MiG-29K যুদ্ধবিমান নিয়ে সংকটে ভারত


  • মোতালেব জামালী
  • ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ১১:৫৩

২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর- এক বছর সময়ে ভারতের নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরীর তিনটি মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা হলেও ভারত মিগ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

গত বছর ২৬ নভেম্বর আরব সাগরে অবস্থানরত ভারতের বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রমাদিত্য থেকে একটি মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের পরপরই সাগরে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির কো-পাইলট কোনোভাবে তার আসন থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও পাইলট তা পারেননি। ফলে তিনি প্রাণ হারান। এই দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পরও পাইলটের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এর আগের দুর্ঘটনা দুটি ঘটে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর। এ দুটি দুর্ঘটনায় বিমানের পাইলটরা বেঁচে গেছেন। তারও আগে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি প্রথম মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এটি উড্ডয়নের সময় রানওয়েতেই বিমানে আগুন ধরে যায়। এসব দুর্ঘটনায় বিমানের পাইলটরা বেঁচে গেছেন।

এসব দুর্ঘটনা ঘটার অনেক আগে এই যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে ভারতের নীতি নির্ধারক মহলে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছিল। কারণ ২০১১ সালের জুন মাসে একটি রাশিয়ান মিগ-২৯কে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এর দুইজন পাইলটই নিহত হন।

একের পর এক দুর্ঘটনার পর মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতা ও এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয় বলে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সে সময় ডিফেন্স নিউজ জার্নালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ভারত ২০০৪ ও ২০১০ সালে রাশিয়ার সাথে দুই দফায় মোট ৪৫টি-মিগ ২৯কে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করে। এই যুদ্ধবিমানটি অনেক বেশি মারনাস্ত্র বহনে সক্ষম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এর বহুমুখি ব্যবহার করা যায়।

রাশিয়ার এই যুদ্ধবিমানগুলো সাধারণত দুর্ঘটনাপ্রবণ। ২০১৬ সালের শেষের দিকে রাশিয়া সিরিয়ার উপকূলে বিমানবাহী রণতরী ‘অ্যাডরিাল কুজনেতশভ’ কে মোতায়েন করে। সেখানে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে একটি মিগ-২৯ কে ও একটি এসইউ-৩৩ যুদ্ধবিমান পৃথক দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। রাশিয়া থেকে কেনা মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমানগুলো একের পর এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় ভারতের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে।

ভারতের নীতি নির্ধারকরা এখন নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নিজেদের বিমানবাহী রণতরীর জন্য বিকল্প কোন যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবছে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কোন দেশের কাছ থেকে কি ধরনের যুদ্ধবিমান কিনবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ভারতের বিমান বাহিনী সম্প্রতি ফ্রান্সের কাছ থেকে ফোর পয়েন্ট ফাইভ জেনারেশন ডাসল্ট রাফালে যুদ্ধবিমান কিনেছে। ফ্রান্স অবশ্য তার বিমান বাহিনীর জন্য রাফালের এক আসনের একটি নতুন ধরনের বিমান বানিয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বোয়িং এফ/এ-১৮ই/এফ সুপার হরনেট নেভী যুদ্ধবিমানও কিনতে পারে।

তবে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পঞ্চম প্রজন্মের লকহিড মার্টিনের এফ-৩৫ লাইটনিং- ২ যুদ্ধবিমান কেনার চিন্তা-ভাবনা নাও করতে পারে। কেননা এফ-৩৫, এফ-৩৫সি ও শর্ট টেকঅফ ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং ভার্সনের এফ-৩৫বি যুদ্ধবিমানও খুবই অত্যাধুনিক। বরং এগুলো তারা কেনার কথা ভারতে পারে। তবে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার যে চুক্তি করেছে তা যদি বাস্তবায়ন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কোন ধরনের যুদ্ধবিমানই হয়ত ভারতের কাছে বিক্রি করবে না।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারত কি করবে, কোন দেশের কাছ থেকে কি ধরনের যুদ্ধবিমান কিনবে তা নিয়ে আগাম কথা বলার সময় এখনো হয়নি। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর অঙ্গদ সিং বলেন, ভারতের বিমান বাহিনী কি ধরনের যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাগুলোর কথা বিবেচনা করে নতুন যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবা হবে বা পরিকল্পনা করা হবে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু ভারতের নৌবাহিনী যে এখন মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমানের উপর নির্ভর করতে পারছেনা তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ভারত দেশের বাইরে থেকে যুদ্ধবিমান কেনার কর্মসূচীর কথা প্রকাশ করে এবং এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য আহবান করে। সেসময় ৫৭টি যুদ্ধবিমান সংগ্রহের কথা বলা হয়। এছাড়াও বিমানবাহী রণতরীতে যেসব যুদ্ধবিমান আছে সেগুলোও বদলে ফেলা হবে বলে জানানো হয়।

নতুন যুদ্ধবিমান সংগ্রহের কথা বলা হলেও ভারতের দিক থেকে যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপরে তেমন কোন নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়নি। কারণ এ নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের ডিফেন্স অ্যাকুইজেশন কাউন্সিল থেকে লিখিতভাবে কোন অনুমতি বা অনুমোদন দেয়া হয়নি। দেশটি এক্ষেত্রে কত অর্থ ব্যয় করতে পারবে তা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে।

সম্প্রতি বোয়িং কোম্পানী তাদের তৈরি করা এফ/এ-১৮ যুদ্ধবিমানটি ভারত কিনতে পারে বলে দেশটির কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। তারা ভারতকে জানিয়েছে যে, তাদের এই বিমানটি কেবল নৌবাহিনীর রণতরী নয়, বরং স্থল থেকেও স্কি জাম্প এর মাধ্যমে উড্ডয়ন করতে পারে।

বর্তমানে ভারতের দু’টি বিমানবাহী রণতরী সাগরে রয়েছে। বিক্রমাদিত্য ও বিক্রান্ত নামের এ দু’টি রণতরীতেও স্কী জাম্পের ব্যবস্থা আছে।

ভারত এ মুহূর্তে অতিরিক্ত নতুন যুদ্ধবিমান কেনার পরিবর্তে তাদের নিজেদের যুদ্ধবিমানেরই আরো উন্নয়ন করতে চাইবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর একটি অন্যতম কারন হলো অর্থনৈতিক সামর্থ্যর অভাব। ভারতের নৌবাহিনী প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, তারা দেশেই নতুন ধরনের যুদ্ধবিমান প্রস্তুত করার কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। ২০৩২ সালে সালের মধ্যে তাদের এই বিমান তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেছেন, তারা তাদের এই কর্মসূচীতে মিগ-২৯কে বিমানের বিকল্প বিমান তৈরি করারও পরিকল্পনা নিয়েছেন।

যদিও শুধু যুদ্ধবিমান নয় যে কোনো ধরনের সমরাস্ত্র নির্মানের ক্ষেত্রে ভারতের সাফল্যর চিত্র মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।

গবেষক অঙ্গদ সিং মনে করেন, ভারতের নৌবাহিনীর মিগ-২৯কে বিমানের বদলি হিসেবে আরেকটি যুদ্ধবিমান কিনতে চাওয়ার অর্থই হচ্ছে নিজেদের প্রযুক্তিতে ২ ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান তৈরির কর্মসূচী জোরদার করা। এ জন্য পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করার কৌশল হিসাবে এমন যুদ্ধবিমান কেনার কথা বলা হচ্ছে। এটি ভারতের যুদ্ধবিমান আমদানী নির্ভরতা কমানোর একটি উদ্যোগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত যদি নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে বোয়িং কোম্পানীই অগ্রাধিকার পাবে বলে। কেননা কোম্পানীটি তাদের পণ্যের ব্যাপারে নানাদিক থেকেই ভারতকে অনেক নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এমনকি তারা তাদের বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও দেখিয়েছে ভারতকে। এছাড়া বোয়ং কোম্পানীর এফ/এ-১৮ যুদ্ধবিমান ভারতের বিমানবাহী রণতরীর বিমান এলিভেটরের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।

অন্যদিকে ফ্রান্সের রাফালে বিমানের কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া এই এলিভেটরের সাথে খাপ খাওয়ানো যাবেনা। আর এফ-৩৫বি/সি যুদ্ধবিমান তো ভারতের এই বিমানবাহী রণতরীর এলিভেটরের সাথে কোনভাবেই খাপ খাবেনা।

কারিগরি এসব দিকের কথা বাদ দিলেও, সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে অর্থ। এ মুহুর্তে ভারতের পক্ষে এ খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে কিনা সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এ ব্যাপারে নবনিযুক্ত চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ কি ভাবছেন আর নৌবাহিনীই বা কি করতে চায় সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের বিমান সেনারা মিগ-২৯ নিয়ে সব সময় ভয় ও শঙ্কার মধ্যে থাকেন। এই যুদ্ধবিমানকে তারা বিধবা বানানোর মেশিন হিসাবে ডেকে থাকেন। ফলে এই যুদ্ধবিমান নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না।