ইরানের ড্রোন মহড়া, রোমানিয়ায় ড্রোন মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের, সোমালীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তুরস্ক, গ্রিস-ইসরাইল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি

-

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২৪

ইরানের ড্রোন মহড়া

প্রথমবারের মতো ড্রোনের মহড়া চালিয়েছে ইরান। দেশটি প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নিজস্ব উৎপাদিত কয়েকশ ড্রোন নিয়ে এই মহড়া চালিয়েছে। দুই দিনব্যাপী এই মহড়া শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার। ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ সিমনানের একটি ঘাঁটিতে চলে এই ড্রোন মহড়া।

ইরানের আর্মি অপারেশন্স বিভাগের উপ প্রধান মাহমুদ মুসাভি জানিয়েছেন, মহড়ায় আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র, ভুমিতে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া, টার্গেট চিহ্নিতকরণসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল অন্তর্ভূক্ত ছিলো।

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাইরানাকে তিনি বলেন, মহড়ায় আরো ছিলো সমুদ্রের নৌ বাহিনীর ড্রোনের টহল, শত্রু জাহাজ লক্ষ্য করে গোলা ছোড়া, দূর পাল্লার টার্গেটে হামলা করা সহ বিভিন্ন অনুশীলন।

একদিন আগে এই মহড়ার ঘোষণা দিয়ে ইরান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ হোসেইন দাদরাস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান মনুষ্য বিহীন আকাশযানের বিশাল বহর তৈরি করেছে। আমাদের সেনাবাহিনী প্রমাণ করবে, তারা যে কোন হুমকি মোকাবেলায় প্রস্তুত।

আর প্রতিপক্ষের প্রতি হুঙ্কার দিয়ে ইরান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মাদ বাকেরি বলেছেন, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর আঙ্গুল ট্রিগারেই আছে, শত্রুরা যদি সামান্যতম ভুলও করে, আমরা কঠিন জবাব দেব।

ইরান এমন একটি সময়ে এই মহড়ার আয়োজন করেছে, যখন দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা চরমে। বেশ কিছুদিন ধরেই ইরানের সাথে সামরিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। উপসগারীয় অঞ্চলে দুই দফা টহলও দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি ফিফটি টু বোম্বার। ৩ জানুয়ারি ইরানি কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ও ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মাহসিন ফাখরেজাদে হত্যার জের ধরে গত কিছুদিন ধরেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

ঠিক সেই সময়ে ইরানের নিজস্ব উৎপাদিত কয়েকশো অ্যাটাক ও নজরদারি ড্রোনের মহড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ ইরানের বৈরী রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্যে দেশটির সামরিক প্রস্তুতির বার্তাই দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অনেক দিন ধরেই সামরিক ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। দেশটির ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।ইরান বলছে, তারা যে কোন বিদেশী হুমকি মোকাবেলার ক্ষমতা রাখে।

রোমানিয়ায় ড্রোন মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের

ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সামরিক শক্তি জোরদারের অংশ হিসেবে রোমানিয়ায় এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোন মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর ইউরোপ-আফ্রিকা কমান্ডের এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, রোমানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ৭১তম বিমান ঘাঁটি ক্যাম্পিয়া তুরজিতে সম্প্রতি ৯০ জন বিমান সেনা কাজ শুরু করেছে ন্যাটো সাপোর্ট মিশনের অংশ হিসেবে। ঘাঁটিটিতে অত্যাধুনিক রিপার ড্রোনের একটি পূর্ণঙ্গ স্কোয়াড্রোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

মার্কিন বিমান বাহিনীর ইউরোপ-আফ্রিকা কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল জেফ হারিজিয়ান এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, আমাদের এমকিউ- নাইন ড্রোন কৌশলগত মিত্রদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। ওই অঞ্চলে নজদারির পাশাপাশি এটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠাবে আমাদের কাছে।

তবে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের মাঝামাঝিতে অবস্থিত ওই ঘাঁটিতে ঠিক কতটি রিপার ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে সেটি প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ন্যাটো মিত্র ও অন্যান্য ইউরোপীয় অংশীদারদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার রক্ষায় এই ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে।

এর আগে রোমানিয়ার ওই ঘাঁটিতে এমকিউ-ওয়ান প্রিডেটর ড্রোন মোতায়েন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রর। এবার সেটির বদলে পাঠানো হয়েছে আরো অত্যাধুনিক এমকিউ নাই রিপারড্রোন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতি কোম্পানি জেনারেল অ্যাটোমিকসের তৈরি ৩৬ ফুট লম্বা এই ড্রোনটি ১৮০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে পারে।

এটির সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪৮২ কিলোমিটার। আর কন্ট্রোল রুম থেকে ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করতে পারে ড্রোনটি এবং মাটি থেকে ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় একটানা আকাশে থাকতে পারে ১৪ ঘণ্টা। আর ভূমিতে থাকা লক্ষ্য বস্তুতে হামলা চালাতে পারে ২৫ হাজার ফুট উপর থেকে।

এক সাথে চারটি এজিএম-ওয়ান ওয়ান ফোর হেলফায়ার মিসাইল বহন করতে সক্ষম ড্রোনটি এর পাশাপাশি বহন করতে পারে প্রতিটি ২৩০ কেজি ওজনের দুটি লেজার গাইডেড বোমা। এছাড়া অন্যান্য গোলাবারুদও বহন করতে পারে আরো ২৩০ কেজির।

এছাড়া আকাশ থেকে আকাশে ছোড়া স্ট্রিঞ্জার মিসাইল যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে এমকিউ নাইন রিপার ড্রোনের সাথে। এই মডেলের প্রতিটি ড্রোনের নির্মাণ খরচ প্রায় ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করার পর থেকেই ইউরোপে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রর। ওয়াশিংটন বলছে, রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলোকে রক্ষায় তারা অঞ্চলটিতে এই পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে।

সোমালীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তুরস্ক

সোমালীয় সশস্ত্র বাহিনীর দেড়শ সদস্যকে স্পেশাল কমান্ডো ট্রেনিং দিচ্ছে তুরস্কের সেনাবাহিনী। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তির অংশ হিসেবে এই ট্রেনিং শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ইসপারতা প্রদেশের কাউন্টার টেরোরিজম ট্রেনিং এন্ড এক্সারসাইজ সেন্টারে শুরু হয়েছে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সোমালীয় সশস্ত্র বাহিনীর ১৫০ জন অতিথি সেনা সদস্যকে আমরা মৌলিক কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে চলছে।

গত আগস্টে সোমালিয়ায় নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূত মেহমেত ইলমাজ তুরস্কের আনাদোলু বার্তাসংস্থাকে বলেছিলেন, সোমালিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে তুরস্ক। এই সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ হাজার হতে পারে বলেও জানান তিনি।

হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের মুসলিম প্রধান দেশটির সাথে তুরেেস্কর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই বেশ ঘনিষ্ঠ। ২০২১ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান সোমালিয়া সফর করেন। সেটি ছিলো বিগত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে আফ্রিকার বাইরের কোন রাষ্ট্রনেতার প্রথম সফর। এরদোয়ান সরকার শুরু থেকেই সোমালিয়াকে বিভিন্ন ধরণের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। দেশটির স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে তুরস্কের সহযোগিতার পরিমাণ অনেক বেড়েছে গত দুই দশকে।

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে লড়াইয়ে তুর্কি সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা সোমালীয় সেনাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজে আসবে বলে মনে করছে মোগাদিসু, যা আফ্রিকার দেশটির শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় ভুমিকা রাখবে।

গ্রিস-ইসরাইল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি

ইসরাইলের সাথে বড় ধরনের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে যাচ্ছে গ্রিস। ইসরাইলি সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, ১৬৮ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় চুক্তি হবে। দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ে চুক্তিটি সই হওয়ার ক্থা রয়েছে। যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে গ্রিক বিমান বাহিনীর জন্য একটি ফ্লাইট স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা। স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বেসরকারি অস্ত্র উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান এলবিত সিস্টেমস।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে ইসরাইল থেকে প্রশিক্ষণ বিমান কিনবে গ্রিক সেনাবাহিনী।এছাড়া দেশটির সেনাদেরপ্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা দেবে ইসরাইল। ইসরাইলি প্রতিক্ষামন্ত্রী বেনি গান্তেজ বলেছেন, গ্রিসের সাথে ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান দারুণ সম্পর্কের কথাই প্রতিফলিত করে এই চুক্তি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যা উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। তিনি বলেন, এর ফলে উভয় দেশে হাজারো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে।

ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রফতানি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিভাগের প্রধান ইয়াইর কুলাস বলেছেন, ইসরাইলের সাথে গ্রিসের সুসম্পর্কের পথে বড় একটি পদক্ষেপ এই চুক্তি। এটি শুধু একটি রফতানি চুক্তি নয়, ২০ বছরের একটি অংশীদারিত্বের চুক্তি। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর আস্থা রাখার জন্য গ্রিসকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে।

গত বছরের নভেম্বরে ইসরাইল, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস নিজেদের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে যে সমঝোতায় পৌছেছিল তার অংশ হিসেবে এই প্রতিরক্ষা চুক্তিটি হয়েছে। গ্রিস ও সাইপ্রাস এমন একটি সময়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আগ্রহী হয়েছে যখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্কের সাথে তাদের পুরনো বিরোধ আবার জেগে উঠেছে।

তুরস্ককে ওই অঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে বাধা দিতে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছে গ্রিস। এ ব্যপারে ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতাও চেয়েছে এথেন্স। কিন্তু কোনভাবেই তুরস্ক তাদের দাবি অনুযায়ী অনুসন্ধান বন্ধ করেনি। এরপর ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ আঙ্কারার ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিলেও তুরস্ক বলেছে, তারা যেকোন ইস্যুতে আলোচনায় প্রস্তুত; কিন্তু কারো অন্যায় দাবি কাছে মাথা নত করবে না।