এ বছর যেসব বিমান আনছে রাশিয়া

-

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১০ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:০৪

বিমানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভিন্ন পথে হাঁটছে রাশিয়া। বেশি ব্যয়ে নতুন নতুন বিমান উদ্ভাবনের বদলে তারা মনোযোগ দিয়েছে পুরনো বিমানগুলোর আধুনিকায়ন করতে। তবে এ কারণে যে নতুন বিমান তৈরি থেমে থাকবে সেটিও নয়। রাশিয়া ২০২১ সালে কোন কোন বিমান তার বহরে যুক্ত করবে- বছরের শুরুতেই তার একটি ধারণা পাওয়া গেছে।

২০১০ সালের দিকে সশস্ত্র বাহিনীতে বড় ধরনের আধুনিকায়ন কর্মসূচি হাতে নেয় রাশিয়া। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিস বা সিএনএ’র এক রিপোর্টে রুশ বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, রাশিয়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৬০টি ব্রান্ড নিউ কমব্যাট এয়ারক্রাফট যুক্ত করেছে তাদের বাহিনীতে। এর বিপরীতে এই সময়ে পুরনো ৩২০টি বিমানকে করেছে আধুনিকায়ন। এ সবের তালিকায় রয়েছে মিগ, সুখোইসহ বিভিন্ন মডেলের বিমান।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক দিন রাশিয়া বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নে নজর দেয়নি।২০০৮ সালে জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধে সোভিয়েত যুগের বিমানগুলোর খারাপ পারফরম্যান্সই রাশিয়াকে বাধ্য করে বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নিতে।এই সময়ে এসে তারা নতুন বিমান তৈরির বদলে পুরনো বিমানগুলোকেই আধুনিকায়ন করতে গুরুত্ব দেয় বেশি। সেকেলে হয়ে যাওয়া যেগুলোকে আর আধুনিকায়ন করার সুযোগ নেই সেগুলোকে পাঠানো হয় অবসরে। এর ফলে রাশিয়ার বিমান বহরে অ্যাটাক এয়ার ক্রাফটের সংখ্যা ২ হাজার থেকে নেমে আসে ১২০০ তে। অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৭০০ থেকে কমে আসে ৪০০তে।

সংখ্যায় কম হলেও অধিক কার্যকর- এই নীতি মেনে রাশিয়া তার বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়ন করছে। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে বেশ কিছু বিমান নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি। কোন কোনটি ইতোমধ্যেই নির্মাণ কাজ শুরুও হয়েছে। চলতি বছর নতুন বিমানের তুলনায় পুরনো মডেলের বিমানগুলোই বেশি যুক্ত হবে রুশ বহরে। আর তার মধ্যে তালিকার এক নম্বরে থাকবে নিঃসন্দেহে পঞ্চম প্রজন্মের সু-ফিফটি সেভেন ফাইটার জেট।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে রুশ সেনাবাহিনী সু-ফিফটি সেভেন স্টিলথ ফাইটারের চূড়ান্ত মডেলটি হাতে পেয়েছে। এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এর একটি মডেল বিধ্বস্ত হওয়ায় এই কাজ কিছুটা পিছিয়ে যায়। ২০১০ সালে পঞ্চম প্রজন্মের এই ফাইটারটির প্রোটোটাইপ উড্ডয়ন করলেও পরবর্তী কয়েক বছরে এটির ডেভলপমেন্টের কাজ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে যায়। নকশা চূড়ান্ত হলেও সেটি এখনো সর্বাধুনিক ইঞ্জিন ও রাডার সিস্টেমের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। ন্যাটো এটির কোড নেম দিয়েছে ফেলন।

২০২০ সালে সু-ফিফটি সেভেনের দুটি বিমান তৈরি করেছে রাশিয়া। তবে আরো উন্নত রুপে এর পূর্ণাঙ্গ বহর তৈরি করবে ২০২১ সালে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কমসোমোলস্ক অন আমুর এয়ারক্রাফট প্লান্টের কাছে অত্যাধুনিক এই ফাইটারের ৭৬টি নির্মাণের অর্ডার করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ইঞ্জিন ও এভিয়নিক সিস্টেমে কিছুটা উন্নতি করার দরকার হলেও সেটি এই বছরের মধ্যে করার বিষয়ে আশাবাদী মস্কোর সামরিক বিশেষজ্ঞরা।

দুই ইঞ্জিনের সু-ফিফটি সেভেন ফাইটারটি যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এফ-থার্টিফাইভের চেয়ে দ্রুত গতির এবং বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। সুখোই কোম্পানির নকশা করা এই মডেলের প্রতিটি বিমানের নির্মাণ খরচ ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দুই ইঞ্জিন ও এক সিটের বিমানটি উড়তে পারে শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টিফাইভ ফাইটারের সাথে টক্কর দিতেই এই বিমানটি তৈরি করেছে রাশিয়া। এটির অ্যাটাক রেঞ্জসাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার।

ফাইটারটি ৭টি এয়ার টু এয়ার মিসাইল, ৪টি কেএইচ থার্টি এইট এয়ার টু সারফেস মিসাইল, দুটি এন্টি শিপ মিসাইল ও ৪টি এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল বহন করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ওজনের তিনটি গাইডেড বোমা ও ৫০০ কেজি ওজনের ক্লাস্টার বোমা বহন করতে পারে এটি। আর আছে একটি ৩০ মিলিমিটার স্বংয়ক্রিয় কামান। এর রাডার এক সাথে অনেকগুলো টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে।

রাশিয়ার আবিষ্কৃত প্রথম স্টেলথ প্রযুক্তির ফাইটার জেট এটি। স্টেলথ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সামরিক যানে রাডার, ইনফ্রারেড, রেডিও ফ্রিকেয়েন্সির খুব কম রিফ্লেকশন হয়। যে কারণে সহজেই শত্রুর নজর এড়াতে পারে এটি। যুক্তরাষ্ট্রর ও তার মিত্রদের সাথে আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের জন্য বিমানটি তৈরি করেছে রাশিয়া। প্রতিটি সু-ফিফটি সেভেন ফাইটার জেটের নির্মাণ ব্যয় চার কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।

সু-ফিফটি সেভেন নির্মাণে দেরি হওয়ার সময়টুকু অবশ্য বসতে থাকতে রাজি নয় রাশিয়ার বিমান বাহিনীর নীতি নির্ধারকরা। তাই ২০২১ সালে তারা ফোর পয়েন্ট ফাইভ জেনারেশনের ফাইটার জেটের সংখ্যাও বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।বিশেষ করে সুখোই সু-থার্টিফাইভ এস ফ্লাঙ্কার-ই ফাইটার এবং সু-থার্টি এসএমটু স্ট্রাইক জেটের সংখ্যা এ বছর বাড়াতে চায় রাশিয়া।

সু-থার্টি ফাইভ সত্যিকার অর্থেই এক বিপজ্জনক ওয়ার মেশিন। অনেক দিক থেকেই এটি ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-ফিফটিন ইগলের ক্ষমতাকে। অপেক্ষাকৃত কম কার্গো লোড করা হলে এটি পেতে পারে সুপারসনিক গতি। এর রয়েছে থ্রি ডাইমেনশনাল থ্রাস্ট ভেক্টরিং পাওয়ার, তাই কম গতিতে ছোটার সময়ও অবিশ্বাস্য রণকৌশল দেখাতে পারে। এর রয়েছে হেলমেট মাউন্টেট সিস্টেম অর্থাৎ পাইলটের হেলমেট তার চোখের সামনে সব তথ্য হাজির করে। এছাড়া আছে এআইএম-নাইনএক্স ও আর-সেভেনটি থ্রি বোরসাইট মিসাইল বহন ও ছোড়ার ক্ষমতা। তবে এর রাডারে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে।

আর দুই সিটের সু-থার্টি স্ট্রাইক ফাইটার অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের এফ-ফিফটিনের মতো। এগুলোর তুলনায় রাশিয়ার মিগ-টুয়েন্টি নাইন বা মিগ থার্টি ফাইভ আকাশ যুদ্ধে ততটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি।মূলত মিগ সিরিজের বিমানগুলো ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কম বাজেটের এফ-সিক্সটিন ফাইটারের সোভিয়েত কাউন্টারপার্ট; কিন্তু এখনকার সময়ের সাথে দুই ইঞ্জিনের বিমানগুলোর রেঞ্জ, ব্যবহার উপযোগীতা কোনটিই মানানসই নয়। দীর্ঘমেয়াদে সেবাও দিতে পারে না মিগ ফাইটার। এছাড়া মিগ-টুয়েন্টি নাইন বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায়ও পড়েছে। যে কারণে রাশিয়া এগুলোর বদলে সুখোই সু-থার্টিফাইভ এস ফ্লাঙ্কার-ই ফাইটার এবং সু-থার্টি এসএমটু স্ট্রাইক জেটের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। চলতি বছর তাই এই দুটি মডেলের আরো কিছু বিমান যুক্ত হবে রুশ বিমানবাহিনীতে।

স্নায়ুযুদ্ধ যুগের ব্ল্যাকজ্যাক বোম্বারকে আরো আধুনিক করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাশিয়া। পারমাণবিক বোমা, প্রচলিত বোমা কিংবা সমুদ্র এলাকায় হামলার জন্য এই বোম্বারটি খুবই কার্যকর। এছাড়া নিরাপদ দূরত্বে থেকে দূর পাল্লার স্টিলথ কিংবা ক্রুজ মিসাইল ছোড়ার জন্যও আদর্শ এই বিমানটি। বর্তমানে টুপেলভ সিরিজের বেশ কয়েকটি মডেলের বোম্বার রয়েছে রাশিয়ার। এর মধ্যে চার ইঞ্জিনের টি-ইউ নাইনটি ফাইভ ব্যবহৃত হচ্ছে ১৯৫৬ সাল থেকে। বোম্বারটি আরো উন্নত সংস্করণ নাইনটি ফাইভ এমএসএম আনতে চলেছে রাশিয়া। একই সাথে ১৯৭২ সাল থেকে সার্ভিস দিয়ে আসা টিইউ-টুয়েন্টি টু স্ট্রাটেজিক বোম্বারের অত্যাধুনিক সংস্করণ নির্মাণ করবে নতুন বছরে।এই বিমানগুলোর ইঞ্জিন, রাডার ও অস্ত্র ভাণ্ডারে ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে।

দানবাকৃতির টিইউ-ওয়ান সিক্সটি গ্লোবাল স্ট্রাইক বোম্বারের আধুনিকায়ন করতে শুরু করেছে মস্কো।এখন পর্যন্ত ২৭টি টি-ইউ ওয়ানসিক্সটি বোম্বার রয়েছে রাশিয়ার। সম্প্রতি এর আরো ১০টি এয়ারক্রাফটের অর্ডার দিয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই বিমানটিতে যে এনকে-থার্টি টু মডেলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, সেটি বিশ্বে এই মুুহূর্তে সেরা। এই ইঞ্জিনের কারণেই বিশাল আকৃতির হওয়া সত্ত্বেও বোম্বারটি শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে ছুটতে পারে।

২০২১ সালে রাশিয়া তার সোভিয়েত যুগের সু-টুয়েন্টি ফোর ফেন্সারকেও পুরোপুরি পাল্টে ফেলবে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-ওয়ান ইলেভেন বোম্বারের কাউন্টার পার্ট হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করেছিল ফেন্সার বিমানটিকে। ওয়াশিংটন ইতোমধ্যেই এফ-ওয়ান ইলেভেনকে অবসরে পাঠিয়েছে। আর এই বিমানটির বদলেও আনা হবে এক ঝাঁক সু-থার্টি ফোর, ন্যাটো যার কোড নেম দিয়েছে ফুলব্যাক।

এটি একই সাথে ফাইটার জেট ও বোম্বার- দুই ভুমিকায়ই কাজ করতে পারবে। দুই সিটের বিমানটি আকাশে শত্রুর বিমানের সাথে লড়াই করতে পারবে সমান তালে, আবার প্রয়োজনে বহন করতে পারবে ১৩ টন পর্যন্ত ওজনের বোমা। সু-টুয়েন্টি সেভেন ফ্লাঙ্কার ফাইটারের আরো উন্নত সংস্করণই এই ফুলব্যাক।

এর সেল্ফ ডিফেন্স সিস্টেম ও অ্যারে সেন্সর খুবই উন্নত, আছে ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল টার্গেটিং সিস্টেম। ভূমিতে থাকা টার্গেটও এটি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পারে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিপক্ষে বাশার আল আসাদের সরকারের হয়ে লড়াইয়ের সময় রাশিয়ার এই বিমানটি খুবই কার্যকর ভুমিকা পালন করেছে। যে কারণে এটির আরো কয়েকটি নির্মাণ করবে রাশিয়া এ বছর। ২০১৪ সালে সার্ভিসে যোগ দেয়া বিমানটির এখন পর্যন্ত ১৩১টি রয়েছে রুশ বিমান বাহিনীতে। তবে নতুন করে এই মডেলের কতটি বিমান নির্মাণ করা হবে সেটি প্রকাশ করা হয়নি।