস্কের জনসংখ্যা ৮ কোটিরও বেশি এবং দেশটিতে সামরিক বাজেটের পরিমাণ প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গ্রিস তার মোট জিডিপির শতকরা ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। অন্যদিকে, তুরস্ক ব্যয় করে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গ্রিসের সামরিক বাহিনীতে বর্তমানে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার আর তুরস্কের সেনাবাহিনীতে সক্রিয় সদস্য আছে ৬ লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি। গ্রিসে যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার মতো রিজার্ভ জনশক্তির পরিমাণ ২ লাখের কিছু বেশি আর তুরস্কের রিজার্ভ সেনার সংখ্যা এখন সাড়ে ৪ লাখ পার হয়েছে।

গ্রিসের হাতে ট্যাঙ্ক আছে ১ হাজার ৩৫৩টি, আর্মাড সশস্ত্র যান আছে ৩ হাজার ৪০০টি, মোট আর্টিলারি আছে ১১৬২টি, প্রোপেল আর্টিলারি আছে ৫৪৭টি আর রকেট আর্টিলারি আছে ১৫২টি। অন্যদিকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর কাছে ট্যাংক আছে ২ হাজার ৪৩৫টি, আর্মাড সশস্ত্র যান আছে ৮ হাজার ১০০টি, মোট আর্টিলারি আছে ২৫৪৬টি, প্রোপেল আর্টিলারি আছে ১০৮৭টি আর রকেট আর্টিলারি আছে ৪৬২টি।

এবার আসা যাক বিমান বাহিনীর হিসেবে। গ্রিসের হাতে সব মিলিয়ে বিমান আছে ৬০০-এর কিছু কম। অন্যদিকে, তুরস্কের বিমান সংখ্যা এরই মাঝে ১৫০০ পার হয়েছে। গ্রিসের হাতে কোনো যুদ্ধবিমান না থাকলেও তুরস্কের কাছে আছে ৪৯টি বিশেষ যুদ্ধবিমান। মাল্টিরোল বিমান গ্রিসের হাতে এখন ১৯৮টি থাকলেও তুরস্কের কাছে এ জাতীয় বিমান আছে ৩০০টি। গ্রিসের কাছে হেলিকপ্টার আছে ২০০টি কিন্তু তুরস্কের হাতে থাকা মোট হেলিকপ্টারের সংখ্যা সাড়ে ৬০০-এরও বেশি।

গ্রিক নৌবাহিনীর হাতে মোট নৌ যানের সংখ্যা এখনো ১০০-ও পার হয়নি। তুরস্কের নৌ যানের সংখ্যা এখন আড়াইশর বেশি। নতুন প্রযুক্তির করভেটগুলো গ্রিসের হাতে একটিও নেই। কিন্তু তুরস্ক এরই মধ্যে ৯টি করভেটকে অপারেশনে নিয়ে এসেছে। গ্রিস সাবমেরিনের দিক থেকে তুরস্কের কাছাকাছি অবস্থানে আছে। গ্রিসের কাছে এখন ১১টি সাবমেরিন থাকলেও তুরস্কের হাতে আছে ১৩টি সাবমেরিন। তবে, তুরস্ক আগামী দু বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাবমেরিনও মোতায়েন শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গ্রিসের হাতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র বা প্রযুক্তি নেই। এ অস্ত্র তুরস্কের কাছেও নেই। তবে, ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে তুরস্ক এর মাঝে বেশ কয়েকবার ন্যাটো দেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিনিময় কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডগুলোকে পরিচালনার জন্য তুরস্কের কিছু সামরিক কর্মকর্তা প্রশিক্ষনও লাভ করেছেন। গ্রিসে প্যারামিলিটারি সেনাদের সংখ্যা ৪ হাজার হলেও তুরস্কের প্যারামিলিটারি সেনার সংখ্যা ৪৫ হাজারেরও বেশি।

গ্রিস ও তুরস্ক উভয়ই ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র হওয়ায় এ দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা ইউরোপীয় অন্যন্য মিত্র দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও বেশ চাপের মুখে ফেলে। প্রতিবেশি এ দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসছে।

১৯৯৬ সালে গ্রিসের একটি মিরেজ-টু থাউজেন্ড বিমান গুলি করে তুরস্কের ফি-সিক্সটিন বিমানকে ভূপাতিত করে। এতে তুর্কী বিমানের পাইলটসহ কয়েকজন কর্মকর্তাও নিহত হয়। আবার ২০০৬ সালে আবারো দুদেশের যুদ্ধবিমান সংঘর্ষের ঘটনায় তুরস্কের পাইলটটি বেঁচে গেলেও গ্রিক বিমানের পাইলট নিহত হয়।

আজিয়ান সাগরে পাওয়া জ্বালানী শক্তির নিয়ন্ত্রন নিয়ে তুরস্কের সাথে গ্রিসের টানাপড়েন চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু সংখ্যার দিক থেকেই তুরস্ক গ্রিসের চেয়ে এগিয়ে আছে এমন নয়। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের সেনা ও বিমান বাহিনীর সফল ভূমিকা এবং নাগারনো-কারাবাখের যুদ্ধে তুরস্ক ড্রোনের ব্যাপক সাফল্য দৃশ্যমান হওয়ায় গ্রিস কোনো দিক দিয়েই তুরস্কের সাথে পাল্লা দিয়ে জয়ী হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি গ্রিসের সামরিক বিশেষজ্ঞরাও এ্যাথেন্সকে সতর্ক করে দিয়েছে , পূর্ব ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রন নিয়ে তুরস্কের সাথে কোনো সংঘাতে জড়ালে তাতে গ্রিসের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গ্রিসের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ইউরোপীয় মিত্ররাও দেশটির ওপর সন্তুষ্ট নয়। ফলে যে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গ্রিসকে সমর্থন করতে কোনো রাষ্ট্র তুরস্কের বিরুদ্ধে যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, আজারবাইজান, ইউক্রেনসহ এবং মুসলিম বিশ্বে সৌদি-আমিরাতবিরোধী ব্লকের নেতৃত্ব দিয়ে তুরস্ক এখন বিশ্বের আলোচিত ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। ন্যাটোর দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক এখন সামরিক দিক থেকে দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ। কিন্তু তুরস্ক যেভাবে ড্রোন নির্মানে সফল হয়েছে এবং যেভাবে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে তাতে তুরস্ক তার অবস্থান ইতোমধ্যে শক্তিশালী করে ফেলেছে। অপরদিকে ফ্রান্স ছাড়া সেই অর্থে গ্রিসের কোনো স্থায়ী বন্ধু নেই। কিন্তু গ্রিসের অবস্থা টালমাটাল হলে ফ্রান্স এসে তার দায় নেবে বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে নিরাপত্তা সিস্টেম ক্রয় করায় রাশিয়াও এখন তুরস্কের সাথে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে চাইছে। রাশিয়ার সাথে সিরিয়া, আজারবাইজান, ইউক্রেনসহ নানা ইস্যুতে তুরস্কের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংকট থাকলেও রাশিয়া তুরস্ককে ক্ষেপিয়ে গ্রিসকে সাহায্য করবে বলে মনে হয় না।

গ্রিসের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ‘টা নিয়ে’ বলছে, গ্রিস যেভাবে আভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে প্রতিনিয়ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারস্থ হচ্ছে, তাতে কোনো সমাধান হচ্ছে না। নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে তুরস্কের অন্যায্য কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেও বিশ্বমোড়লদের সাড়া পাওয়া যাবে না। গ্রিসের অবস্থা হচ্ছে তারা নিজেরাই নানা ধরনের উসকানিমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে আর তারপর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে রেফারি মেনে নিয়ে তার কাছে গিয়ে নালিশ করছে।

গ্রিসের সংবাদপত্রটি পরামর্শ দিয়েছে গ্রিসের এই হম্বিতম্বি বাদ দিয়ে বরং বিকল্প চিন্তা করা উচিত। গ্রিসের কাছে দুটো বিকল্প আছে। তুরস্কের সাথে যুদ্ধে জড়ানো যেখানে জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং যে কাসটেললোরিজো দ্বীপ নিয়ে বহু বছর ধরে যে সংঘাত চলছে তা শেষ পর্যন্ত তুরস্কের নিয়ন্ত্রনে চলে যাবে। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে তুরস্কের সাথে আলাপ আলোচনায় বসা। যদিও এক্ষেত্রেও রাজনৈতিকভাবে গ্রিসের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দেখা যাবে, তুরস্ক একের পর এক দাবি তুলে অনেক কিছু আদায় করে নিচ্ছে আর গ্রিসকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাতে ছাড় দিতে হচ্ছে।

গ্রিসের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোর সাথে এরদোয়ানের সাম্প্রতিক বাদানুবাদ গ্রিসের জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ হলেও এমনটা মনে করা উচিত নয় যে, ফ্রান্স সবসময়ই গ্রিসকে সহযোগিতা করে যাবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন আঞ্চলিক লড়াইয়ে ফ্রান্সেরও আলাদা স্বার্থের হিসাব রয়েছে। যদি এ অঞ্চলের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন কমে যায় তখন দেখা যাবে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশই সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসবে। তখন এককভাবে কেউই গ্রিসের পাশে থাকতে চাইবে না।

গ্রিক পার্লামেন্টের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা লিয়ানা কানেলিও একপেশেভাবে ফ্রান্সের ওপর ভরসা রাখায় গ্রিক প্রশাসনের সমালোচনা করেন। তার মতে ফ্রান্স গ্রিসকে সমর্থন করছে ভূমধ্যসাগরে নিজেকে শক্তিশালী রাখার জন্যই। কিন্তু তুরস্ক যেভাবে আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠেছে তখন অন্য কোনো দেশ সহজে তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেবে না।

গ্রিস দীর্ঘদিন ধরেই ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের গ্যাস অনুসন্ধানকে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে। তুরস্ক অবশ্য বলছে, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান তাদের নিজস্ব অধিকার। তুরস্ক অবশ্য গ্রিসের সাথে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। এখন সে পথে দেশটি হাটছে। অপরদিকে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের সর্ম্পক উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ফলে আবারও গ্রিস নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে যাচ্ছে।